|
|
|
|
|
মাসমাইনে পাঁচ টাকা
সেই সঙ্গে বছরে ছ’খানা ধুতি ফ্রি। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পুরোহিত রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য।
সে যুগের নিরিখে যা ছিল বাজারছাড়া মাইনে। কেন? উত্তর খুঁজলেন শংকর |
|
এখনও দু’শো বছর হয়নি, তবু রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর মন্দির কেন ভক্তজনের হৃদয়ে এই ভাবে বিশেষ স্থান অধিকার করে বসল এবং কেন এই মন্দির-মহিমা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে, তা খোঁজ করা সহজ কাজ নয়। এই মন্দিরের ইউএসপি কী তা নিয়ে নানা মহলে নানা মতামত। অনুসন্ধানীদের কাছে যে কারণটি শেষ পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হল, মন্দিরময় ভারতে এত দিন কেবল প্রতিষ্ঠিত দেবতা অথবা দেবীরই আধিপত্য এবং জয়ধ্বনি। কিন্তু গঙ্গাতীরের দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে এক পাগল পুরোহিতও জগন্মাতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভক্তজনের হৃদয়ে এমন একটি স্পেশ্যাল স্থান অধিকার করে বসলেন, যা আগে কোথাও হয়েছে বলে কেউ শোনেনি। এই একমাত্র জায়গা যেখানে পাঁচ টাকা মাইনের পুরোহিতও দেবতার আসনটি অধিকার করে বসলেন।
মাইনে দিয়ে মানুষের মাপ করার রীতি এ দেশে অনেক কাল থেকে চলেছে, তাই ঠাকুরের মাইনের পরিমাণটা অনেককে দ্বিধায় ফেলে দেয়। কেউ যখন শোনে সত্যিই মাসিক স্যালারি ফাইভ রুপিজ তখন একটু অস্বস্তি হয়, একটু খোঁজখবর একটু বিশ্লেষণ পাওয়ার জন্য অনেকে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।
ঠাকুরের মাইনের পরিমাণ, তাঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এ সব কোথায় লুকিয়ে আছে কে জানে? যা জানি, তা সবিনয় নিবেদন করছি।
কথামৃত রচয়িতা মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত তাঁর কথামৃতের শুরুতে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনকথা সংক্ষেপে বলতে গিয়ে একটি বিস্তারিত ফুটনোটের অবতারণা করেছেন এবং সেখানেই তিনি হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন। ১৮৫৮ সালে রানি রাসমণির বরাদ্দের তালিকা অনুযায়ী আমাদের ঠাকুর ওরফে ‘রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য’ মাইনে পাচ্ছেন মাসিক পাঁচ টাকা। তাঁর ভাগ্নে ‘পরিচারক’ হৃদয় মুখার্জির বেতন সাড়ে তিন টাকা। এঁর বাড়তি দায়িত্ব ছিল ফুল তোলার। এ ছাড়া বরাদ্দ তিন জোড়া কাপড়, যার মূল্য সাড়ে চার টাকা। সেই সঙ্গে প্রতিদিনের খোরাকি হিসেবে সিদ্ধ চাল, ডাল, তামাক, কাঠ ও দু’খানা পাতা।
এত বড় ধনবতীর মন্দিরে পুরুতের মাইনে ‘মাত্র’ পাঁচ টাকা দেখে যাঁরা ইদানীং নাক বেঁকান, তাঁদের অবগতির জন্য জানাই, সে কালে ভুবনবিদিত বেঙ্গল ব্যাঙ্কের কেরানিরাও এর থেকে বেশি মাইনে পেতেন না। ‘দখিনশোর’-এর তৎকালীন শ্রীশ্রীরাধাকান্তজির পুরোহিত তো সেই সঙ্গে পেয়েছিলেন বিনামূল্যে বাসস্থান! পরে কাশীপুর পর্বে লীলাপ্রসঙ্গে ঠাকুর নিজেই বলছেন, রানির আমলেই তাঁর মাইনে দাঁড়ায় সাত টাকা। পরে তা মাসিক পেনশনে দাঁড়ায়, যাকে ঠাকুর ‘পেন্সিল’ বলতেন, সেই সঙ্গে অবশ্যই দেবতার প্রসাদ।
প্রথম পর্বে শ্রীশ্রীকালীর পূজক ছিলেন ঠাকুরের খুড়তুতো ভাই হলধারী অর্থাৎ রামতারক। কথামৃতকারের সংযোজন: বলিদান হয় বলিয়া পরের বছর দায়িত্ব বদলাবদলি, হলধর (রামতারক ভট্টাচার্য) রাধাকান্তের সেবায় এবং শ্রীরামকৃষ্ণ কালীঘরে। বলা বাহুল্য, এই সময়েই (১৮৫৯) তাঁর বিবাহ। পাত্রীর আদি নাম ক্ষেমঙ্করী, পরে পারিবারিক কারণে নাম পরিবর্তন করে সারদামণি (কথামৃতকার শুরুতেই এই সম্পর্কটিকে ‘নামমাত্র’ বিবাহ বলেছেন!)
