|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
প্রথম প্রদর্শনী তো সেই হিন্দু মেলা-য় |
সুশোভন অধিকারী |
টেগোর্স পেন্টিংস/ভার্সিফিকেশন ইন লাইন, শোভন সোম। ভূমিকা: পবিত্র সরকার। নিয়োগী বুকস, ১২৫০.০০ |
কলকাতার টাউন হলে ১৯৩১-এর ডিসেম্বরে আয়োজিত রবীন্দ্রনাথের সত্তর বছর পূর্তি-উৎসবে অন্যতম আকর্ষণ ছিল আর্ট ও ক্রাফটের একটি বিশেষ প্রদর্শনী। প্রদর্শনীটি তিনটি ভাগে বিন্যস্ত হয়েছিল। প্রাচীন শিল্প, লোকশিল্প আর আধুনিক শিল্প। প্রাচীন শিল্পের বিভাগে ছিল নন্দলাল-কৃত অজন্তা ও বাগ গুহার ছবির নকল, তিব্বতি টঙ্কা, চিত্রিত পুঁথি ইত্যাদি। পরবর্তী বিভাগে ছিল ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা লোকশিল্পের নমুনা ও তার পাশাপাশি আধুনিক শিল্পের জায়গায় দেখানো হয় বেঙ্গল স্কুলের কিছু ছবি। এবং সেই সঙ্গে দু’শোটির মতো রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি এই আধুনিক শিল্পের অংশে প্রদর্শিত হয়েছিল। বিধানচন্দ্র রায়ের আহ্বানে টাউন হলের এই মেলা ও প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন ত্রিপুরার মহারাজা বিক্রমকিশোর মাণিক্য বাহাদুর। আর শিল্পীর উদ্বোধনী বক্তৃতায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের আঁকা ছবির বিষয়ে ঈষৎ কুণ্ঠিত কণ্ঠে বলেন ‘ঐগুলি কেবল রেখাই নয়, ঐগুলি তার থেকেও কিছু বেশি, আমার চিত্রাঙ্কিত স্বপ্ন এক কাব্যিক কল্পনার দর্শন। আমার চিত্র রেখার ছন্দে আবদ্ধ কবিতা।’ এই কথাগুলি অবশ্য রবীন্দ্রনাথ অন্য ভাবে অন্যত্রও বলেছেন। এবং রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনা থেকেই উঠে এসেছে তাঁর ছবি নিয়ে শোভন সোমের সাম্প্রতিক বইয়ের শিরোনাম।
রবীন্দ্রনাথের ছবির বিষয়ে শোভন সোমের বেশ কিছু গবেষণাধর্মী নিবন্ধ আছে। স্বতন্ত্র বই হিসেবে বিচিত্রের দূত বা তিন শিল্পী-তে রবীন্দ্রচিত্রকলা নিয়ে তাঁর বিস্তারিত আলোচনা আমাদের চোখে পড়ে যা অনেক দিন আগে লেখা। তা ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে তাঁর অনেকগুলি রচনা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে আছে। তবে সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর এ বইটি ইংরেজি ভাষায় লেখা। বইতে রঙিন ও সাদা-কালো মিলিয়ে মোট আশিটির মতো রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি মুদ্রিত হয়েছে। ঝকঝকে স্মার্ট প্রোডাকশান বলতে যা বোঝায়, সে কথা এই ছবির বই সম্পর্কে অবশ্যই খাটে।
লেখক এখানে তাঁর আলোচনার প্রধান অংশকে চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত করে সাজিয়েছেন। প্রথম অধ্যায়টির শিরোনাম হিসেবে বাংলায় বলা যেতে পারে: ছবির অভিমুখে যাত্রা। এই সূচনাপর্ব অনেকটা পটভূমি বা ইনট্রোডাকশনের ধাঁচে রবীন্দ্র-জীবনের জরুরি বাঁকগুলির পিছনে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির শিল্প-সংস্কৃতির পরিবেশটি সংক্ষেপে আলোচিত। পড়তে পড়তে মনে হতে পারে এটি ইংরেজি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখা, এবং তা তো সত্যিই। পরের অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথের ছবির ফর্ম বা আকার কী ভাবে গড়ে উঠেছে, সে প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। এ পর্বটিকে বাংলায় বলতে হয় ‘নিরাকার থেকে সাকারের দিকে’, তবে এ অংশটি অপেক্ষাকৃত স্বল্পাকার। লেখকের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এখানে ব্যবহৃত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কিছু চিঠি ও কবিতার টুকরো এবং পূর্ববর্তী আলোচকদের কিছু মূল্যবান উদ্ধৃতি।
