স্মরণ
উদাসীন আভিজাত্য

আক্রমণাত্মক ব্যাটিং ফিরিয়ে এনেছিলেন
মৃত্যুর পর থেকেই পটৌডিকে শ্রদ্ধা জানানোর ঢেউ উঠেছে। যত দূর জানি, তিনি এ সব প্রশস্তিতে সায় দিতেন না। আর ক্রিকেট প্রশাসকদের মুখে এত প্রশংসা শুনলে নির্ঘাত সিঁটিয়ে যেতেন। সারা জীবন ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসকদের ঘেন্না করে এসেছেন। এমনি এমনি নয়। এর পিছনে একটা বড় কারণ ছিল।
পটৌডি যখন খেলা শুরু করেছিলেন, তাঁকে ক্রিকেট দুনিয়ায় তথাকথিত বহিরাগত মনে করা হত। রাজপরিবার থেকে এসেছিলেন বলেই হয়তো তাঁর সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেটের এই দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। অথচ যখন ডিফেনসিভ ক্রিকেট খুব চলতি একটা ব্যাপার ছিল তখন পটৌডিই লফটেড ড্রাইভ খেলে প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটে। সি কে নাইডু আর মুস্তাক আলির সেই ৩০-৪০’এর দশকের আক্রমণাত্মক ঘরানার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন তিনি। মার্চেন্ট, আর হাজারেদের জমানায় তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার যিনি ক্রিকেটের রক্ষণশীল ধারাবাহিকতা ভেঙে ভারতীয় ক্রিকেটের নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন।

আপনি লিখতেই পারেন, কিন্তু এ সব কথা যেন আনন্দবাজার সংস্থার কোনও পত্রপত্রিকায় ছাপা না হয়
পটৌডি সঙ্গে প্রথম দেখা চেন্নাই প্রেস বক্সে। সালটা বোধহয় ১৯৭৮। রাজন বালা (হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডের ক্রীড়া সম্পাদক, পটৌডির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু) তাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি সদ্য স্পোর্টসওয়ার্ল্ডের সম্পাদক হয়েছেন। আমার প্রথম সম্পাদক। রাজন আমাকে পটৌডির কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, “প্যাট দিজ ইজ ইওর রাজু।” পটৌডি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ঊর্বর মস্তিষ্ক।” এত গম্ভীর ভাবে কথাটা বললেন যে আমি বুঝতেই পারলাম না সেটা প্রশংসা না পরিহাস। সাধারণ নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর সাংবাদিকেরা যখন জিজ্ঞেস করেছিল হেরে গেলেন কেন, পটৌডির উত্তর ছিল, “অন্য লোকটা বেশি ভোট পেল বলে।” এমনই অদ্ভুত সেন্স অফ হিউমার ছিল ওঁর। মনসুর আলি খান পটৌডি আমার লেখা পছন্দ করেন জেনে আমার মাথায় ওঁর বাবা আর ওঁকে নিয়ে একটা তুলনামূলক লেখার ভাবনা এল। ওঁর বাবা ইফতিকার আলি খান তাঁর জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হয়েছিলেন আর টাইগার পটৌডি মাত্র ২১ বছর বয়সে। লেখার আইডিয়াটা শুনে ছেলে বললেন, “সে লেখো। কিন্তু কথা দিতে হবে এ লেখা আনন্দবাজার সংস্থার কোনও কাগজ বা পত্রিকায় বেরোবে না।” প্রচারের আলোয় থাকা পছন্দ করতেন না একদম।
সত্যজিৎ রায় শর্মিলা আর টাইগারকে ‘অপুর সংসার’-এর একটা রিল উপহার দিয়েছিলেন
চেন্নাইয়ের সেই প্রেস বক্সে দেখা হওয়ার আগে থেকেই আমি আমার দাদা দেব মুখোপাধ্যায়ের কাছে ওঁর কথা শুনেছিলাম। উনি পটৌডির অধিনায়কত্বে ভিএসটিসি টিমে খেলেছিলেন মইনউদ্দুলা ট্রফিতে। পটৌডি দাদার ফিল্ডিং পছন্দ করতেন। এমনও হয়েছে নিজের প্রিয় কভার পজিশন দাদাকে ছেড়ে দিয়েছেন। আর নিজে ফিল্ডিং করেছেন মিড-উইকেটে।
পটৌডি-শর্মিলা রোমান্সে দাদার একটা ভূমিকা ছিল। দাদার হাত দিয়ে এক বার শর্মিলাকে ফুল পাঠিয়েছিলেন পটৌডি। দাদা ফুলটা শর্মিলার কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন নিউ মার্কেটের এক ফ্লোরিস্টের মাধ্যমে। কিন্তু শর্মিলা ঠিকঠাক সেটা পেয়েছেন কি না জানতে নিজেই চলে গিয়েছিলেন তাঁর কলকাতার ঠিকানায়। দাদার মনে আছে, শর্মিলা বলেছিলেন, এক তোড়া ফুল নয়। এক লরি ফুল পাঠিয়েছেন পটৌডি!
অম্বর রায়, সুব্রত গুহ আর দাদা ওঁদের বিয়েতেও নিমন্ত্রিত ছিলেন। নিমন্ত্রিত ছিলেন সত্যজিৎ রায়ও। নবদম্পতিকে তিনি উপহার দিয়েছিলেন ‘অপুর সংসার’ ছবির একটা রিল। দাদা আজও দুঃখ করেন সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের ছবি তুলে রাখেননি বলে।