পুরোহিতের এই বাজারছাড়া বাড়তি মাইনের কারণ অনুসন্ধান করাটা অন্যায় হবে না। তখন তো পুরুত নির্বাচনে ‘মেরিটের’ তেমন কোনও ভূমিকা ছিল না। কারণটা জানা থাকলে দক্ষিণেশ্বর এবং সে যুগের জাতবিচার-সমস্যাটা বুঝতে সহজ হয়।
রানি রাসমণি নিষ্ঠাবতী কিন্তু তিনি শূদ্র বংশের মেয়ে ও বধূ। মন্দির তৈরির কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই তিনি শাস্ত্রীয় মতে ত্রিসন্ধ্যা স্নান, হবিষ্যান্ন ভোজন, মাটিতে শয়ন ও যথাশক্তি জপপূজাদি করতেন। যত শীঘ্র দেবীপ্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যখন ব্যাকুল, তখন বাংলার ব্রাহ্মণ সমাজের একাংশ বাগড়া তুললেন, শূদ্রের মন্দির প্রতিষ্ঠার কোনও অধিকার নেই। সেই সঙ্গে হুঁশিয়ারি: প্রথার বিরুদ্ধে কাজ করলে ব্রাহ্মণ সজ্জনেরা নতুন দেবালয়ে উপস্থিত হয়ে প্রসাদ গ্রহণ করবেন না। এ দিকে শ্রীশ্রীজগদম্বাকে নিত্য অন্নভোগ দেওয়ার জন্য রানি ব্যাকুল। দূত পাঠিয়ে নানা জায়গা থেকে তিনি পণ্ডিতদের ব্যবস্থা আনালেন, কিন্তু কেউই তাঁকে তেমন উৎসাহ দিলেন না।
এই সময় গদাধরের দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় ঝামাপুকুরে টোল খুলেছেন, ছোট ভাইকে কলকাতায় আনিয়েছেন এবং তিনি দিগম্বর মিত্র প্রমুখ কয়েক জন বিশিষ্ট অব্রাহ্মণের বাড়িতে নিত্যপূজা করছেন। এই রামকুমার বিধান দিলেন, রানির মন্দির প্রতিষ্ঠার অধিকার আছে। |
|
ভাল কাজে প্রাথমিক বাধা দেওয়ার ব্যাপারে সর্বযুগেই বাঙালিরা যে বিশেষ ভাবে অভ্যস্ত, তার আর একটি প্রমাণ এই দক্ষিণেশ্বর মন্দির-উদ্বোধন। শোনা যায়, নিমন্ত্রণের চিঠি পেয়ে রামকৃষ্ণের দাদা রানির প্রতিনিধিদের বলেন, কৈবর্তজাতীয়ার নিমন্ত্রণ ও দান গ্রহণ করলে তাঁকে ‘একঘরে’ হতে হবে।
রানি কিন্তু কৈবর্ত নন, মাহিষ্য সম্প্রদায়ের। শেষ পর্যন্ত রানির বিশ্বস্ত ও সুদক্ষ কর্মীদের হস্তক্ষেপে সমস্যার সাময়িক সমাধান হয় এবং রামকুমার তাঁর ভাইকে নিয়ে প্রতিষ্ঠাদিবসের এক দিন আগে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হন। রানির উদ্যোক্তারা আগেই বোঝেন পূজক পেতে অসুবিধা হতে পারে, তাই তাঁরা বাজারদরের থেকে সামান্য বেশি মাইনে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। দক্ষিণেশ্বরে ঠিক কী হয়েছিল তা নিয়ে ভাইপো রামলাল এবং ভাগ্নে হৃদয়রামের কিছু পরস্পরবিরোধী বিবরণ আছে। মোদ্দা কথাটা হল, উদ্যোক্তাদের সনির্বন্ধ অনুরোধে দাদা রামকুমার এক সময় পূজকের পদ গ্রহণ করতে রাজি হয়ে যান। দাদার সঙ্গে আমাদের ঠাকুরও সম্ভবত প্রতিষ্ঠার দিনে নয়, তার আগের দিনে দক্ষিণেশ্বরে আসেন। দাদা হৃষ্টচিত্তে দক্ষিণেশ্বরের প্রসাদী নৈবেদ্যান্ন গ্রহণ করলেও ভ্রাতা গদাধর স্থানীয় বাজার থেকে এক পয়সার মুড়ি-মুড়কি কিনে খেয়ে, ঝামাপুকুরে ফিরে আসেন। ঠাকুরের শ্রীমুখ থেকে শুনে লীলাপ্রসঙ্গের লেখক স্বামী সারদানন্দ আরও জানিয়েছেন, দক্ষিণেশ্বরের পরিবর্তে প্রথমে বালি-উত্তরপাড়ায় মন্দিরের জমি নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় জমিদাররা জানান, তাঁরা অন্য জমিদারকে গঙ্গায় ঘাট তৈরি করতে দেবেন না।