তবে বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেখাটি রয়েছে তৃতীয় অধ্যায়ে। বাংলা রূপান্তরে এ অধ্যায়ের শিরোনাম হতে পারে সন্ধ্যার আলোকিত উদ্ভাস। লেখক এখানে রবীন্দ্রনাথের ছবির সূত্রে দেশ-বিদেশের নানান শিল্পীর কাজের রেফারেন্স দিয়েছেন। ভাবনা-চিন্তা আর উপস্থাপনা সব মিলে উপরোক্ত আলোচনাটি পাঠকের যথেষ্ট কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। যদিও এ আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের ছবির সঙ্গে অন্যান্য শিল্পীর কাজ নিয়ে তুলনা করার সময় সেই সব ছবির কয়েকটি উদাহরণ প্রত্যাশিত ছিল। কারণ, ভিস্যুয়াল আর্টের ক্ষেত্রে শব্দ দিয়ে হাজারো ব্যাখ্যা করলেও তার পাশে যদি একখানা ছবি এনে হাজির করা যায়, তা হলে মুহূর্তে সমস্ত বক্তব্য পরিষ্কার হয়ে ওঠে। যার পাশে সাজিয়ে দেওয়া রাশি-রাশি অক্ষরমালা নীরবে হার মানে। তাই সিরিয়াস পাঠকের কাছে, এই আলোচনায় উল্লিখিত বিদেশি শিল্পীদের কাজের নমুনার অভাব, লেখকের বক্তব্য বোঝার ক্ষেত্রে কিছুটা অসুবিধা ঘটায় বইকি! কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে এ অধ্যায়েই সর্বাপেক্ষা ঘন হয়ে উঠেছে বইয়ের মূল্যবান আলোচনাটি।
বিষয়ের দিক থেকে মুখ আর মুখোশ যে রবীন্দ্র চিত্রমালার অন্যতম প্রধান অংশ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে তাঁর তুলিতে নারী-প্রতিকৃতির এক আশ্চর্য আবেদন যে-কোনও দর্শককে নিস্তব্ধ করে দেয়। বইয়ের শেষ পর্বে এই দিকটি আলোচিত হয়েছে। আমাদের মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের আঁকা বিভিন্ন প্রতিকৃতি, মুখোশ এবং তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি মিলেমিশে চিত্রী রবীন্দ্রনাথ যেমন নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকেন, এবং অবশ্যই দৃঢ় ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন আমাদেরও মুখোমুখি। আর শিল্প-সাহিত্যের সব কিছুই তো এক অর্থে অটোবায়োগ্রাফিকাল, আত্মজীবনের উপাদান সেখানে পরতে পরতে মিশে যায়।
তবে, এ বইয়ে রবীন্দ্রনাথের চিত্রপ্রদর্শনীর তালিকায় উল্লিখিত ১৯২৮-এ কলাভবনের ‘নন্দন গ্যালারি’র এগজিবিশন বিষয়ে একটু সংশয় আছে। রবীন্দ্রনাথের চিঠির টুকরোয় নির্মলকুমারীকে লেখা ওই সম্ভাব্য অত্যন্ত ঘরোয়া প্রদর্শনীর আর কোনও খবর পাওয়া যায় না। এই আয়োজন ঘটে থাকলেও একে দস্তুর মতো রবীন্দ্রচিত্রের প্রথম প্রদর্শনী, এমন আখ্যা দেওয়া ঠিক হবে না। রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনী হিসেবে একে ঘোষণা করলে, আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আরও অনেক পিছনের দিকে সেই হিন্দু মেলার সময়ে, যেখানে বালক রবির ছবি বাঁধিয়ে সত্যিকার সর্বসাধারণের গোচরে আনা হয়েছিল। আর একটা কথাও এখানে স্মরণীয়, ‘নন্দন গ্যালারি’ হিসেবে তখনও কোনও প্রদর্শশালা কলাভবনে গড়ে ওঠেনি। তাই এখানে একটু বিভ্রান্তি থেকেই যায়।
আগেই বলেছি বইটির ছাপা বাঁধাই বেশ উঁচু মানের, তবে লে-আউট ডিজাইনের দিকে আরও একটু নজর দিলে ভাল হত। বিশেষ করে বইয়ের প্রচ্ছদে মেরুন রঙের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ওই বিখ্যাত আত্মপ্রতিকৃতি বেশ মার খেয়েছে। আর উনিশ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত রবীন্দ্র পাণ্ডুলিপির আঁকিবুকি-সহ গানের অনেকটা অংশ অনবধানতায় বাদ চলে যাওয়া বেশ দুঃখজনক।
এখানে একটা কথা বলা দরকার। ছবির বই প্রকাশের ক্ষেত্রে রঙের ব্যাপারটা দেখা খুবই জরুরি। আর রবীন্দ্রনাথের ছবি ছাপতে হলে তো কথাই নেই, অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়। রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ ছবির একটি প্রধান উপকরণ যেহেতু ওয়াটারপ্রুফ কালি, বিদেশি কালির সেই গ্লো, ফোটোগ্রাফির সময় ঠিকমত ধরতে পারা সহজ কথা নয়। আর ছবি ছাপানোর সময়েও সেই আশ্চর্য ঝলমলে দীপ্তি, পেলিকান কালির সেই দ্যুতি আনতে পারা বেশ কঠিন কাজ। এই বইয়ের বেশির ভাগ ছবি অবশ্য সে দিক থেকে অনেকটা উতরে গেলেও কয়েকটি ছবিতে রঙের একটু হেরফের ঘটেছে। আর মূলত সেটা ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রতিকৃতির ক্ষেত্রে, যেমন ৭৫ আর ৮৫ পৃষ্ঠার ছবি দু’টির প্রিন্ট বেশ দুর্বল ঠেকে।
অবশ্য এ সব দু-একটা ত্রুটি বাদ দিলে বইটি রবীন্দ্রজিজ্ঞাসুদের যথেষ্ট আকর্ষণ করবে বলে আশা করি। |
|
|
|
|
|