লিফট ওঠে, নামে, নিজে নিজেই
লকাতা নাকি ‘কলির শহর’! কেন? সে এক গল্প। ক্রোধ আর হিংসার ছেলে ‘কলি’। সেই কলির শখ হল, নিজের নামে একটা শহর তৈরি করবে। ‘অধর্ম’ আর ‘অনুতাপ’-এর সঙ্গে পরামর্শ করে কলি তৈরি করল শহর, আর শহর নিয়ন্ত্রণের কাতা (দড়ি) দিল ‘দ্বেষ’ আর ‘দম্ভ’র হাতে। কলির কাতা থেকে কলিকাতা, চলতি কথায় কলকাতা। গল্পটা কিন্তু বেশ।
কলকাতার আর এক নাম ‘প্রাসাদনগরী’। বিদেশি শাসকরা তো বটেই, দেশি জমিদার-ব্যবসায়ীরাও এই শহর জুড়ে তৈরি করেছিলেন বড় বড় সব অট্টালিকা। তা, প্রাসাদ থাকবে অথচ ভূত থাকবে না, তা কখনও হয়! তা ছাড়া দ্বেষ আর দম্ভর শাসনাধীন কলির শহরে জন্মলগ্ন থেকেই বহু মানুষের মর্মান্তিক অকালমৃত্যু হয়েছে। তাই, ‘বিশেষজ্ঞদের’ মত অনুসারে, সব মিলিয়ে শহর কলকাতার ভুতের সংখ্যা কম নয়।
তবে হ্যাঁ, ইদানীং কলকাতায় ভূতেদের দেখা খুব একটা পাওয়া যায় না। মনে হয়, এত আলোয় আর আওয়াজে ভূতেরা ঠিক সুবিধে করে উঠতে পারছে না। তাই চলুন, একটু ফিরে যাওয়া যাক পুরনো দিনে। দেখে নেওয়া যাক কয়েকটি বাড়িতে একটু উঁকি দিয়ে। বাড়িগুলি বিখ্যাত, কিংবা কুখ্যাত। কোনও বাড়ি এখনও আছে, কোনওটা নেই। কিন্তু ‘অতীত’ বলে তুচ্ছ করবেন না, ভূত মানেই তো অতীত। আর বাড়ি না-ই বা থাকল, নিরালম্ব বায়ুভূতের কী আসে যায়? তাই বলি কী, চিনে রাখুন, জেনে রাখুন।
প্রথম ঠিকানা: ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেস। মানে, পুরনো রেডিয়ো অফিস। সে বাড়ি এখন আর নেই। ১৯২৭ সালে ওই বাড়িতে খোলা হয় ‘ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’। সেটিই পরে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো’, ক্রমে ‘আকাশবাণী’। এই জায়গাটি আদিতে ছিল কলকাতার পুরনো এক কবরখানার অংশ। এখানকার জলহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে যে সমস্ত ইংরেজ কর্মচারী মারা যান তাঁদের অনেকের কবর ছিল সেখানে। এর ঠিক পাশেই রয়েছে সেন্ট জনস্ চার্চ ও কবরখানা, যেখানে রয়েছেন খোদ জোব চার্নক সহ অনেক নামীদামি সাহেব। অতএব বেতার কেন্দ্রের জন্ম থেকেই তার সঙ্গে জড়িয়ে গেল ভূতের গপ্প। প্রথম সাহেব ডিরেক্টর পি ওয়ালিক থেকে আরম্ভ করে কর্মী-প্রহরীরা সকলেই নাকি নানা সময়ে অনুভব করেছেন অশরীরী অস্তিত্ব! কেউ কেউ নাকি রাতে কবর থেকে উঠে আসা লোকজনকে রেডিয়ো আপিসের টেবিলে বসে কাজ করতে দেখেছেন বিভিন্ন সময়। শুধু রাতেই নয়, মহালয়ার ভোরে লাইভ ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে সে যুগের কোনও কোনও শিল্পী ভূতের দেখা পেয়েছেন, অন্তত তাঁরা আজও জোর গলায় সে কথা বলে থাকেন। হবে না-ই বা কেন? দিনটা যে ঘোর অমাবস্যা! আর, রেডিয়ো মানে তো বেতার, গোটা ব্যাপারটাই অশরীরী, ভেবে দেখলে ‘আকাশবাণী’ কথাটাও কিন্তু বেশ গা-ছমছমে।
পরের স্টপ ভারতীয় প্রদর্শশালা, মানে জাদুঘর, অর্থাৎ ইন্ডিয়ান মিউজিয়ম। চৌরঙ্গি রোড বা এখনকার জওহরলাল নেহরু রোডের বাড়িটি তৈরি হয় ১৮৭৫-৭৮ সালে। এখানে রয়েছে প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো এক মিশরীয় মানুষের মমি। আছে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের হাড়গোড় দিয়ে সাজানো গ্যালারি, প্রাণিবিদ্যার নানা নমুনাওয়ালা ‘জুঅলজি-গ্যালারি’। এত মৃত প্রাণী, আর ভূত থাকবে না? যে সমস্ত প্রহরী মিউজিয়মে রাত্রে ওই সব গ্যালারি পাহারা দিতেন, তাঁরা অনেকেই নাকি অশরীরী আত্মার