ধাতব হাঁটুরও কিন্তু ক্ষয় আছে
বীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘যদি জানতেম আমার কীসের ব্যথা তোমায় জানাতেম।’ এ থেকে বোঝা যায়, তিনি হাঁটুর ব্যথায় ভুগছিলেন না। কারণ হাঁটুর ব্যথা প্রতিপদে জানান দেয়, ব্যথা ঠিক কোথায়। মধ্য তিরিশের যুবতী বা সদ্য চল্লিশ পার হওয়া যুবককেও এখন হাঁটু প্রতিস্থাপনের জন্য ডাক্তারের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। অল্প বয়সে রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিস যেমন এর একটা কারণ, অন্য কারণ হল দুর্ঘটনায় হাঁটু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।
মুশকিল হল, নিজের হাঁটুর চাইতে কৃত্রিম হাঁটুর ক্ষয় হয় অনেক তাড়াতাড়ি। ধাতুর তৈরি বিকল্প হাঁটু ক্রমাগত হাঁটাচলার ফলে ঘষা লেগে ক্ষয়ে যায়। ফলে আবার প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয়। ‘জার্নাল অফ বোন অ্যান্ড জয়েন্ট সার্জারি’-র রিপোর্ট অনুযায়ী, এই মুর্হূতে বিশ্বে যদি বছরে সাড়ে চার লক্ষ জনের হাঁটু প্রথমবারের জন্য প্রতিস্থাপিত হয় তা হলে ২০৩০ সালে সেই সংখ্যাটা পৌঁছবে বছরে সাড়ে চৌত্রিশ লক্ষে। আর আজ যতজন দ্বিতীয় বারের জন্য হাঁটু বদলাচ্ছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে তাঁদের সংখ্যা প্রায় ৬০০ শতাংশ বেড়ে যাবে!
তাই যে ধাতব হাঁটু এখন ব্যবহার হয়, সেই ক্রোম-কোবাল্ট স্টেইনলেস স্টিল-এর বিকল্পের খোঁজ চলছে। নতুন বিকল্প: অক্সিনিয়াম অক্সিডাইজড জারকোনিয়াম।
কোনটা কাজে দেয় বেশি? হাড়ের চিকিৎসকদের মধ্যে এই নিয়ে মতভেদ। প্রাচীন বনাম নবীনের লড়াই। এক পক্ষের মতে, হাঁটুর ক্ষেত্রে আদি অকৃত্রিম ক্রোম-কোবাল্ট স্টেইনলেস স্টিল ইমপ্ল্যান্টের কোনও বিকল্প নেই। এখনও পর্যন্ত এটাই হাঁটুর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, টেকসই ইমপ্ল্যান্ট। কিন্তু বিরুদ্ধ শিবিরের পাল্টা সওয়াল অক্সিনিয়াম অক্সিডাইজড জারকোনিয়াম-কে ঘিরে। এই ধাতু দিয়েই নাকি হাঁটুর আধুনিকতম ও সর্বোত্তম বিকল্প তৈরি সম্ভব। চিকিৎসক ও রোগী উভয় পক্ষেরই এই মুহূর্তে প্রথম কাজ দ্বিতীয়বার হাঁটু প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনা কমিয়ে আনা। সেটা তখনই সম্ভব যখন প্রথম প্রতিস্থাপিত ধাতুর হাঁটুর ক্ষয় কম হবে। অস্থিসন্ধি প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ বিকাশ কপূর যেমন মনে করেন, কোবাল্ট ক্রোম স্টেইনলেস স্টিল ঘর্ষণের ফলে ক্ষয়ে যায় দ্রুত। সাধারণ ভাবে আমাদের দেশে এখনও বেশির ভাগ হাঁটুর বিকল্প এই ধাতুতেই তৈরি হয়। প্রতিস্থাপনের পর হাঁটাচলায় ধাতু ক্ষয় পেতে থাকে এবং ১৫-১৬ বছরের বেশি তা স্থায়ী হয় না। ফলে কম-বেশি ১৫ বছর পরেই আবার রোগীর চলাফেরায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। তাঁর কথায়, “অক্সিনিয়াম অক্সিডাইজড জারকোনিয়াম তুলনায় অনেক বেশি ‘স্ক্র্যাচ ফ্রি।’ ফলে একবার এই ধাতু দিয়ে বিকল্প হাঁটু তৈরি করলে তা ২৫-৩০ বছর স্থায়ী হতে পারে।”
