দলের নানা সিদ্ধান্তে ‘ক্ষুব্ধ’ রেজ্জাক মোল্লাকে ‘শান্ত’ করতে উদ্যোগী হল আলিমুদ্দিন।
রেজ্জাকের ক্ষোভ মেটাতে তাঁর সঙ্গে কথা বললেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব। কেবল তা-ই নয়, রাজ্যের কৃষক সমস্যা নিয়ে রেজ্জাকের সঙ্গে আলোচনা করলেন, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও। সরকারে থাকাকালীন যাঁর সঙ্গে রেজ্জাকের সম্পর্ক দলের অন্দরে কখনওই ঠিক ‘মধুর’ ছিল না। রেজ্জাকও বিভিন্ন সময়ে (নির্বাচনে হারের আগে এবং পরে) বুদ্ধবাবু সম্পর্কে বহু ‘বিরূপ’ মন্তব্য করেছেন। এই প্রেক্ষিতে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রেজ্জাকের আলোচনা এক দিকে যেমন রাজ্য-রাজনীতিতে তেমন সিপিএমের অন্দরেও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
আলিমুদ্দিন সূত্রের খবর, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর নির্দেশেই সম্প্রতি বুদ্ধ-গৌতম রেজ্জাকের সঙ্গে কথা বলেন। মন্ত্রিসভায় থাকাকালীন সিপিএমের এই দুই নেতা ছাড়াও প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী তথা সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপম সেনের সঙ্গে রেজ্জাকের একাধিক বার বিরোধ বেধেছে। বিধানসভা ভোটে হারের পর বুদ্ধবাবুর মতোই নিরুপমবাবুর বিরুদ্ধেও রেজ্জাক কটাক্ষ করেন। যা নিয়ে তাঁকে দলে ‘ভর্ৎসনা’ও করা হয়। বুদ্ধবাবুর সঙ্গে রেজ্জাকের কথা হয়েছে রাজ্যে কৃষকদের সঙ্কট নিয়েই। দু’জনের সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরে যে ‘শীতলতা’ তৈরি হয়েছিল, তা গলতে আরম্ভ করেছে। এটাই বিমানবাবুর কাছে সুখবর।
বস্তুত, বিমানবাবু মনে করেন, দলের বর্তমান সঙ্কটে রেজ্জাকের মত ‘জনপ্রিয়’ সংখ্যালঘু নেতাকে ‘একঘরে’ করে দেওয়ার চেয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলে ‘ক্ষোভ’ মিটিয়ে নেওয়াই সঠিক পথ। এই সঙ্কটসময়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক রেজ্জাককে ‘কাজে’ লাগাতে চান। ঠিক হয়েছে, রেজ্জাককে দলে তাঁর ‘প্রাপ্য গুরুত্ব’ দেওয়া হবে। বিধানসভায় বামেদের বিরোধী ভূমিকা পালন থেকে শুরু করে নানা ব্যাপারে তাঁর পরামর্শও নেওয়া হবে। |
প্রসঙ্গত, রেজ্জাকের উদ্যোগেই নভেম্বরে ‘নয়া জমানা’ বলে একটি সংগঠন একটি কনভেনশনের আয়োজন করছে। উদ্দেশ্য, ওবিসি মুসলিমদের তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা। তবে রেজ্জাকের এই প্রপয়াস নতুন নয়। ফ্রন্ট সরকারের আমলেও দু’বার এই সংগঠনের কনভেনশন হয়েছিল। এ বার রেজ্জাকের পরামর্শে কনভেনশনকে আরও সফল করতে তাঁর সহযোগী হিসাবে দেওয়া হয়েছে প্রাক্তন সংখ্যালঘু প্রতিমন্ত্রী আবদুস সাত্তারকে। দলের তরফেও সমস্ত সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
গৌতমবাবুর সঙ্গে আলোচনায় রেজ্জাক সরাসরি তাঁর ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। জানান, ১৯৭২ সাল থেকে তিনি নির্বাচিত বিধায়ক হওয়া সত্ত্বেও বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র কোনও বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন না। পরামর্শও নেন না। রেজ্জাককে না-জানিয়েই ফ্রন্টের পরিষদীয় দলে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তিনি বিধানসভায় সিপিএমের পরিষদীয় দলের সচেতক। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে তিনি বিষয়টি জানতে পারেন। রেজ্জাকের আরও ক্ষোভ, বিধানসভায় বামফ্রন্ট ‘গঠনমূলক’ বিরোধীর ভূমিকা পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই সিঙ্গুরের চাষিদের জমি ফেরতের সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে কৃষক স্বার্থে মমতা-সরকার কোনও সিদ্ধান্ত নিলে তিনি তা সমর্থন করেছেন। কিন্তু সে কাজকেও ‘ভাল চোখে’ দেখা হয়নি। উল্টে আড়ালে তাঁর সমালোচনা করা হয়েছে।
রেজ্জাক প্রায়শই নিজেকে ‘চাষির ব্যাটা’ বলে উল্লেখ করেন। দীর্ঘদিন কৃষকসভার রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সংগঠনের রাজ্য নেতৃত্বে তাঁর স্থান নেই। এমনকী, কৃষকসভার বর্তমান সম্পাদক পশ্চিম মেদিনীপুরের তরুণ রায় গ্রেফতার এড়াতে দীর্ঘ দিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকলেও তাঁর জায়গায় রেজ্জাককে দায়িত্ব না-দিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার নেতা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নৃপেন চৌধুরীকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রেজ্জাকের প্রশ্ন, নৃপেনবাবুর থেকে তিনি কি কম দক্ষ সংগঠক? গৌতমবাবু রেজ্জাকের ক্ষোভের কথা বিমানবাবুকে জানিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে গৌতমবাবুর আলোচনার কথা স্বীকার করে রেজ্জাক শুক্রবার বলেন, “কিছু কথা হয়েছে। দলের ব্যাপার। বাইরে বলার জন্য নয়।” গৌতমবাবুর সঙ্গে আলোচনায় রেজ্জাক বর্তমান পরিস্থিতিতে দলে বুদ্ধবাবুর নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টিও মেনে নিয়েছেন। সেই সঙ্গে তাঁর পরামর্শ, বুদ্ধবাবুকে আরও বেশি করে পথে নামতে হবে।
সিপিএমের রাজ্য সম্মেলন ফেব্রুয়ারিতে। ফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকার সময় রেজ্জাককে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে নেওয়ার কথা হলেও মূলত বুদ্ধ-নিরুপমের আপত্তিতেই তা হয়নি। কিন্তু ‘পরিবর্তিত’ পরিস্থিতিতে এ বারের সম্মেলনে তাঁকে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে নেওয়া হতে পারে বলেও রেজ্জাককে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। |