প্রবন্ধ ১...
প্রশাসন কি অপ্রিয় কথা শুনতে প্রস্তুত
থোপকথন, সংলাপ, কথাবার্তা রাজনীতিতে পরিচিত শব্দ, রাজনৈতিক কাজকর্মের অঙ্গ। কিন্তু কথোপকথন বা সংলাপকে ঘিরে রাজনীতি এবং কথোপকথনকে সম্বল করে প্রশাসন, এটা নতুন চিন্তা। আমরা এতে অনভ্যস্ত। সংলাপী রাজনীতি এবং প্রশাসন পদ্ধতির অবয়ব, রূপ ও চরিত্র নিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা ভাবেন না। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক দশক ধরে একতরফা রাজনীতি, অসংলাপী রাজনৈতিক আচরণ এবং সমাজকে কুক্ষিগত করে তার বহুত্বকে গ্রাস করার যে কুফল দেখছি, তার প্রেক্ষিতে কথোপকথনের রাজনীতি নিয়ে চিন্তাভাবনা হতে বাধ্য।
যে প্রশাসনিকতায় আমরা অভ্যস্ত, তাতে দলীয় হুকুম, শাসক এবং আমলাদের আদেশের স্থান আছে, কথাবার্তার স্থান নেই। সংলাপের ভিত্তিতে প্রশাসনিকতাকে নতুন করে বিন্যস্ত করার পরিকল্পনা নেই। দেশ চালানোর প্রসঙ্গে আমাদের কথাবার্তা বিধানসভার কাজকর্ম, মন্ত্রীদের ঘর, জেলাশাসকের দফতর এ সবে সীমাবদ্ধ। শাসকরা যদি বা এক পা এগোন, কথাবার্তার বিচিত্রগামী বহুত্ব তাঁদের শঙ্কিত করে। কত লোকের সঙ্গে কথা বলব? কত মত শুনব? কত উপায় ভাবব? কত দিন শুনব? প্রশাসনিক নিশ্চয়তার কী হবে? প্রশাসকরা দ্রুত পিছিয়ে যান। রাজনীতির রোমান্সের শেষ। রক্ষণশীলতার দ্রুত প্রত্যাবর্তন।
যুযুধান? কথা চলুক। মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
এবং বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। সর্বদল বৈঠক। ৩ অগস্ট, ২০১১
একটা-দুটো উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। দার্জিলিং নিয়ে নতুন করে কথার উদ্যোগ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নিলেন। উদ্যোগ স্বাগত। কিন্তু একই সঙ্গে আদিবাসী চা-শ্রমিক অধ্যুষিত তরাইয়ের জনতার সঙ্গে কথা সীমিত রাখলেন কেন? কেন এক পা এগিয়ে দেখলেন না, তরাই অঞ্চলে জনজাতি এবং নেপালি অধ্যুষিত স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যায় কি না? জঙ্গলমহলের ক্ষেত্রেও একই রক্ষণশীলতা। কেন ভেবে দেখছেন না, কী ভাবে পুলিশি সন্ত্রাস-বিরোধী কমিটির সঙ্গে কথা বলা যায়? আরও গুরুত্বপূর্ণ, কেন ভেবে দেখছেন না জল জমি এবং অরণ্যের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে জঙ্গলমহলে জনজাতি সমূহের স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করা যায় কি না, যা আজ ত্রিপুরায় আংশিক প্রবর্তিত?
এ রকম নানা দৃষ্টান্ত আছে। মূল শিক্ষা হল, কথাবার্তার বহুমুখী প্রবণতাকে স্বাগত জানানো দরকার। নতুন চিন্তার রসদ থাকলে তবেই সংলাপ চালানো যায়, নইলে কথাবার্তার রসদ দ্রুত শুকিয়ে যায়। প্রশাসনিকতাসর্বস্ব চেহারা নেয় রাজনীতি। পত্রপুষ্পহীন, প্রাণহীন, রসদহীন এক কঙ্কাল, যাকে শাসকরা বইতে থাকবেন আজীবন। আর বলবেন, জনসাধারণ আমাদের বুঝল না। অন্তত রাজনৈতিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক নির্বাচনোত্তর কালে পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সে দিক নজর ফেরানো দরকার। কিন্তু তার জন্য দরকার সংলাপকে কেন্দ্র করে স্বচ্ছ ভাবনা, নতুন পথে চিন্তা করতে শেখা।
অথচ আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে অতীতে সংলাপ এবং কথাবার্তার এক ঐতিহ্য ছিল। উপনিবেশবাদ-বিরোধী সংগ্রামে কথাবার্তা এক বড় ভূমিকা নিয়েছিল, যার স্মৃতি আজ আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিপটে হারিয়ে গিয়েছে। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ যেমন স্বদেশি আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন; গান, কবিতা রচনা করেছিলেন; তেমনই বলেছিলেন, হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ যদি অন্তর থেকে না কমে, দুই সম্প্রদায় যদি কথাবার্তা না বলে, তা হলে বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে কী হবে? অন্য দিকে, নিরন্তর সংলাপে যদি দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক নৈকট্য বা অন্তত বোঝাপড়া থাকে, তবে বিদেশি শাসক সেই সংলাপের টান কী ভাবে ছিন্ন করবে? আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথের কথা সে যুগের স্বদেশি নেতৃবৃন্দ শোনেননি। তিনি স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছিলেন স্বদেশি রাজনীতি থেকে। ১৯১১-এ বাংলা জোড়া লেগেছিল, তবে তা সাময়িক। কয়েক দশকের মধ্যে বাংলা ভাঙল, আরও ভীষণ ভাবে। বিপর্যয়ের মাঝে।
কথাবার্তা চিত্তরঞ্জন দাশকেও চালাতে হয়েছিল, যদিও বাংলার কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ তা পছন্দ করেননি। গাঁধী-জিন্না চুক্তি হয়েছিল তার দশ বছর আগে। সেই চুক্তি বা দাশ-ফজলুল হকের উদ্যোগে ‘বাংলা চুক্তি’ বা ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ অর্থহীনতায় দ্রুত পর্যবসিত হয়েছিল। কারণ, এই দুই ক্ষেত্রেই কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ অন্যদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করার বিরোধী ছিলেন। তাঁদের শ্রেণিস্বার্থ, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কোনওটারই অনুকূল মনে হয়নি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের সংলাপী পথ।
আজ যে কমিউনিস্টরা সমাজের নানা অংশের সঙ্গে কথাবার্তায় চূড়ান্ত অনীহা দেখালেন, অসহিষ্ণুতাকে তাঁদের রাজনীতির প্রধান চিহ্ন করে তুললেন, তাঁদেরও শৈশব কেটেছে রাজনৈতিক কথাবার্তায়। দেউলি, বক্সা বা আন্দামান বন্দিশিবিরে কমিউনিস্টরা এবং সন্ত্রাসবাদীরা ক্রমাগত সংলাপ করেছেন মত ও পথের সন্ধানে। এই পথেই পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় জ্যোতি বসু এবং অন্য কিছু নেতৃবৃন্দের দূরদর্শিতায় কংগ্রেস-বিরোধী ফ্রন্ট গড়ে ওঠে, যাকে মূলধন করে পরবর্তী অর্ধশতাব্দী জুড়ে বামপন্থীরা রাজনীতি করেছেন। কথাবার্তার রাজনীতি এই ভাবে একতরফা প্রশাসনিকতার মনোভাবকে বার বার চ্যালেঞ্জ করেছে। রাজনীতির এই ঐতিহ্য একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। তার স্মৃতি প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায়। তার কারণ, আগেই বলেছি, গত কয়েক দশকের শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় নিহিত।
মানুষ কথাবার্তার রাজনীতিতে কেন প্রবেশ করে? তিনটি সম্ভাব্য কারণ আছে।
প্রথমত, মানুষ ভাবতে পারে, মত বিনিময় করে সিদ্ধান্তে পৌঁছলে তাতে ব্যক্তির আখেরে লাভ। অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি হয় এই রকম এক আলোকিত স্বার্থবোধ থেকে। পরিণত স্বার্থবোধ থেকে এক জন ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠী বা একটি দেশ ভাবতে পারে সংলাপে তার বা তাদের লাভ। যদি পরকে দিয়ে নিজের মত মানিয়ে নেওয়া যায়, অথবা অল্প দিয়ে অনেকটা লাভ করা যায়, তা হলে স্বার্থরক্ষা হয় ভাল ভাবে। অনেক সময় এই ধারণার ভিত্তিতে অনেক অঙ্ক কষে কথাবার্তা চলে। তাতে স্বার্থরক্ষা হয় না বলব না, কখনও হয়। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না, যে সমস্যাকে কেন্দ্র করে সংলাপ। খুব কম দেখা যায় দু’পক্ষেরই মোটামুটি সমান লাভ হয়েছে। এই ধরনের কথাবার্তা থেকে কমই শেখার আছে। বিশেষত প্রশাসনকে যদি কথাবার্তা-ভিত্তিক হতে হয়, তা হলে সেই সংলাপমূলক প্রশাসন ব্যবস্থা এ ধরনের আলোকিত স্বার্থবুদ্ধির অস্তিত্বের ভিত্তিতে চলতে পারে না।
