শপথ নেওয়ার পর পরই শিল্প স্থাপনে লালফিতের ফাঁস কাটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথা মেনেই রাজ্যের পাঁচটি জেলায় শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় একশো পাতার আবেদনপত্রকে ছেঁটে ১১ পাতায় নামানো হয়েছিল।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তাতেও খুশি হননি। ফলে তা ছেঁটে সাত পাতায় নামানোর নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি মিলেছিল গত সোমবার, শিল্পমহলের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বিজয়া-বৈঠকে।
এবং সেই প্রতিশ্রুতি মেনেই শুক্রবার থেকে শিল্প স্থাপনের ‘এক-জানলা’ ব্যবস্থার আবেদনপত্র সাত পাতার।
শুধু তা-ই নয়। শিল্পোন্নয়ন নিগমের খবর: নিগমে এক-জানলা ব্যবস্থাকে সফল করে তোলার প্রক্রিয়া আগামী সপ্তাহেই শুরু হচ্ছে। যার মূল লক্ষ্য, বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কম সময়ের মধ্যে আবেদনপত্রের অনুমোদন নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো।
সরকারের এই ‘সদিচ্ছা’ সত্ত্বেও শিল্পমহল কিন্তু সংশয়ে। আবেদনপত্রের বহর কমানোর এই প্রচেষ্টাকে তারা উড়িয়ে দিচ্ছে, এমনটা অবশ্য নয়। বরং তারা এটাই চেয়েছিল। তাই তাদের কাছে এই পদক্ষেপ স্বাগত। কিন্তু প্রয়োজনের ‘সিন্ধুতে’ একে ‘বিন্দু’র অতিরিক্ত এখনই অন্য কিছু বলে মানতে নারাজ তারা। শিল্পমহলের যুক্তি, এই ‘পরিবর্তন’ শুধুই পদ্ধতিগত। যতক্ষণ না কর্মসংস্কৃতি বদলাচ্ছে, তত দিন এটা শুধুই ‘কাগুজে।’ শিল্পোন্নয়ন নিগম অবশ্য এই মুহূর্তে ব্যস্ত আটটি সরকারি বিভাগের সঙ্গে সম্ভাব্য শিল্প প্রস্তাবের অনুমোদন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার কাজে।
তবে রাজ্য নিয়ে শিল্প মহলের উৎসাহ যে এখনও যথেষ্ট নয়, সোমবার নৈশভোজের আসরেই তার ইঙ্গিত মিলেছিল। শিল্প-পরিচালক ও শিল্পপতিরা বার বার জোর দিয়েছিলেন শিল্প-সমস্যায় সরকারকে দ্রুত পাশে পাওয়ার প্রক্রিয়ার উপরে। তাঁরা স্পষ্টই জানিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রয়োজনে যোগাযোগ করা মুশকিল হয়ে উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রী যখন শেষ সিদ্ধান্তের আধিকারিক, তখন তাঁর কাছে শিল্পমহলের পৌঁছানোর রাস্তাও সহজতর হওয়া জরুরি। বৈঠকের পরে আলাপচারিতায় উঠে এসেছিল অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা শিল্প-আধিকারিকদের সঙ্গে যোগাযোগের তুলনামূলক সুবিধার প্রসঙ্গও। এক কথায়, রাজ্যের শিল্প-ভাবমূর্তি যে সঙ্কটে, এবং তা কাটার সম্ভাবনা যে এখনও সে ভাবে তৈরি হয়নি, ওই আলাপচারিতায় ছিল তার প্রাথমিক সতর্কবার্তা।
এ দিনও শিল্প স্থাপনের আবেদনপত্রের বহর কমার প্রতিক্রিয়ায় শিল্পমহল একই কথা বলছে। যেমন ফিকি-র পূর্বাঞ্চলের চেয়ারম্যান গৌরব স্বরূপ এবং বেঙ্গল চেম্বারের সেক্রেটারি জেনারেল প্রিয়দর্শন রায়ের বক্তব্য, “শিল্প গড়ার প্রাথমিক পরিবেশ তৈরির পথে এটা অবশ্যই সঠিক পদক্ষেপ।” কিন্তু শুধু আবেদনপত্রের বহর কমালেই হবে না, তাকে একই আবেগে কার্যকর করতে আমলা-সহ গোটা শিল্প-প্রশাসনকেই সমান দক্ষ করে তুলতে হবে বলে জানিয়েছেন বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বারের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সন্দীপ সেন। এবং এই দক্ষতা ছড়িয়ে দিতে হবে প্রশাসনের তৃণমূলস্তরেও।
গৌরববাবু ও প্রিয়দর্শনবাবু অবশ্য আরও নির্দিষ্ট করে জানিয়েছেন ভাবমূর্তির সমস্যার কথাটা। তাঁদের বক্তব্য, শিল্প স্থাপনের অনুমোদন মেলার পরে তা কার্যকর করতে আরও অনেকটা পথই হাঁটতে হবে। সেখানেই হবে প্রশাসনের আসল পরীক্ষা।
শিল্পমহলকে খুশি রাখতেই রাজ্য চাইছে ছ’মাসের মধ্যে অনুমোদন-প্রক্রিয়ার কাজ সম্পূর্ণরূপে নেট-ভিত্তিক করে তুলতে। আর সাত পাতার আবেদনপত্র ক্রমে অন্য জেলাগুলিতেও ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে নিগমের ‘শিল্পসাথী’ ওয়েবসাইটে। কিন্তু তা হবে একেবারে শেষ পর্যায়ে।
সেই ‘শেষ পর্যায়’ পর্যন্ত হাঁটতে রাজ্য কত সময় নেয়, শিল্পমহলের নজর আপাতত সে দিকেই। |