|
|
|
|
আমি এসেছি ও পার থেকে, তোমাকে সব বলব বলে |
সামনেই ভূতচতুর্দশী। ভূত কি মজার, না ভয়ের? ‘আমি ভূত কখনও চাক্ষুষ করিনি বটে, কিন্তু তাদের নৈকট্য,
তাদের উপস্থিতি, নির্ভুল ও সন্দেহাতীত অস্তিত্ব বেশ কয়েক বার টের পেয়েছি।’ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় |
বেশ কিছু কাল আগে মুম্বই থিয়োসফিকাল সোসাইটি থেকে এক জন আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন। তাতে বক্তব্য ছিল যে, তাঁরা সম্প্রতি প্ল্যানচেটে এক জন বিখ্যাত লোককে স্মরণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর বদলে এক জন তরুণ বাঙালি কবির আগমন ঘটেছিল। কবিটি কিছু কাল আগে মদ্যপ অবস্থায় জলে ডুবে মারা যান। সেই কবি তাঁদের জানিয়েছেন যে, তিনি লিখতে চান এবং সেটা মিডিয়ামের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয় বলে তাঁদের সাহায্যপ্রার্থী। সেই কবিই তাঁদের আমার নাম বলে জানিয়েছেন যে, আমি ছাড়া তাঁর মরণোত্তর অস্তিত্বের কথা আর কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই তাঁরা আমাকে ব্যাপারটা জানিয়ে মুম্বইতে গেলে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করার আমন্ত্রণ করছেন।
আমার মুশকিলটা এখানেই। আমি ভূতে বিশ্বাস করি, এটা রটনা হওয়ার পর যত্রতত্র আমাকে এই প্রশ্নটির সম্মুখীন হতে হয়, ‘সত্যিই আপনি ভূত দেখেছেন? তা হলে সেই গল্প বলুন।’
প্রকৃতপ্রস্তাবে আমি ভূত কখনও চাক্ষুষ করিনি বটে, কিন্তু তাদের নৈকট্য, তাদের উপস্থিতি, নির্ভুল ও সন্দেহাতীত অস্তিত্ব বেশ কয়েক বার টের পেয়েছি। তার মধ্যে এক মেমসাহেবের ভূত অন্তত চার-পাঁচ বছর আমাকে অনুসরণ করেছে সেই শৈশবে।
কিন্তু বলতে গেলেই আর এক বিপদ। সেটা হল, কিছু মানুষ সর্বদাই এই অনুভূতি বা বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে নানা ব্যাখ্যা দিতে থাকেন। আমাকে তাই প্রায়ই বলে নিতে হয়, আমার কাহিনি বিশ্বাস না করলে করার দরকারও নেই, কিন্তু দয়া করে ব্যাখ্যা-ট্যাখ্যা দেবেন না, ওটা নিষ্প্রয়োজন।
১৯৪৮ বা ১৯৪৯ সালে আমি এক বার নোয়াখালির কাছে মেহের কালীবাড়ির অদুরে এক গাঁয়ে ঘটনাচক্রে কয়েক দিন ছিলাম। মেহের কালীবাড়ি এক প্রাচীন এবং বিশ্রুত গ্রাম, বড় এক সাধকের সাধনপীঠ। মস্ত মস্ত বট আর অশ্বত্থ গাছের ভিড়, বাঁশবন, বিস্তর গাছপালা, জলাশয়ে আকীর্ণ গ্রামটায় ঢুকলে দিনের বেলাতেই গা ছমছম করে। সন্ধেবেলা এক তান্ত্রিকের বাড়িতে বসে আছি, হঠাৎ বাইরে এক মেয়েলি গলার আর্ত চিৎকার আর দড়াম করে আছড়ে পড়ার শব্দ। পাশের বাড়ির অল্পবয়সী বউটি ঘাটলায় গিয়ে ভূত দেখে ভয় পেয়ে মূর্ছা গেছে। ভূত দেখা আর ভুল দেখার মধ্যে পার্থক্য কমই, আর এ-ও সত্যি কথা যে ভূত দেখার চেয়ে ভুল দেখার সংখ্যাই বেশি। আর কে না জানে যে ভয়ই হল আসল ভূত।
|
|
সত্যজিৎ রায়ের ‘মণিহারা’ ছবির একটি দৃশ্য। |
তা বলে ভূতকে উড়িয়ে দেওয়াটাও কোনও কাজের কথা নয়। মেহের কালীবাড়ির সেই বউটি পুকুরঘাটে যাকে দেখেছিল তা ভুল না ভূত, তা নিয়ে কত যে কথার অবতারণা হয়েছিল, বলার নয়।
আজ অবধি যাঁরা ভূত দেখেছেন তাঁরা অধিকাংশই দেখেছেন পোশাক পরা ভূত। ওইখানেই আমার একটু সংশয়। ভূতের পরনে পোশাক থাকার কথাই নয়। যে শরীর ছেড়েছে সে পোশাক পরবে কেন? আর পোশাক আসবেই বা কোথা থেকে? তবু জোর দিয়ে আমি কিছুই বলতে চাই না। আমার অধীত বিদ্যা বা জ্ঞানগম্যির যা অতীত তা নিয়ে কথা বাড়াই কী করে?