এই দাবি অবশ্য সরাসরি মানতে চাননি অস্থিসন্ধি প্রতিস্থাপনের চিকিৎসক রণেন রায়। তাঁর মতে, অক্সিনিয়াম কতটা টেকসই তা এখনও প্রমাণ সাপেক্ষ। মুখে বললেই তো হল না। খাতায়-কলমে তা দেখাতে হবে। তাঁর দাবি, অক্সিনিয়াম নিয়ে গবেষণা এখনও চলছে। তা শেষ না এলে গুণাগুণ নিয়ে সিদ্ধান্তে আসা অনুচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভাল-মন্দ যাচাই না করেই এক দল চিকিৎসক অক্সিনিয়াম-এর ট্রেন্ড এ গা ভাসিয়েছেন। গিমিক সর্বস্ব হয়ে লাভ নেই। এর জন্য আরও কয়েকটা বছর অপেক্ষা করতে হবে।
অস্থিচিকিৎসক দেবাশিস চক্রবর্তী বলেছেন, প্রাথমিক স্তরে অক্সিনিয়ামের তৈরি ইমপ্ল্যান্টে ভাল ফল দেখা গিয়েছে। তা বলে এটা শ্রেষ্ঠ ভাবার সময় আসেনি। কারণ, দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা কতটা কার্যকর তা এখনও পরীক্ষা করা যায়নি। অক্সিনিয়াম এ দেশে সদ্য ব্যবহার শুরু হয়েছে। এর তৈরি হাঁটু ৩০ বছর টিঁকবে কিনা তার জন্য তো ৩০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। আমেরিকায় গত ১৫ বছর ধরে অক্সিনিয়াম ধাতুর তৈরি বিকল্প হাঁটুর ব্যবহার প্রচলিত রয়েছে। সেদেশের ওহায়োর ওয়েশিংটন অর্থোপেডিক্স অ্যান্ড স্পোর্টস মেডিসিনের চিকিৎসক মার্ক স্নাইডার জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই সেখানে প্রায় চার লক্ষ লোকের হাঁটু প্রতিস্থাপিত হয়েছে অক্সিনিয়াম দিয়ে, এবং তাঁরা খুবই ভাল আছেন।
স্নাইডারের তত্ত্বাবধানেই ২০১০-এর ফেব্রুয়ারি থেকে অগস্টের মধ্যে দক্ষিণ ভারত ও মহারাষ্ট্রে প্রায় চারশো জনের দেহে অক্সিনিয়ামের হাঁটু প্রতিস্থাপিত হয়েছে। স্নাইডারের কথায়, “অল্পবয়সীদের মধ্যে আর্থারাইটিস বাড়ছে। সেই সঙ্গে মানুষের গড় বয়স বাড়ায় মানুষ অনেক বেশি দিন বেঁচে থাকছেন। তাঁদের বয়সজনিত হাঁটুর সমস্যা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অক্সিনিয়াম হাঁটুর যথার্থ বিকল্প হতে পারে।”
অক্সিনিয়ামে তৈরি হাঁটুর প্রতিস্থাপন খরচ ক্রোম-কোবাল্টের তৈরি হাঁটু প্রতিস্থাপনের থেকে কিছুটা কম। এর থেকে অ্যালার্জি হওয়ার সম্ভাবনাও প্রায় নেই বলে জানিয়েছেন অনেক চিকিৎসক। তবে কোনটা ভাল তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা এখনও নেওয়া যাচ্ছে না। প্রতিস্থাপিত হাঁটুর মধ্যে কার জোর বেশি সেই লড়াইটা আপাতত থেকেই যাচ্ছে।
এক নজরে

• ‘অক্সিনিয়াম অক্সিডাইজড জারকোনিয়াম’ নামে ধাতব সংকর দিয়ে তৈরি কৃত্রিম হাঁটু,
যার উপরিভাগটা সেরামিক।

• প্রচলিত কৃত্রিম হাঁটুর চাইতে টেকসই বলে দাবি। অ্যালার্জি হওয়ার সম্ভাবনা কম।

• না, বরং সব মিলিয়ে খরচ একটু কম।

• দক্ষিণ ভারত, মহারাষ্ট্রে প্রায় চারশো রোগীর এই হাঁটু প্রতিস্থাপন হয়েছে।
কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে সম্প্রতি কয়েকটি হয়েছে।

• কোনও ডাক্তার একেই ভোট দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, আর একটু দেখা যাক।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.