দ্বিতীয় কারণে কথাবার্তা চলে যখন যুদ্ধ অর্থাৎ অস্ত্রলীলায় যা পাওয়া দরকার, তা পাওয়া যায় না, বা লক্ষ্য উদ্ধারে যুদ্ধ যখন কাম্য নয় বা সম্ভব নয়, তখন সংঘর্ষের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায় কথাবার্তা। বলা যেতে পারে, সরকার এবং মাওবাদী বিদ্রোহীদের মাঝে কথাবার্তার প্রক্রিয়া অনেকটা এই ধরনের। রাষ্ট্র এবং নাগা বিদ্রোহীদের কথোপকথন ও দীর্ঘ আলোচনাও এই গোত্রের। এমন আলোচনাকে বলা চলে সংঘর্ষঘন রাজনীতির একটি দৃষ্টান্ত। আমরা চাই না-চাই, সমাজে সংঘর্ষঘন আলোচনা চলতে থাকে প্রশাসক ও প্রশাসিতের মাঝে। নেপালে মাওবাদী বিদ্রোহীরা এই ভাবে যুদ্ধ এবং কথোপকথন দুই উপায়কেই ব্যবহার করেছে পারস্পরিক বিকল্পরূপে গণ্য করে। এই ভাবে বিদ্রোহীরা এগোতে চেষ্টা করেছে। একই ভাবে তাদের বিরোধীরা চেষ্টা করেছে কখনও বিদ্রোহীদের যুদ্ধক্ষেত্রে ধ্বংস করতে, কখনও বা কথোপকথনে টেনে এনে তাদের শক্তি রুদ্ধ করতে। সংলাপ এ অবস্থায় নিজস্ব গতি নিয়েছে।
আমাদের দেশের সাংবিধানিক পরিষদ ছিল তেমনই এক অঘোষিত যুদ্ধের ক্ষেত্র। তিন-চার বছর ধরে সমাজের নানা গোষ্ঠী, মত, পথ এবং শক্তি পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মত্ত হয়ে ছিল, কার কথায় দেশ চলবে, তারই বিচারে। যত যুদ্ধ বাড়বে, তত রাজনীতির সুযোগ কমবে। যত কথাবার্তা বাড়বে, তত যুদ্ধ সীমিত হবে। এই বিচারে কথোপকথনে সমাজের নানা দ্বন্দ্বের চিরাবসান হবে না ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক বিচারের পথে কিছু দ্বন্দ্বের নিরসন হয়, সমাজ স্থায়িত্ব পায়।
কথোপকথনের তৃতীয় এক রূপও আছে। সংলাপ বিস্তার লাভ করে, যত লোকেরা মন খুলে কথা বলতে থাকে। সাহসের সঙ্গে ক্ষমতাধরের মুখের ওপর সত্যি বলা শুরু হয়। সত্যভাষণ সংলাপমূলক সংস্কৃতির প্রধান উপাদান। রাজার মুখের ওপর, শাসকের সামনে বা প্রশাসকের টেবিলের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে সত্যি কথা বলা সহজ নয়। বললে গর্দান যেতে পারে, কারারুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, অপ্রিয় হতে হয়, অনেক ঝুঁকি থেকে যায়।
সেই প্রশাসনই সংলাপকেন্দ্রিক হয়ে উঠে, যে প্রশাসন অপ্রিয় সত্য শুনতে সক্ষম। সত্যভাষণের ভিত্তিতে যে আলাপ, তাতে ঝুঁকি আছে; কিন্তু সুফল অনেক। কী ভাবে সেই পরিবেশ আসতে পারে, যেখানে জনমণ্ডলী, ব্যক্তিবর্গ বা চিন্তাবিদরা সত্যি কথা বলা শুরু করেন, ভাগ্য বিপর্যয়ের ঝুঁকি নিয়েও?
দু’রকম পরিস্থিতিতে এটা সম্ভব। এক, যখন শাসন অত্যন্ত অপ্রিয় হয়ে পড়ে, সবাই জানে রাজার পরনে পোশাক নেই এবং রাজাও উন্মাদ; তখন প্রজামণ্ডলী বলতে ভয় পায় না যে রাজা উলঙ্গ। বিগত শাসনের শেষ দিকে এই অবস্থাই এসেছিল। ট্রামে, বাসে, পাড়ায় সর্বত্র বলত, এই শাসন উলঙ্গ। কথোপকথন সেই অবস্থায় এত তীব্র হল, যে তার তীব্রতা শাসনের অবসান ডেকে আনল।
অন্য বিকল্প হল, যেখানে প্রশাসকই কথোপকথনের অনুকূল বাতাবরণ সৃষ্টি করেন। সামাজিক সংলাপের পৌরোহিত্য করেন, সবাইকে কথা বলার সুযোগ দেন এবং স্বীয় প্রভাব ও পৌরোহিত্যে কথোপকথনের এই যে নিরন্তর প্রক্রিয়া, তাকে চালিত করেন। প্রশাসনিকতা এতে অন্য মাত্রা পায়। সংলাপ হয়ে ওঠে রাজনীতির পদ্ধতি বা স্টাইল।
রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর প্রশাসন কোন পথে হাঁটবেন, তাঁরাই জানেন। কিন্তু সমাজে কথোপকথনের যে প্রবণতা ক্রমশ গতি পাচ্ছে, তাকে বিচারের মধ্যে আনতেই হবে। যদি বর্তমান শাসকরা কথোপকথনকেন্দ্রিক প্রশাসনরীতি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন, তাঁরা সাধুবাদ পাবেন। পরিবর্তনের যে ধ্বনি তাঁরা তুলেছিলেন, আংশিক হলেও তার যথার্থতা লোকে জানবে। লোকে বুঝবে উন্নয়নের এক স্বীয়, স্বতন্ত্র পথ আছে।

ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর অধিকর্তা


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.