থিম ছিল ‘ভারতীয় হস্তশিল্প ঈশ্বরপ্রদত্ত হাতের জাদু’! মুখ্যমন্ত্রী চাইলেন, হস্তশিল্পের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ‘জাদু’ও দেখাতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে রাজ্যের পর্যটনকে তুলে ধরার এমন সুযোগ আর মিলবে না! সময় পেলেই তিনি তুলি-ক্যানভাস নিয়ে বসে পড়েন। গোটা ভাবনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠতে তাঁর তাই বেশি সময় লাগেনি।
সেই ভাবনা অনুযায়ীই দিল্লির প্রগতি ময়দানে পশ্চিমবঙ্গের প্যাভিলিয়নের উপরে ধীরে ধীরে মাথা তুলছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। সাদা বরফের সঙ্গে মিশছে ডুয়ার্সের চা-বাগানের সবুজ। জলদাপাড়ার ‘এলিফ্যান্ট সাফারি’ থেকে মুখ ঘোরালেই বাতাসিয়া লুপের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা লাইন ধরে নেমে আসছে টয় ট্রেন। পাহাড় ও সমতলের মিলনের কথা বলছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রগতি ময়দানেও পাহাড়ের সঙ্গে মিলেছে সমতলের দিঘার সমুদ্রতট, বিষ্ণুুপুরের রাসমঞ্চ। আর সুন্দরবন? থাকতেই হবে!
এ হেন প্যাভিলিয়নের পরিকল্পনা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর। তাঁর নির্দেশে শিল্পী বাপ্পাদিত্য চক্রবর্তী গড়ে তুলছেন ওই প্যাভিলিয়ন। আগামী ১৪ নভেম্বর থেকে দিল্লিতে শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। যার আয়োজনে এ বার পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম শরিক বা ‘পার্টনার স্টেট’। উদ্বোধনের দিন আসছেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ২৪ নভেম্বর মেলায় ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’। সে দিন থাকবেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। তিনিই জাতীয় সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হবেন।
দিল্লিতে নিযুক্ত রাজ্য সরকারের পদস্থ আধিকারিকরা মানছেন, বাম জমানায় কখনওই জাতীয়-আন্তর্জাতিক মঞ্চে এ ভাবে রাজ্যকে তুলে ধরার চেষ্টা হত না। শুধু ২০০৮ সালে শিল্পায়নের জোয়ার আনার চেষ্টায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজে উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। সে বার সেরা প্যাভিলিয়নের পুরস্কারও পেয়েছিল রাজ্য। সে-ই প্রথম, সে-ই শেষ। এমনকী বাম জমানায় শেষের দিকে রাজ্যের কোনও মন্ত্রী প্রগতি ময়দানে এসে সাংবাদিক সম্মেলনও করতে চাইতেন না। এ বার অন্য ছবি। শিল্প-তথ্যপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগের সুযোগ তো তুলে ধরা হবেই, সেই সঙ্গে রাজ্যের কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায় নিজে উদ্যোগী হয়ে দফতরের আধিকারিকদের পাঠিয়েছেন। কর্মযজ্ঞে মিশেছে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট রাজনীতির রঙও। অধীর চৌধুরীর মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারির সঙ্গে হাজির থাকবে মানস ভুঁইয়ার দেশের মাদুরও।
সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল সেই অগস্টে। প্যাভিলিয়নের পাঁচটি মডেল তৈরি করেছিলেন বাপ্পাদিত্য। পাঁচটিই পছন্দ হয় মমতার। শেষে সবক’টি মডেলের বাছাই করা বিষয়গুলি নিয়ে প্যাভিলিয়ন তৈরির নির্দেশ দেন তিনি। সেই ‘কঠিন কাজ’টাই করে চলেছেন বাপ্পাদিত্য। পাহাড়-ডুয়ার্স-দিঘা-সুন্দরবনের মিশেল যেমন থাকছে, তেমনই মেলার থিম মেনে প্যাভিলিয়নের মূল প্রবেশপথ তৈরি হচ্ছে শীতলপাটি, মাটির পুতুল, টেরাকোটা, শোলার কাজের মতো রাজ্যের হস্তশিল্পের নানা নিদর্শন দিয়ে। ‘পশ্চিমবঙ্গ দর্শন’ সেরে বেরোনোর পথেও থাকবে ডোকরার দু’টি বিরাট কাজ। আর প্যাভিলিয়নের পাশে থাকবে কুমোরের একটি মডেল।
কুমোরের মূর্তিটা যদিও থাকছে, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর স্পষ্ট নির্দেশ জলজ্যান্ত শিল্পীদেরও মেলায় হাজির করাতে হবে। শিল্পোন্নয়ন নিগমের কর্তারা জানাচ্ছেন, সেই নির্দেশ মেনেই বালুচরী শাড়ির তাঁত উড়িয়ে আনা হচ্ছে প্যাভিলিয়নে। পটচিত্র আঁকবেন পূর্ব মেদিনীপুরের এক শিল্পী। পাশেই তৈরি হবে
মসলন্দের মাদুর।
থাকবে তামা ও শোলার কারিকুরি। ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত হাতের জাদু’ যখন থিম, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতের ছোঁয়া বাদ থাকে কী করে? মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে প্যাভিলিয়নের বহিরঙ্গ সাজছে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির ক্যানভাস দিয়েও। এ ছাড়া প্রগতি ময়দানের ফুড কিয়স্কের অনেকটাও দখল করে থাকবে বাঙালি খানা। প্যাভিলিয়নে এখন তুলির শেষ টান পড়ার অপেক্ষা। বাণিজ্য মেলায় মমতা নিজে আসবেন কি না, এখনও নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি। তবে ২৪ নভেম্বর ‘পশ্চিমবঙ্গ দি তিনি আসবেন ধরে নিয়েই নিখুঁত প্রস্তুতিপর্ব চলছে। ফুটে উঠছে বাংলার প্রকৃতি আর হাতের কাজের জাদু। |