বাইরে খাওয়াদাওয়া এবং নিয়মকানুনের ব্যাপারে রামকৃষ্ণ যে তাঁর থেকে ৩১ বছরের বড় দাদা রামকুমারের থেকে বেশি সাবধানী ছিলেন, তার বর্ণনা নানা জায়গায় রয়েছে। সতেরো বছর বয়সে দাদাকে সাহায্য করতে তিনি ঝামাপুকুরে এলেন। দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে তাঁর বয়স ১৯ বছর। প্রতিষ্ঠার পরদিন সকালে নিষ্ঠাবান রামকৃষ্ণ আবার দক্ষিণেশ্বরে আসেন, কিন্তু দাদার পরামর্শে কান না দিয়ে ভোজনকালে আবার ঝামাপুকুরে ফিরে যান। এক সপ্তাহ পরে আবার এসে তিনি জানতে পারেন, রানির ‘সনির্বন্ধ অনুরোধে’ দাদা রামকুমার স্থায়ী ভাবে জগদম্বার পূজকের দায়িত্ব নিয়েছেন। এ বারেও দাদার অনুরোধ সত্ত্বেও পূজাবাড়ির প্রসাদ নিলেন না। তখন রামকুমার বললেন, “সিধা নিয়ে পঞ্চবটীতলে গঙ্গাগর্ভে নিজের হাতে রান্না করে খাও।” এই ভাবে আমাদের শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুকাল স্বপাকে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন।
প্রায় এক মাস এই ভাবে রান্না চলে বলে আমাদের অনুমান। এই সময় ১৬ বছরের ভাগ্নে হৃদয় দক্ষিণেশ্বরে হাজির হয়, ঠাকুর তখন সবে বিশ বছরে পা দিয়েছেন। হৃদয়ের বিস্তারিত রিপোর্ট অনুযায়ী, শ্রীরামকৃষ্ণ দুপুরে পঞ্চবটীতে পাক করলেও রাত্রে প্রসাদী লুচি খেতেন এবং জগদম্বাকে বলতেন, “মা, আমাকে কৈবতের্র অন্ন খাওয়ালি।” লীলাপ্রসঙ্গের মতে, এক সময় গরিব কাঙালরাও দক্ষিণেশ্বরে খেতে আগ্রহী ছিল না এবং খাওয়ার লোক না জোটায় প্রসাদী অন্ন গরুকে দেওয়া হত বা গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হত।
চাকরিতে ঠাকুরের আগ্রহ ছিল না। তা ছাড়া ওই হাঙ্গামায় ঢুকলে দেবীর অলঙ্কারাদির জন্য দায়ী থাকতে হবে। তাই রানির জামাই মথুরবাবু যখন প্রথম কাজের প্রস্তাব দিলেন, রামকৃষ্ণ তখন নিজের ভয়ের কথা বললেন। কিন্তু মথুরবাবু শুনলেন না, তাঁকে কালীমন্দিরের ‘বেশকারী’ এবং ভাগ্নে হৃদয়কে দুই ভাইয়ের সাহায্যকারী হিসেবে নিযুক্ত করলেন।
রামকুমারের শরীর ভাল না যাওয়ায় মথুরবাবু তাঁকে বিষ্ণুঘরের পূজার দায়িত্ব দিলেন এবং কালীঘরে ঠাকুরপূজক রূপে আমরা রামকৃষ্ণকে পেলাম। এর কিছু পরেই রামকুমারের আকস্মিক দেহাবসান।
দাদার মৃত্যুর পরে পূজক রামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক বিকাশ, মন্ত্রপাঠ ছাড়াও সঙ্গীতে ছিল তাঁর গভীর নির্ভরতা এবং সেই বিখ্যাত উক্তি“মা, রামপ্রসাদকে দেখা দিয়েছিস, আমায় কেন তবে দেখা দিবি না? আমি ধন, জন, ভোগসুখ কিছুই চাই না, আমায় দেখা দে।” মথুরবাবু এক সময়ে ঠাকুরের পুজো দেখে শাশুড়িকে বললেন, “অদ্ভুত পূজক পাওয়া গিয়েছে, দেবী বোধহয় শীঘ্রই জাগ্রতা হয়ে উঠবেন।”
