|
|
|
|
মমতা-প্রধানমন্ত্রী বৈঠক |
প্রয়োজনে আসবেন, আশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর |
অগ্নি রায় ও অনমিত্র সেনগুপ্ত • নয়াদিল্লি |
আগামিকাল রাজধানীতে জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠক। তার আগে আজ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে বৈঠকে আলাদা করে কোনও বিশেষ আর্থিক প্যাকেজের দাবি তুলে ধরেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বরং সমস্যার মূল ধরে নাড়া দিয়ে কেন্দ্রের কাছে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সুরাহা প্রার্থনা করেছেন তিনি।
কী সেই ‘সমস্যার মূল’? পশ্চিমবঙ্গের তরফে বলা হচ্ছে, রাজ্যের বর্তমান ‘সঙ্কটজনক’ পরিস্থিতির মূলে যেমন রয়েছে শোচনীয় আর্থিক অবস্থা, তেমনই আছে পরিকাঠামো উন্নয়নে খামতিও। আজ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর আলোচনায় এই সংক্রান্ত সব ক’টি বিষয়ই উঠে এসেছে।
বা বলা ভাল, বিচক্ষণ ভাবে তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। পরে বলেছেন, “পাঁচ মাস হল সরকারে এসেছি, এখনও কিছু পাইনি। আজ তাই আবার সাহায্যের অনুরোধ করে এলাম।”
সূত্রের খবর, বৈঠকে মমতাকে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, শীঘ্রই তিনি পশ্চিমবঙ্গে যাবেন এবং সব বিষয় নিয়ে ফের কথা বলবেন। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী জয়রাম রমেশের সঙ্গেও আজ দীর্ঘ বৈঠক করেছেন মমতা। জয়রামও জানিয়েছেন, তিনি খুব শীঘ্রই পশ্চিমবঙ্গে যাবেন।
মমতাকে দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা দেখে আসছেন, তাঁদের বক্তব্য, এ বার যিনি দিল্লিতে এসেছেন, তিনি অনেক কুশলী এবং বিচক্ষণ মমতা। যিনি আর্থিক প্যাকেজের দাবি না তুলে প্রধানমন্ত্রীকে বিষয় ধরে ধরে বুঝিয়েছেন, যে রাজ্য তিনি হাতে পেয়েছেন তার অবস্থা কেমন। এবং একই সঙ্গে এর সুরাহা প্রার্থনা করেছেন।
কী নেই মমতা-মনমোহন আলোচনায়! পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় সড়কগুলির বেহাল অবস্থা, পাটচাষিদের সঙ্কট, সরকারের ঘাড়ে ‘উত্তরাধিকার সূত্রে’ প্রাপ্ত ঋণের বোঝা, জঙ্গলমহল পাহাড়-সহ বিভিন্ন এলাকায় পিছিয়ে পড়া জেলার উন্নয়ন এ সব কিছুর উপরেই জোর দিয়েছেন মমতা। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি কেন অন্য রাজ্যের মতো নয়, তার রাজনৈতিক কারণও মনমোহনের সামনে তুলে ধরেছেন তিনি। বলেছেন, “অন্য সব রাজ্যেই সরকারের বদল ঘটেছে নিয়মিত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে গত ৩৪ বছরে একটিই সরকার তার ‘অপদার্থ বাম শাসন’ কায়েম রাখার ফলে ঘুণ ধরে গিয়েছে প্রশাসনে।” এমনকী, রাজ্যে যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আমলার অভাব রয়েছে, তা-ও আজ বৈঠকে উল্লেখ করেছেন মমতা। তাঁর কথায়, বর্তমানে ৩১৪ জন আইএএস অফিসারের মধ্যে খালি পদ রয়েছে প্রায় ১০২টি। অভাব ভাল শিক্ষক, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরও। বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “পরিকাঠামো, পুলিশি ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ প্রয়োজন। পাহাড় এলাকায় বিদ্যুৎ নেই, শিক্ষা নেই। জঙ্গলমহল এবং পাহাড়ে সামাজিক উন্নয়নও জরুরি।” |
|
নয়াদিল্লিতে মমতা। ছবি: প্রেম সিংহ |
অতীতে চন্দ্রবাবু নায়ডু বা মায়াবতী যে ভাবে কেন্দ্রের কাছে বিপুল আর্থিক প্যাকেজ দাবি করতেন, রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পরে মমতাও তেমনই দাবি করেছিলেন এর আগে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বার দিল্লি এসে এই নিয়ে তিনি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকও করেছিলেন। সেই আর্থিক প্যাকেজ দাবি এবং তাই নিয়ে টানাপোড়েনে তখন কিছুটা তিক্ত পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়। এ দিন বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রী জানান, যা চাওয়ার সেটা তো আগেই চাওয়া হয়েছে। সেটা এখনও রাজ্য পায়নি। একই সঙ্গে বলেন, “আজ প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়েছি, রাজ্যের কী অবস্থা। বলেছি, কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ভাবুক।” তাঁর বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী বুঝেছেন। রাজ্যে আসার আশ্বাসও দিয়েছেন।