দেখাসাক্ষাৎ পেতেন। আবার বহু কাল আগে, ‘জুঅলজি গ্যালারি’তে রং করবার সময়ে এক শ্রমিক ভারা থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান। প্রহরীদের অনেকেই নাকি সেই শ্রমিককে প্রায়ই দেখতে পেতেন সেখানে। মিউজিয়মের মূল বাড়ির পূর্ব দিকে এখনকার প্রশাসনিক ভবনে, প্রায় দুশো বছর আগে এক শিখ তরুণ মারা যান প্রহরীদের গুলিতে। এক কালে রাতের দিকে তাঁকেও দেখা যেত। ইদানীং আর শোনা যায়নি তাঁর কথা। হয়তো বয়সের ভারে হাঁটাচলা কমে গেছে। হয়তো কলকাতায় আর মন বসেনি।
ফিরে চলুন ডালহৌসির দিকে। ‘প্রত্যক্ষদর্শী’রা বলেন, ভূত আছে নাকি স্টিফেন হাউসে, এবং খাস রাইটার্স বিল্ডিংয়েও। ইংরেজদের পুরনো কেল্লাটি ছিল আজকের জি পি ও, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অঞ্চল জুড়ে। সেই কেল্লাতেই ‘অন্ধকূপ হত্যা’। সিরাজউদ্দৌল্লার কলকাতা আক্রমণের সময় তাঁর সেনাবাহিনি ১২৩ জন ইংরেজ সেনাকে একটা ছোট্ট ঘরে বন্ধ করে রেখে মেরে ফেলেছিল। পরে জানা যায়, এটা মিথ্যে গল্প। ইংরেজদের বানানো। কিন্তু গল্পের ভূত গাছ থেকে নামে না। জনমনে বিশ্বাস জন্মায়, কেল্লায় মৃত মানুষদের আত্মারাই নাকি এখনও মায়া ত্যাগ করতে পারেনি এলাকাটির। মাঝে মাঝে তারা পাশের রাইটার্স বিল্ডিংয়ে গিয়ে আমোদ-আহ্লাদ করে! স্টিফেন হাউসের পুরনো লিফটও নাকি রাতবিরেতে আপনা-আপনি ওঠানামা করে খানাপিনার পরে ওঁরা হয়তো তখন একটু টালমাটাল, সিঁড়ি ভাঙার ক্ষমতা নেই।
আলিপুরে চব্বিশ পরগনার কালেক্টরেট ভবনটি আমাদের খুব চেনা। গত শতকের বিশের দশকের কথা। ওই বাড়িতে তখন সস্ত্রীক থাকতেন তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট জেমস ডোনাল। সঙ্গে থাকতেন শ্রীমতী ডোনালের মা-ও। তিনি ভাল পিয়ানো বাজাতেন। জেমস ডোনাল বিলেতে বদলি হয়ে যাবার সময় পিয়ানোটি নিয়ে যেতে পারেননি বলে শ্রীমতী ডোনালের মা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। বিলেতে গিয়ে কিছু কাল পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। অতঃপর তাঁকে নাকি আলিপুরের ওই বাড়িতে দেখা গিয়েছিল বেশ কয়েক বার। এখনও নাকি কেউ কেউ রাতবিরেতে শুনতে পান পিয়ানোর সেই করুণ সুর!
কলকাতার সবচেয়ে নামজাদা ঐতিহাসিক ভূতের ঠিকানা সম্ভবত বেলভেডিয়ার হাউস, মানে আজকের জাতীয় গ্রন্থাগারের পুরনো বাড়িটি। এটি আগে ছিল লাটসাহেবের বাগান বাড়ি। এই বাড়ি নিয়ে অনেক গল্প, অনেক লোকশ্রুতি। যেমন, এর নীচ দিয়ে নাকি এক সুরঙ্গ আছে, যা চলে গেছে একেবারে গঙ্গা পর্যন্ত। তো, তিনশো বছরের পুরনো এই প্রাসাদের ফ্লোরে নাকি রাতবিরেতে বেজে ওঠে কনসার্টের সুর। গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস-এর সঙ্গে ডুয়েলে আহত ফিলিপ ফ্রান্সিসকে পালকি করে আনা হয়েছিল এই বাড়িতেই। এখনও কেউ কেউ নাকি গভীর রাতে শুনতে পান পালকিবাহকদের ‘হুম্না’। রাতে মাঠের প্রাচীন বট গাছের কাছে নাকি মাঝে মাঝেই দেখা যায় সাদা কাপড় পরা কাউকে! এখন বাড়িটি সারাই করা হচ্ছে। তার পরেও এ সব আর দেখা যাবে কি?
তবে এ সবই বাসী গল্প। এখন কলকাতায় টাটকা ভূত পাওয়া যাবে মেট্রো রেলের সুড়ঙ্গে। আত্মহত্যার সহজ উপায় পেয়ে বহু মানুষই সেখানে গলা দিয়েছেন। তাঁরা নাকি শেষ মেট্রো চলে যাওয়ার পরে সুড়ঙ্গপথ ধরে ঘোরাফেরা করেন। কোনও কোনও স্টেশনে আবার তাঁদের টানটা বেশি।
কলকাতা আসলে ‘ভূতের শহর’।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.