রেল কিংবা পথ অবরোধ ঘটনাটি গুরুতর, কিন্তু সর্বদা তাহার কারণটি তত গুরুতর হয় না। বিচিত্র ছুতানাতায় কর্মনাশা মানুষজন রেললাইন বা রাস্তা জুড়িয়া বসিয়া পড়েন। অতঃপর যাহা ঘটে, তাহা জনতার পরিচিত অভিজ্ঞতা। ইহা পশ্চিমবঙ্গের তো বটেই, বস্তুত গোটা দেশেরই অভিজ্ঞতা। বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম বন্ধ হয়, অসুস্থরা হাসপাতালে যাইবার পথে রাস্তায় আটকাইয়া পড়েন, এবম্বিধ আরও নানা সংকটের উদ্ভব হয়। যে কারণে অবরোধ, তাহার সত্যকার সমাধান হয় কি না, তাহা বলা কঠিন। কারণ, সমস্যা যাহাই হউক, রেল বা রাস্তা অবরোধ তাহার সমাধান খুঁজিবার প্রকৃত রাস্তা নহে। হইতেও পারে না। গণতন্ত্র জনতাকে প্রতিবাদের অধিকার দিয়াছে অর্থ এই নহে যে ইচ্ছামাত্রে তাহার অপব্যবহার করা চলিবে। সম্প্রতি রাজস্থানে একটি বন্ধ লেভেল ক্রসিংকে জোর করিয়া খুলিয়া লাইন পার হইবার সময় মালগাড়ির ধাক্কায় কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তাহার পরেই স্থানীয় মানুষজন রেল অবরোধ শুরু করেন। পরিস্থিতি এমনই আকার নেয় যে, দিল্লি-মুম্বই রেল যোগাযোগ দিনভর ব্যাহত হয়। সুতরাং, এই জাতীয় অবরোধ রুখিবার জন্য সুপ্রিম কোর্ট যদি পুলিশের হস্তে আরও ক্ষমতা প্রদানের কথা বলে, তখন বিষয়টি গভীরতর বিবেচনা দাবি করে।
কথা উঠিয়াছে, অবরোধ রুখিবার জন্য নূতন আইন প্রণয়ন জরুরি। বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। এই কারণে অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ যে, নিছকই আইন প্রণয়ন করিয়া এই সমস্যার প্রকৃত মোকাবিলা করা অসম্ভব। সত্য, আইন থাকিলে প্রশাসনের হস্তে তাহা বাড়তি শক্তি হিসাবে কাজ করিবে। পুলিশকে যদি অধিকতর ক্ষমতা দেওয়া হয়, তাহাও এই জাতীয় অন্যায্য কার্যকলাপ ঠেকাইবার ক্ষেত্রে কার্যকর হইতে পারে। ইহা সংকটের সমাধানের দিকে পৌঁছিবার একটি দিক। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বন্দোবস্ত থাকিলে অবরোধ করিবার পূর্বে জনতা বহু বার ভাবনাচিন্তা করিবে। পুলিশি শক্তি এই কার্যে একটি বড় ভূমিকা গ্রহণ করিতেই পারে। তবে আইন থাকিলেই যে সেই আইন যথেষ্ট বলবৎ হইবে, তাহার কিছুমাত্র নিশ্চয়তা নাই। সেখানেই প্রশাসনের পরীক্ষা। ইহার পাশাপাশি আছে নাগরিকদের মনোভঙ্গি, যাহা অবরোধ করিয়া অন্যের কাজকর্ম পন্ড করিবার মাধ্যমেই নিজস্ব দাবিদাওয়া পূরণের সমর্থন কামনা করে। পরিভাষায় যাহাকে ‘ব্ল্যাক মেল’ বলা হয়, ইহা যে কার্যত সেই অপকর্মটিরই শামিল, সেই তিক্ত সত্যটি যে মনোভাবের সামনে আসিতেই পারে না। যেন হাজার হাজার অবরুদ্ধ যাত্রী বা পথচারীর মুক্তিপণ হিসাবে কোনও একটি দাবি পেশ করা হইল, সেই দাবির বিষয়ে প্রশাসনিক মনোভাব না-জানা পর্যন্ত অবরুদ্ধগণ পণবন্দি হইয়াই থাকিবেন, বিষয়টি এই রকমই দাঁড়ায়। সমস্যা বাড়িয়া যায় তখনই যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও মওকা বুঝিয়া হাততালি কুড়াইবার আশায় আসরে নামে। অবরোধকারীদের নিরুৎসাহিত করা দূরস্থান, বিভিন্ন দল অগ্নিতে যথাসাধ্য ঘৃতাহুতি দেয়। তাহাতে সংশ্লিষ্ট দলের তাৎক্ষণিক কিছু লাভ হইতে পারে, অদূরে নির্বাচন থাকিলে সেই সম্ভাবনা আরও বেশি, কিন্তু প্রকৃত গণতান্ত্রিক বোধটি পরাজিত হয়। নাগরিক সমাজ এবং রাজনৈতিক দল উভয় তরফের মনোভাবে একটি পরিবর্তন না-আসিলে নিছকই আইন দিয়া কখনওই সংকটের সমাধান করা যাইবে না। আইন থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিভঙ্গকারীগণ যেমন ফাঁক খুঁজিয়া লয়, এই ক্ষেত্রেও তাহাই ঘটিবার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু, অবরোধ রুখিবার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ভাবনাচিন্তা চলুক। |