পূজক রামকৃষ্ণের এই ছবি ভক্তজনের হৃদয়ে আজও জীবন্ত। ‘মা মা’ করতে করতে অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। মামা বায়ুরোগগ্রস্ত হয়েছেন ভেবে ভাগ্নে হৃদয় ভূকৈলাসের রাজবাটিতে নিযুক্ত এক বৈদ্যের শরণাপন্ন হলেন এবং রোগীর তেমন কোনও উন্নতি না দেখে কামারপুকুরে খবর পাঠালেন।
১৮৬০ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ কামারপুকুর থেকে আবার দক্ষিণেশ্বরে ফিরে এলেন এবং আবার বিরাট এক ‘আধ্যাত্মিক ঝড়ের’ মধ্যে পড়লেন। স্ত্রী, ঘর, সংসার, দেহ পরিবেষ্টনসব ভুলে গেলেন। তাঁর নিজের কথায়, “হুঁশ নাই। কাপড় পড়ে যাচ্ছে, তা পৈতে থাকবে কেমনে?...একদিন বকুলতলায় দেখলুম নীল বসন পরে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বেশ্যা।” কিন্তু সাধক দেখলেন, সাক্ষাৎ সীতা লঙ্কা থেকে উদ্ধার হয়ে রামের কাছে যাচ্ছেন।
ঠাকুরের দক্ষিণেশ্বরের দিনগুলির বিবরণ লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যায়। এ সব বিবরণ ভক্তরা অনেকে মুখস্থ বলে যেতে পারেন। দু’একটি নমুনা: ঠাকুরের চামড়া অত্যন্ত কোমল ছিল। তাই ক্ষুর দিয়ে দাড়ি কামানো যেত না। নাপিত তাঁর দাড়ি ছেঁটে দিত। সোমবারে তিনি চুল ছাঁটতেন। স্বামী শিবানন্দ জানিয়েছেন, তাঁর হাত এতই নরম ছিল যে কড়া লুচি ছিঁড়তে গিয়ে হাত কেটে গিয়েছিল। কিন্তু তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন না, দক্ষিণেশ্বরে তিনি নিজেই লুচি ভাজতে নেমে পড়েছেন এমন বিবরণ রয়েছে।
ভাগ্নে হৃদয় খুব সেবা করতেন। তবু তাঁর ওপর রেগে যেতেন, যা-তা গালাগালি করতেন“সে সব মুখে আনা যায় না।” আত্মরক্ষায় হৃদয় বলত, “আঃ কি কর মামা, ও সব কি বলতে আছে, আমি যে তোমার ভাগনা।” ঠাকুর সামনে যা পেতেন ঝাঁটা-জুতো, অমনি সপাসপ লাগিয়ে দিতেন।...পরক্ষণেই আবার দুজনে বেজায় ভালবাসা, কথা, ইয়ারকি। ভাইপো রামলাল জানিয়ে গিয়েছেন, ঠাকুর এমন রঙ্গরস রহস্য করতেন যে, নাড়িবেদনা হত। ভক্তদের বলতেন, “হ্যাঁগা, আমি এসব জানি, শুনেছি, দেখেছি, তাই বলছি।”
কলকাতার মানুষদের সম্বন্ধে তাঁর বহু মন্তব্য আজও খেটে যায়। তিনি বলতেন, “কলকাতার লোকের ভক্তি করতেও যেমন, অভক্তি করতেও যেমন। আমায় কেউ কেউ বলে, বাবুর লালপেড়ে কাপড় পরা, পায়ে কালো বার্ণিশ চটি জুতো, তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বসা, এসব না হলে চলে না। গঙ্গার জল সকালে দেখলুম বেশ ভরপুর রয়েছে, আবার দেখি, না কমে গেছে। এসব লোকদেরও কিরকম জানিস, ঠিক জোয়ার ভাটার মতন। কত শালা কত কি বলে, ও শালাদের ভাল কথায় মুতেদি, আর মন্দ কথায় মুতেদি।”
দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নৃত্যগীতে আকর্ষণ নিয়ে মস্ত বড় একটা বই হয়ে যায়। কোন গান কখন গাইতেন, কখন শুনতেন, এক এক গানে কেন এক এক রকম ‘রিঅ্যাকশন’এ সব নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। ভাইপো রামলালকে একবার গাইতে বললেন, একঘর লোক দেখে রামলালের তো লজ্জা। ঠাকুরের ব্রেক ফেল করল, “শালা লজ্জা করচিস! ঘৃণা, লজ্জা, ভয় তিন থাকতে নয়।”
গান গাইবার শ্রেষ্ঠ ফলাফলের জন্য তাঁর পরামর্শ: “যখন যে কোন দেবদেবীর গান গাইবি, আগে তাঁকে চোখের সামনে দাঁড় করাবি, তাঁকে শুনাচ্ছিস মনে করে তন্ময় হয়ে গাইবি। লোককে শুনাচ্ছিস কখনো ভাববি না, তাহলে লজ্জা আসবেনি।”
নাচার ব্যাপারেও দক্ষিণেশ্বরে বেজায় আগ্রহমুড এলে কোমর বেঁকিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ ঘুরে ফিরে নাচতেন। কৌতূহলীরা প্লিজ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত ও শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ বই দু’টি হাতের গোড়ায় রাখুন, সময়ে অসময়ে আনন্দ পাবেন। বুঝবেন স্বরলিপির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে চিবিয়ে চিবিয়ে গাওয়া আর প্রাণ খুলে গান গাওয়ার মধ্যে তফাত কোথায়! দক্ষিণেশ্বরের পূজারি ভক্তিতে ভেসে যাচ্ছেন, কিন্তু অপচয় দেখলেই প্রবল বিরক্তি ও বাধা। সকালে নিজেই দাঁতন সংগ্রহে বেরুতেন। একদিন অন্য এক জনকে বললেন। সে একাধিক ডাল ভেঙে আনায় বিরক্ত ঠাকুর বললেন, “শালা তোকে একটা আনতে বললুম, তুই এতো আনলি কেন? যা হোগ রেখে দে।” পরের দিন লোকটি আবার দাঁতনের জন্য ডাল ভাঙতে যাচ্ছে দেখে ঠাকুর মনে করিয়ে দিলেন, আগের দিনের ডাল রয়েছে। তার পর প্রবল বকুনি: “না দেখে অমনি ছুটে আনতে যাচ্ছিস যে? ও গাছ কি তুই সৃজন করেছিস?...শালার একটুও বুদ্ধিসুদ্ধি নেই, জেনে রাখবুঝেসুঝে কাজ করতে হয়। কোন জিনিসের অপচয় করতে নেই।” ১৮৫৫ থেকে গলার চিকিৎসার জন্য বাগবাজার শ্যামপুকুরে চলে আসা পর্যন্ত দক্ষিণেশ্বরের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের পাক্কা তিরিশ বছরের সম্পর্কএই সময়েই তো একের পর এক এমন সব বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল, যা আজও মানুষকে বিস্ময়ে অভিভূত করে রেখেছে। অতএব দেখা যাচ্ছে, মহাপুরুষ-জীবনবৃত্তান্তে ভক্তি ছাড়াও ইতিহাসের একটু ময়ান থাকলে মন্দ হয় না। প্রথম: দেবী ভবতারিণী এই ব্র্যান্ডই মানুষের মনে গেঁথে গেলেও দক্ষিণেশ্বরের মায়ের অফিসিয়াল নামটি কী? দেহরক্ষার আগের দিন (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৬১) রানি রাসমণি দেবোত্তর সম্পত্তি রূপে যে দানপত্র স্বাক্ষর করেন, সেখানে মায়ের নাম ‘শ্রীশ্রীজগদীশ্বরী মহাকালী’। অফিসিয়াল কাজকর্মে, এমনকী কর্তৃপক্ষের কালীপূজার নিমন্ত্রণপত্রে তাঁর ওই নাম আজও অব্যাহত। কথামৃতকার তাঁর অল-টাইম বেস্টসেলার বইতে বারবার ঠাকুরের শ্রীমুখে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন: “কালই ব্রহ্ম। যিনি কালের সহিত রমণ করেন, তিনিই কালীআদ্যাশক্তি। অটলকে টলিয়ে দেন।” এই আদ্যাশক্তি লীলাময়ী। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। তাঁরই নাম কালী। এই দক্ষিণেশ্বরে কেশবচন্দ্র সেনকে ঠাকুর দেবীমাহাত্ম্য বোঝাচ্ছেন, “তিনি নানা ভাবে লীলা করছেন। তিনিই মহাকালী, নিত্যকালী, শ্মশানকালী, রক্ষাকালী, শ্যামাকালী।...যখন সৃষ্টি হয় নাই,...নিবিড় আঁধার, তখন কেবল মা নিরাকারা মহাকালীমহাকালের সঙ্গে বিরাজ করছেন।”
এ কালের বিজ্ঞানপ্রেমী ছাত্রছাত্রীরা একটু দৈহিক বিবরণ পছন্দ করেন। তাঁরা মন্দিরে গেলেই কিছু প্রয়োজনীয় খবরাখবর নিয়ে নেন। দক্ষিণেশ্বরের চতুর্ভুজা মা কালীর কষ্টিপাথরের বিগ্রহউচ্চতায় সাড়ে তেত্রিশ ইঞ্চি, তিনি দক্ষিণাস্যা। গর্ভমন্দিরটির দৈর্ঘ্য মাত্র পনেরো ফুট। দক্ষিণেশ্বরে পরবর্তী কালের (১৮৮৪) অমাবস্যার রাত্রের বর্ণনা কথামৃতে আছে, “ওঁ কালী, ওঁ কালী। সাবধানে পূজা করো। আবার মেড়া বলি দিতে হবে।...ঠাকুরের সে অবস্থা নয়, পশুবধ দেখিতে পারিবেন না।”
যাঁরা বলেন এ দেশে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না, তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, রামকৃষ্ণের দেহাবসানের পঁচিশ বছর আগে (১৮৬১) নাটমন্দিরে মন্দিরের মালিকরা সভা বসিয়েছিলেন‘শ্রীরামকৃষ্ণ সত্য সত্যই অবতার’ এই কথার অনুমোদন অথবা খণ্ডন। এই সভায় তন্ত্রসাধনায় পারদর্শিনী ভৈরবী সর্বসমক্ষে ঠাকুরকে অবতার রূপে ঘোষণা করেছিলেন।
দক্ষিণেশ্বরের ছোট ভট্চায্যিমশাই শুধু ভবতারিণী মায়ের পূজা করেননি, ওখানে দিনের পর দিন বসবাস করে যে সব যুগান্তকারী কাণ্ডকারখানা করেছেন, তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। এক একটা করে ধরা যাক। হিন্দুর মন্দিরে বসে দ্বাদশ বছর ধরে পৃথিবীর সব ধর্ম নিয়ে তিনি অনুসন্ধান করেছেনযাকে এ কালে রিসার্চ ও এক্সপেরিমেন্ট বলা হয়। আত্মসন্ধানের প্রথম পর্বে (১৮৬১-৬৪) তান্ত্রিকসাধনা, দ্বিতীয় পর্বে (১৮৬৪-৬৫) বৈষ্ণব সাধনা, তৃতীয় পর্বে অদ্বৈত সাধনা (১৮৬৫)। পরে (১৮৬৬) ইসলাম সাধনাকঠিন সাধনার পথপ্রদর্শক সুফি সাধক গোবিন্দ রায়। ঠাকুর নিজেই বলেছেন, “ঐ সময় ‘আল্লা’মন্ত্র জপ করতাম,...কাছা খুলিয়া কাপড় পরতাম, ত্রিসন্ধ্যা নামাজ পড়তাম।” এ বিষয়ে হৃদয়ের রিপোর্ট, “মামা যজ্ঞসূত্র ত্যাগ করে” নামাজ পড়ছেন। আর এক রিপোর্ট, গাজিপুকুরে রামকৃষ্ণ “পাঁচ বার নামাজ পড়তেন, মুসলমান খানা খেতেন এবং সকল বিষয়ে মুসলমান সমাজে প্রচলিত শিষ্টাচার পালন করতেন।” বেদিযুক্ত গাছের একটি স্মারকচিহ্নের কথা বিভিন্ন বইতে উল্লেখিত হয়েছে: “রামকৃষ্ণ এই স্থানে পীরসাধনা করেছিলেন।”
