পুঁজিবাদের ‘সঙ্কট’ নিয়ে উল্লসিত সিপিএম নেতৃত্ব। আমেরিকা-ইউরোপে ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল’ বিক্ষোভ যে আসলে বাম মতাদর্শের সাফল্য, লন্ডনে এসেও তা বোঝাতে চাইলেন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি। সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রালের বাইরে তাঁবু খাটিয়ে বিক্ষোভ দেখেও উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু দেশের মাটিতে তাঁদের দলের এই কোণঠাসা হাল কেন, নির্বাচনে তাঁদের সরকারগুলিই বা হেরে যাচ্ছে কেন, সেই প্রশ্ন উঠছেই। আর সেই প্রশ্নের মুখে ‘ফ্যাসিবাদের জুজু’ দেখাচ্ছেন এই সিপিএম নেতা।
সীতারাম ইয়েচুরির দাবি, যখনই কোথাও বাম-সরকারের পতন হয়, সেখানে অতি-দক্ষিণ ও ফ্যাসিবাদী শক্তির জন্ম হয়। তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে অতি-দক্ষিণ ও অতি-বামেদের জোটের ফলেই বামেদের হার হয়েছে। তারা সবাই একসঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। কিন্তু বিপদের কথা হল, সেখানে এক নতুন-ফ্যাসিবাদী প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। বামপন্থীরা দুর্বল হলে এই প্রবণতা আসবেই।”
কেমব্রিজের পারসে স্কুলে ‘রজনীপাম দত্ত স্মারক বক্তৃতা’ দেওয়ার পাশাপাশি গত কাল সেখানকার অ্যাংলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সাম্রাজ্যবাদের মোকাবিলা’ বিষয়েও বক্তৃতা দেন ইয়েচুরি। পারসে স্কুলে জনা চল্লিশেক শ্রোতার অধিকাংশই ছিলেন আর এক বাম-দুর্গ কেরল থেকে আসা ছাত্রছাত্রী। সেখানেই ইয়েচুরিকে পশ্চিমবঙ্গে হারের কারণ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। জবাবে ইয়েচুরি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি ছিল অভূতপূর্ব। আমরা টানা সাত বার ভোটে জিতেছিলাম। এখনকার ভোটারদের দুই-তৃতীয়াংশেরই জন্ম হয়েছে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে। তাই পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ছিল আকাশছোঁয়া।” |
পারসে স্কুল থেকে শুরু করে অ্যাংলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েচুরির কথায় বার বারই ঘুরে ফিরে এসেছে পুঁজিবাদের সঙ্কটের কথা। একই সঙ্গে ভারতে যে এই সঙ্কটের বিশেষ প্রভাব পড়ছে না, তার পিছনেও বামেদের কৃতিত্ব দাবি করেন ইয়েচুরি। তাঁর যুক্তি, এই ধরনের আর্থিক সঙ্কট থেকেও ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়। জার্মানির উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “আর্থিক সঙ্কটের একটা জবাব হল আরও দক্ষিণপন্থা। হিটলার কেন পাকা রাস্তা তৈরি করেছিলেন? সেনাবাহিনীর যাতায়াতের জন্য। তাতে প্রচুর কর্মসংস্থান হয়, জার্মানিও মন্দার কবল থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু সেখান থেকেই ফ্যাসিবাদের জন্ম।”
