|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
গান, কবিতা, সমালোচনাও কি বিজ্ঞাপন? |
সুধীর চক্রবর্তী |
রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞাপন ও সেই সময়, হিরণ্ময় মাইতি। দে পাবলিকেশনস, ৪০০.০০ |
বট গাছের মতো পরিব্যাপ্ত ও ছায়াসঞ্চারী অস্তিত্ব নিয়ে আশি বছরের জীবনপরিক্রমার শেষে রবীন্দ্রনাথ চলে গিয়েছেন সত্তর বছর আগে। তাঁর ধারোষ্ণ বিচিত্র রবিশস্য বঙ্গসংস্কৃতির ভাণ্ডারে মজুত আছে। আমরা আমাদের দৈনন্দিন যাপনে আর প্রয়োজনের চাহিদায় সেই সঞ্চয়িত গোলা থেকে বাঁচার রসদ সংগ্রহ করে নিই এখানে বাঁচা বলতে বিশেষ করে মনের বাঁচা, মনের মতো করে বাঁচা। তার জন্য সামনে প্রসারিত হয়ে আছে বিসর্পিত রবীন্দ্রপথ। তার নানা বাঁকে অনেকান্ত তাঁর মহিমার মূর্তি। আমরা তাঁর সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের এক-এক রকম চারিত্র-মূর্তির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি যেমন এই উৎসবপর্বে প্রকাশিত আলোচ্য বইটি, যার প্রথম ১৩০ পৃষ্ঠায় তথ্য ও বিষয়-বিশ্লেষণ, পরবর্তী ১৩০ পৃষ্ঠায় আর্ট পেপারে ছাপা রবীন্দ্র-প্রসঙ্গিত বিজ্ঞাপনের বিন্যাস, সবশেষে ৬ পৃষ্ঠার তথ্যসূত্র। বইটি একই সঙ্গে পড়ার আর দেখার। বিচিত্র এমন এক বইয়ের লেখক তথা সংগ্রাহক হিরণ্ময় মাইতি, ইংরাজি সাহিত্যের শিক্ষক। তাঁর তরুণ সন্ধিৎসু মনের আগ্রহের কেন্দ্রে আছেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর অঙ্গাঙ্গী নেশা হল বাংলার প্রাচীন ছাপাখানা, পুরনো কলকাতা এবং পাখি।
ঠাকুর পরিবারে দেশজ শিল্প সংগঠনের একটা আলাদা প্রবণতা ছিল, জ্যোতিদাদা তার সূচনা করেছিলেন জাহাজের খোল কিনে এবং তা চালু চলে, যা পরে তাঁকে প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করে বেচে দিতে হয়। রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও এমন প্রবণতার চিহ্ন আমরা দেখি এবং স্বদেশি সমাজ ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ আর ‘স্বদেশি উদ্যোগের সাফল্য কামনা করি’ শুধু তাঁর বাচনিক বয়ান নয়। কাজল কালির কালিমা যে কত মনোহর, ডোয়ার্কিন কোম্পানির তৈরি বাজনা যে কত শ্রুতিনন্দন, জলযোগের দই ও মিষ্টি যে কত রসনা তৃপ্তিকর, কিংবা সদ্য প্রকাশিত নিরুক্ত পত্রিকার সাফল্য কামনা সবই তাঁর জনাদৃত জীবনের এক সমুজ্জ্বল পরিচয়। হিরণ্ময়ের বইতে রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে লেখা প্রচুর বিজ্ঞাপন ছাপা রয়েছে। কত না উদ্যোগপতিকে কী না বিষয়ে প্রশংসা করে তিনি খুশি করেছেন। যদিও কোথায় যেন পড়েছিলাম, তিনি কবুল করেছেন যে, বহু বিষয়ে আমি প্রশংসাবাক্য লিখে দিয়েছি, কিন্তু ব্লেডের প্রশংসাবাণী কখনও লিখিনি।
যা-ই হোক, আলোচ্য বইটি একটি প্রশংসাযোগ্য কাজ। রবীন্দ্রসময় পর্বে যদিও আমাদের মুখ বিজ্ঞাপনে ঢেকে যায়নি ততটা, কিন্তু পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের গুরুত্ব তৈরি হয়েছে এবং রবীন্দ্রনাথের দেওয়া লিখিত শংসা ব্যবসায়ীরা অকাতরে ব্যবহার করেছেন এ বইতে তার প্রচুর নমুনার সচিত্র মুদ্রণ বেশ প্রাসঙ্গিক। এর পাশে আছে রবীন্দ্রনাথ সংক্রান্ত বহু সংবাদের বিজ্ঞাপন, তাঁর সদ্য প্রকাশিত গ্রামোফোন রেকর্ডের বিজ্ঞপ্তি, তাঁর বই প্রকাশের খবর সংবলিত বিজ্ঞপ্তি, লেখকদের উদ্দেশে লেখা তাঁর আশীর্বাণী। সর্বত্রই তাঁর একটি ছবি বা ফটো দেওয়া আছে সেই সন্তপ্রতিম চেহারা বিজ্ঞাপনেও ব্যবহৃত। বিশ্বভারতী প্রচারিত রবীন্দ্রগ্রন্থের বিজ্ঞাপনও অনেক আছে। উদ্যমী সংগ্রাহক পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের করা পুস্তক সমালোচনার পাতাও ছেপে দিয়েছেন। ছাপা হয়েছে পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের নতুন গান ও কবিতা। কিন্তু সেগুলি কি বিজ্ঞাপন?