দক্ষিণেশ্বরে সাধিকা ভৈরবীর আগমনের পরে সব চেয়ে বড় ঘটনা, দশনামী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী তোতাপুরীর দক্ষিণেশ্বরে আগমন। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ইনিই ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’ নামটি দিয়েছিলেন।
ভবঘুরে এই সন্ন্যাসীরা তিন দিনের বেশি কোথাও বাস করেন না, কিন্তু এ বার ব্যতিক্রমটানা এগারো মাস এখানে থেকে তিনি দক্ষিণেশ্বর গবেষণাগারের মাহাত্ম্য বাড়িয়ে গেলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের স্ট্যাটাস শেষ পর্যন্ত গৃহী না সন্ন্যাসী, এই প্রশ্নের অবসান অনেক আগেই হয়েছে। ঠাকুর তোতাপুরীকে ‘ন্যাংটা’ বলতেন এবং এঁর কাছেই সন্ন্যাসের জন্য প্রয়োজনীয় শাস্ত্রাদি ক্রিয়া গোপনে সেরে ফেলেন, গোপনীয়তার কারণ তিনি দক্ষিণেশ্বরে বসবাসকারিণী গর্ভধারিণী জননীর প্রাণে আঘাত দিতে চাননি। জননী চন্দ্রমণির দেহত্যাগও দক্ষিণেশ্বরে ১৮৭৬ সালে (পঁচাশি বছর বয়সে)। প্রাণ দিয়ে সেবাযত্ন করলেও সন্ন্যাসীর আচরণবিধি মান্য করে রামকৃষ্ণ নিজের মায়ের মুখাগ্নিও করেননি, শ্রাদ্ধকর্মও করেননি।
উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে দক্ষিণেশ্বরে আর দু’টি বড় ধরনের বৈপ্লবিক ঘটনা একই সঙ্গে কিন্তু প্রায় নিঃশব্দে ঘটেছিল। মার্চ ১৮৭২ : অর্ধাঙ্গিনী ১৮ বছর বয়সের পূর্ণযৌবনা সারদার দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিতি। এই দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে এখন পৃথিবার দেশে দেশে এবং স্বদেশেও নানা কৌতূহল ও গবেষণা। ঠাকুরের শ্বশুরবাড়িতে তখন গুজব রটেছে, তিনি পাগল হয়েছেন এবং উলঙ্গ হয়ে বেড়ান। রামকৃষ্ণজায়া নিজেই বর্ণনা দিয়ে গিয়েছেন, “রাত প্রায় ন’টার সময় দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছলাম।...আমরা তাঁর ঘরেই শুলাম। হৃদয় দু’ধামা না তিনধামা মুড়ি আনলে। তখন সকলের খাওয়া হয়ে গিয়েছে।”
মাস দেড়েক পরে দক্ষিণেশ্বরেই উনিশে-পা-দেওয়া নিজের পূর্ণযৌবনা স্ত্রীকে ষোড়শী পূজা করে নতুন এক এক্সপেরিমেন্ট করলেন আমাদের শ্রীরামকৃষ্ণ। শুনুন তাঁর স্ত্রীর মুখের বর্ণনা: “তিনি আমাকে পায়ে আলতা পরিয়ে দিলেন, কাপড় ছাড়িয়ে কাপড় পরিয়ে দিলেন, সিঁদুর দিলেন, পান মিষ্টি খাওয়ালেন...আমি মনে মনে প্রণাম করলাম।” মায়ের অনুরাগিণীরা ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন। তাঁরা এই কাপড় ছেড়ে কাপড় পরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বেশ কিছু স্ট্র্যাটেজিক প্রশ্ন করেছিলেন।