দক্ষিণ ভারতীয় ক্রিকেটারদের সঙ্গে বেশি একাত্ম বোধ করতেন
ইংল্যান্ডে ওঁর প্রচুর ভক্ত ছিল! ১৯৭৭ সাল। ইয়র্কশায়ারে লিগ ক্রিকেটে খেলতে গিয়েছি। আমাদের যে ওখানে বিশেষ চোখে দেখা হচ্ছিল সেটা আসলে পটৌডির প্রতি ওঁদের শ্রদ্ধা থেকেই। ভারতীয় ক্রিকেট সম্বন্ধে বিদেশে সার্বিক শ্রদ্ধা জাগিয়েছিলেন উনি। সমস্ত রকম প্রাদেশিকতা আর সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ছিলেন বলেই বোধহয় সকলে ওঁকে এতটা পছন্দ করতেন। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে কখনও ক্রিকেটের মধ্যে আনতেন না। জয়সিমা আর হনুমন্ত সিংহ অন্তরঙ্গ বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও ওঁদের নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনও একচোখামি দেখিনি। বিশ্বনাথকে তো নিজের ছেলের মতো ভালবাসতেন। মনে হয় দক্ষিণ ভারতীয় খেলোয়াড়দের অনেক বেশি বন্ধু ছিলেন টাইগার। শাণিত মস্তিষ্কের মানুষ ছিলেন। তাই হয়তো দক্ষিণ ভারতীয় খেলোয়াড়দের তীক্ষ্মতা ভাল লাগত। অথচ এমনই ওঁর জনপ্রিয়তা ছিল যে নর্থ জোন বনাম সাউথ জোনের একটা ম্যাচে দুই দলই ওঁকে খেলোয়াড় হিসেবে দলে চেয়েছিল। কিন্তু পটৌডি উত্তরাঞ্চলের অধিনায়ককে বলেছিলেন তিনি জয়সিমার দলে অর্থাৎ দক্ষিণাঞ্চলের হয়ে খেলতে চান।

১১ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়তে পারতেন
গড়িমসি করতে দারুণ পছন্দ করতেন। নবাবি কায়দা একদম! আবার শুনেছি বাড়িতে খুব সাধারণ লুঙ্গি আর কুর্তা পরেও থাকতেন। কিংবা খুব ফর্মাল মিটিংয়েও খুব সহজে শার্টের হাতা গুটিয়ে বসতেন। জিন্সের সঙ্গে কোলাপুরি চটি পরতে পছন্দ করতেন। তিনিই হয়তো প্রথম মানুষ যিনি এই রকম একটা কম্বিনেশনকে মানে উদাসীনতা আর আভিজাত্যকে এতটা ফ্যাশনেবল করেছিলেন।
এই যে ওঁর উদাসীন আভিজাত্য সেটা কেবল দেখা যেত যখন তিনি মাঠের বাইরে। মাঠের ভেতরে তিনি অন্য মানুষ। পাক্কা প্রোফেশনাল। এক সেনাপ্রধানের কাছে শুনেছিলাম পটৌডি ছিলেন দুর্দান্ত অ্যাথলিট। সেই সেনাপ্রধানই বলেছিলেন, উনি ১১ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়তে পারতেন। শুনে আমি থ। এর থেকে একটা কথাই বোঝা যায় কতটা ‘ফিট’ ছিলেন। জানি না আজকের দিনে ক’জন ক্রিকেটার এটা করতে পারবেন।

আমার জীবনে ওঁর প্রভাবটা অদ্ভুত
আজ চলে যাওয়ার পর সংবাদমাধ্যমগুলোয় পটৌডিকে নিয়ে হইচইয়ের অন্ত নেই। অথচ তিনি বেঁচে থাকতে তাঁকে কোনও দিন সংবাদমাধ্যম সে ভাবে জায়গা দেয়নি। একটা সময় তিনি নিজেকে ক্রিকেট থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। ওঁর জীবনের এই সময়টায় আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অভীক সরকারের ভূমিকার প্রশংসা না করে পারছি না। পটৌডি খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর কোনও মিডিয়া হাউসই তাঁর সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেন না। সে দিন একমাত্র অভীকবাবুর উদ্যমেই টাইগারকে ক্রিকেট খবরের দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড-এ লিখতেন। পরে স্পোটর্স ওয়ার্ল্ড-এর সম্পাদকও হন।
একটা ছোট্ট গল্প দিয়ে শেষ করি। আইসিসি-র ম্যাচ রেফারি হয়েছি। বোর্ডের সিইও প্রোফেসর শেট্টি বললেন, “কত বড় দায়িত্ব বুঝতে পারছ তো?” আমি বলেছিলাম, পারছি। কেন না আইসিসি-র প্রথম ভারতীয় ম্যাচ রেফারি ছিলেন পটৌডি। আমার প্রথম বস-ও। আমার জীবনের শুরু ও শেষে ওঁর এই জড়িয়ে থাকাটা বড় অদ্ভুত!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.