হিরণ্ময়ের এই অন্য ধরনের বইটি চোখ মেলে দেখবার মতো। প্রচুর বইপত্র পত্রিকা ঘেঁটে রবীন্দ্র-প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞাপনগুলির ফটোচিত্র তৈরি করে এ বইয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন, শুধু সেই কারণেই বইটি সংগ্রহ করে রাখা দরকার। সূচনায় ন’টি অধ্যায়ে লেখক সমগ্র ব্যাপারটি সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাতে আছে অজস্র তথ্য। জীবন সায়াহ্নে ক্লান্ত ও অসুস্থ কবি চিঠিতে জানাচ্ছেন: ‘প্রতিদিন অন্তবিহীন চিঠি লেখালেখি, আশীর্বাণীর দাবি, অভিমতের অনুরোধ, বাংলাদেশের নবজাতকদের নামকরণ, আসন্ন বিবাহের সরকারি চৌকিগিরি আমার শরীরের স্বাস্থ্য ও মনের শান্তির পক্ষে অসহ্য হয়েছে।’ বিজ্ঞাপনে তাঁকে কী ভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, তার একটা নমুনা দিই। কেশোরাম কটন মিলের তৈরি শাড়ি, লং ক্লথ, টুইল, তোয়ালে বিষয়ে লেখা তাঁর চিঠি স্বাক্ষর-সহ সম্পূর্ণ ছেপে দিয়ে, নীচে লেখা হয়েছে ‘পূজায় এই কাপড় কিনিবেন, বেঙ্গল স্টোর্সে পাওয়া যায়।’ প্রচুর কোম্পানি তাঁকে তাদের উৎপাদিত পণ্য পাঠাত এবং তিনি উদার হস্তে চিঠি লিখে তাদের প্রশংসা করতেন সেগুলি ব্যবহৃত হত বিজ্ঞাপনে। এ বইতে তার বিপুল সম্ভার দেখবার মতো। খবরও আছে নানা ধরনের। যেমন, ১৯৪০ সালে অশীতিপর রবীন্দ্রনাথের সই সংগ্রাহকদের জন্য ১ টাকা করে নেওয়া হত ছাত্র-সাহায্য ভাণ্ডারে দান হিসেবে। ভাবা গিয়েছিল তাতে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ কিছুটা রেহাই পাবেন, কিন্তু ফল বিপরীত। বাঙালির বিজ্ঞাপন জগতের এক সময়ের ইতিহাস এ বই থেকে পাওয়া যাবে। নানা ভোগ্য দ্রব্য, পত্র-পত্রিকা, বই, রেকর্ড চলচ্চিত্রের পরিসর এবং রঙ্গব্যঙ্গ কার্টুন লেখক চেষ্টা করেছেন আমাদের বহুস্তরীয় সংস্কৃতি ও শিল্পজগতের সঙ্গে রবীন্দ্র সংস্পর্শের একটা বিশেষ দিক উন্মোচন করতে।
বইটি কিন্তু যথাযথ নান্দনিক উৎকর্ষে রূপায়িত হয়নি। এতে দর্শনীয় অংশ অর্থাৎ বিজ্ঞাপনের ছবিগুলি সঠিক শিল্পসম্মত ভাবে সাজানোও হয়নি। প্রচ্ছদ অত্যন্ত অনাকর্ষণীয়। ভবিষ্যৎ সংস্করণে প্রকাশক যদি বইটি যথেষ্ট দর্শনধারী করতে পারেন, তবে লেখকের অধ্যবসায় তার প্রার্থিত মর্যাদা পাবে। ভরসা করি বিষয়গৌরবে এই সংস্করণ দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে সুখপাঠ্যতা আর তথ্য সম্ভারের সম্পদে। |
|
|
|
|
|