এই কালে ঠাকুরের পদসেবার সুযোগও গৃহিণীর ছিল। “ঠাকুর আমার পা টিপে দেখিয়ে দিয়ে বলতেন, এমনি করে টেপো।” আর একদিন ঠাকুর একাকী তাঁর ছোট খাটে বসে আছেন, সুযোগ বুঝে অর্ধাঙ্গিনী কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, “আমি তোমার কে?” স্বামীর উত্তরটিও অবিস্মরণীয়, “তুমি আমার আনন্দময়ী মা।”
দাম্পত্যজীবনের আরও কিছু অন্তরঙ্গ বিবরণ সারদামণির স্মৃতি থেকে পাওয়া যাচ্ছে। এক সময় টানা আট মাস তিনি ঠাকুরের সঙ্গে নহবতে বসবাস করেছেন। “আমার বয়স তখন আঠারো-উনিশ বছর হবে, ওঁর সঙ্গে শুতুম। একদিন বললেন, ‘তুমি কে?’ বল্লুম, ‘আমি তোমার সেবা কত্তে আছি।’ ‘কী?’ ‘তোমার সেবা কত্তে আছি।’ ‘তুমি আমার বই আর কাকেও জানো না?’ ‘না।’ ‘আর কাকেও জানো না?’ ‘না।’ ‘আর কাকেও না?’ ‘না।’ ”
দাম্পত্যসম্পর্ক ও কামনাময় শরীরের দেওয়া-নেওয়া নিয়ে যাঁরা জটিল উপন্যাস রচনার ক্ষমতা রাখেন, তাঁরাও দক্ষিণেশ্বরের এই দুঃসাহসী দম্পতিকে বুঝতে পারেন নাআশঙ্কা করেন, কোথাও কিছু গোপনীয়তা আছে, অথবা কোনও গোলযোগ। কিন্তু দক্ষিণেশ্বরবাসী মূল নায়ক-নায়িকা আনন্দে এবং সন্তুষ্টিতে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছেন। এঁদের ভক্তরাও নিষ্ঠার সঙ্গে পত্নীর স্বামীগৃহে যাতায়াতের হিসাবনিকাশ করেছেন এবং আমাদের জানিয়েছেন, সারদামণি স্বামীর জীবিতকালে ৮ বার দক্ষিণেশ্বরে এসেছেন। প্রথম বার মার্চ ১৮৭২, দ্বিতীয় বার ১৮৭৪, তৃতীয় বার ১৭ মার্চ ১৮৭৬, চতুর্থ বার জানুয়ারি ১৮৭৭, পঞ্চম বার ফেব্রুয়ারি ১৮৮১, ষষ্ঠ বার ১৮৮২, সপ্তম বার ১৮৮৪ এবং অষ্টম বার মার্চ ১৮৮৫।
স্ত্রীকে অতি নিকটে থাকতে দিয়েও তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র ভোগেচ্ছা দেখতে পাননি। এক সময় স্বামীটি স্বীকার করেছেন, স্ত্রী যদি “আত্মহারা হয়ে তখন আমাকে আক্রমণ করত, তখন আমার সংযমের বাঁধ ভেঙে দেহবুদ্ধি আসত কি না, কে বলতে পারে? বিয়ের পর মাকে (জগদম্বাকে) ব্যাকুল হয়ে বলেছিলাম, মা, আমার পত্নীর ভেতর থেকে কামভাব এককালে দূর করে দে।”
দক্ষিণেশ্বরের ছোট ভট্টাচার্য যেমন তাঁর সাধনাস্থলে সম্মান পেয়েছেন, তেমনই কারণে-অকারণে যথেষ্ট অনাদর ও অবহেলাও পেয়েছেন। রানির জামাই মথুর তাঁকে সম্মান করেছেন, কিন্তু রানির দৌহিত্র ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস বেশ কয়েক বার তাঁকে অস্বস্তিতেও ফেলেছেন। কেশবচন্দ্র সেনের ওখানে খাওয়া-দাওয়া করে দক্ষিণেশ্বরের নিয়মকানুনের পাল্লায় পড়েন বলে ঠাকুরের ভয় ছিল, খবরটা তিনি চাপাই রেখেছিলেন। ভক্ত মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে বলেছেন, “কাউকে বলো না, তা হলে কালীঘরে ঢুকতে দেবে না।” পরের দিন মন্দিরের খাজাঞ্চিকে দেখে বললেন, “দেখ, কাল কেশব সেনের কাছে গিয়েছিলাম। খুব খাওয়ালে। তা ধোপা কি নাপিত খাইয়েছে তা জানি না। আচ্ছা, এতে আমার কিছু হানি হলো?”
|
পরের সংখ্যায় শেষ |
|
|
|
|
|