সাড়া দেওয়া আর সাড়া পাওয়াই হচ্ছে অস্তিত্বের সর্বাপেক্ষা গুরুতর লক্ষণ। যদি সাড়া না পাই বা না দিই তা হলে কিছু কাল পরে নিজের অস্তিত্ব বিষয়েই আমার সংশয় দেখা দেবে। সাড়াপ্রবণতা তাই বেঁচে থাকার সবচেয়ে ধ্রুপদী লক্ষণ। পুণেয় এক দ্বিপ্রহরে হা-ক্লান্ত হয়ে হাজির হওয়ার পর যে হোটেলে আমার আশ্রয় জুটেছিল তা কালপ্রাচীন এবং জনশূন্য। দোতলার একটি একলা ঘরে দুপুরবেলাতেই যা শুরু হয়েছিল তা কহতব্য নয়। সেই ঘরে যে ছিল তার অবয়ব আমাকে দেখায়নি ঠিকই, কিন্তু নানা ভাবে সে জানান দিচ্ছিল যে সে প্রবল ভাবে সেই ঘরে উপস্থিত এবং আমার অনুপ্রবেশ তাকে কোনও কারণে উত্তেজিত করেছে। ওয়ার্ডরোবের দরজা বার বার খুলে দিয়ে, বাথরুমের দরজায় প্রবল ধাক্কার পর ধাক্কা দিয়ে সে কিছু একটা বলতে চাইছে। ভয়ের চেয়ে আমার অসহায় লেগেছিল বেশি। আমি ওয়ার্ডরোব এবং বাথরুমের দরজা খুলে শূন্যতার দিকে চেয়েই ইংরেজিতে বার বার বলছিলাম, তোমার যদি কিছু
বলার থাকে তা হলে বলো, আমি শুনবার জন্য প্রস্তুত।
আমরা কুকুরের ভাষা জানি না, পাখির কথা বুঝতে পারি না, কিন্তু তারাও কিছু বলে। যেমন বাতাস বলে, গাছপালা বলে, হয়তো পাথরেরও বক্তব্য আছে। কিন্তু সেই সূক্ষ্ম মেধার অভাবে কত বোধগম্যতা আমাদের নাগালের বাইরে। পুণের এই লোকটিও বোধহয় কিছু বলতে চেয়েছিল আমাকে। শোনার কান, বোঝার মতো মগজ নেই বলে শোনা বা বোঝা হল না।
যাদবপুরের যে মেয়েটি আত্মহত্যার পর পরই তার অস্তিত্বকে সরবে এবং সরোষে জানান দিয়েছিল সে আমাদেরই বাড়িওলার মেয়ে, আমারও বিশেষ স্নেহের পাত্রী ছিল। তার ঘোষণাটা এতই জোরালো ছিল যে আমরা পরিবারের সবাই এবং বাড়িওলা পর্যন্ত প্রতি দিন তার সঞ্চার টের পেতাম। সংশয় বা সন্দেহের অবকাশ ছিল না, এবং যা ঘটে তাকে অস্বীকার করা যায় কী করে?
কিন্তু কী বলতে চেয়েছিল সে? তার সেই ধূসর অন্য জগতের কথা? জ্বালাপোড়ার কথা? তবে সে প্রমাণ করে দিয়েছিল, শরীরের পরও কিছু থাকে, খুব জোরালো ভাবেই থাকে।
আমাদের চার দিকে থিকথিক করছে মায়া। ভারী, চটচটে, মদির এই মায়া, এই ব্যক্ত জগতের আলোকিত উদ্ভাস, জীবনের নানা টানাপড়েন সত্ত্বেও প্রবল কেন্দ্রাভিগ টানে বেঁধে রাখে আমাদের, মাধ্যাকর্ষণের মতো। আর গলিত, অথর্ব, মুমূর্ষু একটি ব্যাঙও কয়েক মুহূর্তের আয়ু ভিক্ষা করে। মৃত্যু ও জীবনের মধ্যবর্তী দরজাটি আজও উন্মোচিত হল না। ও পারে কী আছে কেউ জানে না আজও, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে জন্মানো ও মরে যাওয়ার পরও।
‘ওই বন্ধ দ্বারে ব্যাকুল কর হানি বারে বারে...’ কিছু জানতে চাই। আহা, কেউ যদি এসে অমনি বলত, ‘আই অ্যাম ল্যাজারাস, কাম ফ্রম দ্য ডেড, কাম টু টেল ইউ অল, আই শ্যাল টেল ইউ অল।’ |
|
|
|
|
|