ইয়েচুরি-কারাটের মুখে হাসি ফুটিয়ে এখন লন্ডনে সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রালের বাইরে বিক্ষোভকারীরা তাঁবু খাটিয়ে ফেলেছে। আমেরিকায় ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল’-এর অনুকরণে গত দু’সপ্তাহ ধরে এই বিক্ষোভ চলছে। সেই উদাহরণ টেনেই ইয়েচুরি লন্ডনের ছাত্রছাত্রীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, সাব-প্রাইম সঙ্কটের হাত থেকে বেরোতে আমেরিকা-ইউরোপে ব্যাঙ্কগুলির ঋণের বোঝা সরকার নিজের ঘাড়ে চাপিয়েছে। ফলে জনস্বার্থে খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছে সরকার। সাধারণ মানুষ চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়েছেন। কর্পোরেট সংস্থাগুলির লোভ ও সরকারি নিয়ন্ত্রণের প্রতিবাদে তাই পৃথিবীর দেড় হাজার শহরে এখন বিক্ষোভ চলছে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাই এমন যে সেখানে যে কোনও মূল্যে শুধু লাভের অঙ্ক বাড়িয়ে যাওয়ার কথাই বলা হয়। ইয়েচুরি বলেন, “আমরা আজ যা দেখছি, সেটা আসলে সাম্রাজ্যবাদের একটি নতুন দশা। আমরা যদি একে চ্যালেঞ্জ না জানাই, তা হলে বর্বরতাই হল একমাত্র ভবিষ্যৎ।” সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্যের দাবি, প্রথম ইউপিএ-সরকারের জমানায় বামেরা সেই চ্যালেঞ্জটাই জানিয়েছিল। আর্থিক সংস্কারের পথে চারটি আইন তাঁরা পাশ হতে দেননি। আর তার ফলেই মন্দার ছোঁয়াচ থেকে রক্ষা পেয়েছে ভারত।
ইয়েচুরির জন্য অ্যাংলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাগৃহ সাজানো হয়েছিল কার্ল মার্ক্স, চে গুয়েভারা, ভগৎ সিংহ, রজনীপাম দত্তদের ছবি দিয়ে। তরুণ জ্যোতি বসু-সহ ১৯৬৪ সালের পলিটব্যুরোর সদস্যদের একটি ছবিও ছিল প্রেক্ষাগৃহে। সুদূর বার্মিংহাম বা বর্নমাউথ থেকেও অনেকে ভারতের কমিউনিস্ট নেতার বক্তৃতা শুনতে এসেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র, ইন্ডিয়ান সোসাইটির প্রধান বৈজু থিত্তালা ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান আয়োজক। ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বৈজু বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম, উনি এসে আমাদের কমরেডদের সামনে বক্তৃতা দিন।” ইয়েচুরি এলেন, বললেনও। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে বামেদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির কী দিশা দেখালেন? যেখানে অণ্ণা হজারের জন্য রামলীলা ময়দান ভরে উঠছে, সেখানে বামেরা কেন কলকাতা বা দিল্লির রাজপথে ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল’ বিক্ষোভের ঢেউ তুলতে পারছেন না?
ইয়েচুরি জানালেন, বামেরাই বরাবর লোকপাল বিলের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু ভি পি সিংহ থেকে মনমোহন সিংহ, কোনও সরকারই লোকপাল বিল পাশ করায়নি। রসিকতা করে বললেন, “প্রধানমন্ত্রীকে আমি বলি, আপনি হলেন আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের মতো। আপনি আলিবাবা হতে পারেন, কিন্তু চল্লিশ চোর সঙ্গে রয়েছে। তার মধ্যে তিন জন জেলে।” ইয়েচুরি জানান, গত দশ বছরে ভারতে সরকার কোনও নতুন কলেজ খোলেনি। যা খুলেছে, সবই বেসরকারি। সেখানে ছাত্র সংসদ করার অনুমতি নেই। সর্বত্র ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করা হচ্ছে। তাদের ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হয় না।
ইয়েচুরি বলেন, সংগঠিত ক্ষেত্রের বাইরে রয়েছেন ৯৩ শতাংশ শ্রমিক। আর রয়েছেন কোটি কোটি গরিব মানুষ। তাঁরাই বামেদের জনভিত্তি। তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক বোধ তৈরি করতে হবে। ঘুরে দাঁড়াতে দলের এই মূল জনভিত্তিতে ফেরার কথা বলছেন প্রকাশ কারাটও। লন্ডনেও সে কথাই জানিয়ে গেলেন সীতারাম ইয়েচুরি। |