এ দিনের বৈঠকে স্পষ্ট, মমতা চাইছেন, রাজ্যের আর্থিক হাল শোধরাতে স্বল্পমেয়াদি সাহায্যের পাশাপাশি রাজ্যের ভিত শক্ত করতে কেন্দ্র কিছু দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপও করুক। রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের ঘরে-বাইরে যে কোণঠাসা পরিস্থিতি, তাতে তৃণমূলের মতো গুরুত্বপূর্ণ শরিককে পাশে রাখাটা মনমোহনের কাছে খুবই জরুরি। সামনেই সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। এত দিন ধরে চলেছে টু-জি নিয়ে সরকারের ভিতরে দ্বন্দ্ব। সম্প্রতি অন্যতম বড় শরিক এনসিপি সুর পাল্টিয়ে সরকারের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এনসিপি নেতা তথা সরকারের কৃষিমন্ত্রী শরদ পওয়ার বলেছেন, একের পর এক দুর্নীতি ইউপিএ-র দ্বিতীয় ইনিংসকে দুর্বল করেছে। পাশাপাশি গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সাময়িক ভাবে সরিয়ে আডবাণীর রথযাত্রায় এককাট্টা বিজেপি প্রতিদিন দুর্নীতি এবং মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নে সরকারকে কার্যত তুলোধোনা করে চলেছে।
এই পরিস্থিতিতে তাই আর্থিক সাহায্য এবং নিরাপত্তার প্রশ্নে মমতার যেমন প্রতিপদে কেন্দ্রকে প্রয়োজন, তেমনই মনমোহন সরকারেরও তৃণমূলের সমর্থন অত্যন্ত প্রয়োজন। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার চিত্রই আজকের বৈঠকে প্রতিফলিত হয়েছে। মমতা নিজেও আজ লোকপাল আন্দোলনের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বলেছেন, “দুর্নীতি নয়, লোকপাল আন্দোলনের উদ্দেশ্য একটাই। সেটা হল, প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করা।”
আজকের বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের মূলত দু’তিনটি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের ‘শোচনীয়’ আর্থিক অবস্থার কথা তুলে ধরে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, গত ৩৪ বছরের বাম শাসনের শেষে ২ লক্ষ ৩ হাজার কোটি টাকা দেনা মাথায় নিয়ে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব শুরু করতে হয়েছে। মমতার কথায়, “রাজ্যের আজকের বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের মূলত দু’তিনটি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের বেহাল আর্থিক অবস্থা। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি জানিয়েছেন, গত ৩৪ বছরের বাম শাসনের শেষে ২ লক্ষ ৩ হাজার কোটি টাকা দেনা মাথায় নিয়ে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব শুরু করতে হয়েছে। এখন যা অবস্থা তাতে প্রতি ১ টাকা আয়ের ৯৪ পয়সা চলে যায় বেতন পেনশন এবং ঋণের সুদ মেটাতে। বাকি ৬ পয়সা পড়ে থাকে উন্নয়নের জন্য। |
|
পরে বলেন, “বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রকে অবশ্যই ভাবতে হবে।” একই সঙ্গে জানান, “কেন্দ্র রাজ্যের কাছে যে সুদ পায়, তা তিন বছরের জন্য মকুব করা, বিশেষ যোজনা বরাদ্দের ব্যবস্থা করার মতো কিছু প্রস্তাব আমি ফের জানিয়েছি। আরও বলেছি, রাজ্যের ১১টি পিছিয়ে পড়া জেলার বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে দেখতে হবে।” আকরিক লোহার মতো কয়লার রয়্যালটিও যাতে রাজ্য পায়, জানিয়েছেন সেই দাবিও।
সম্প্রতি বারাসত থেকে ফিরে জাতীয় সড়কগুলির বেহাল অবস্থায় যারপরনাই বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে এই বিষয়টির বিশদ উল্লেখ করেছেন তিনি। পরে জানিয়েছেন, “৩১ এবং ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলার পর তিনি কেন্দ্রীয় সড়ক ও পরিবহণ মন্ত্রী সি পি জোশীকে নির্দেশ দেন বিষয়টি খতিয়ে দেখতে। এর পর কেন্দ্রীয় নগরোয়ন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সৌগত রায় এবং জাহাজ প্রতিমন্ত্রী মুকুল রায় রাজ্যের বেহাল সড়ক ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে সি পি জোশীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন।”
পরে মুকুলবাবু জানান, দমদম থেকে কৃষ্ণনগর, কৃষ্ণনগর থেকে বহরমপুর, বহরমপুর থেকে ফারাক্কা, ফারাক্কা থেকে রায়গঞ্জ এবং ডালখোলা এলাকার জাতীয় সড়কের বেহাল অবস্থার কথা বিশেষ ভাবে জানানো হয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে। এর সঙ্গে বৈঠকে গুরুত্ব পেয়েছে
রাজ্যের পাট চাষিদের অসহায় অবস্থার কথাও। মমতার কথায়, “আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি পাট চাষিদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের উপর বাড়তি ৪০০ টাকা বোনাস দেওয়া হোক। তিনি বিষয়টি ভেবে দেখবেন বলে জানিয়েছেন।”
তবে এ সব দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনার সময়ও বারবারই স্পষ্ট হয়েছে পারস্পরিক নির্ভরতার বিষয়টি। যা আরও উজ্জ্বল হয়েছে প্রধানমন্ত্রী কয়েক কদম এগোনোর পরে। |
|
|
|
|
|