পুরীর পথে দুর্ঘটনায় মৃত রঘুনাথচকেরই ৫ জন |
দেবমাল্য বাগচি • হলদিয়া |
মাঠের ধারে এক মনে বাঁশের চালি বানাচ্ছিলেন বৃদ্ধ।
ডেবরার পথ দুর্ঘটনায় এলাকার পাঁচ জনের মৃত্যুর খবর ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে হলদিয়ার দুর্গাচক স্টেশন সংলগ্ন পূর্ব রঘুনাথচক গ্রামে। এক ধাক্কায় এত জনের মৃত্যু ও জখমের খবরে শোকস্তদ্ধ গ্রামবাসী। মৃতদের বাড়ি-বাড়ি কান্নার রোল। তারই সঙ্গে সঙ্গতে একটানা বাঁশ চেরাইয়ের শব্দ।
বৃহস্পতিবার রাত আটটা নাগাদ এই পূর্ব রঘুনাথচক থেকেই ৬৫ জন তীর্থযাত্রীকে নিয়ে পুরী রওনা হয়েছিল একটি বাস। রাত বারোটা নাগাদ পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরার ভগবানবসানে, ৬ নম্বর জাতীয় সড়কে এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন সেই বাসেরই যাত্রী ১০ মহিলা-সহ ১২ জন। আহত দুই শিশু-সহ ১৪ জন। সড়কের এক ধারে বাস দাঁড় করিয়ে চাকা পাল্টানোর কাজ হচ্ছিল। সেই সময়েই পিছন দিক থেকে অ্যাসিড বোঝাই একটি ট্যাঙ্কার এসে বাসে ধাক্কা মারে। সামনের দিকে কিছুটা গড়িয়ে উল্টে যায় বাসটি। গড়িয়ে যাওয়ার সময়েই সামনে দাঁড়ানো কয়েক জন যাত্রীকে পিষে দেয় বাসটি। যাঁদের বেশির ভাগই মহিলা। দুর্ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ৯ জনের। পরে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও ডেবরা হাসপাতালে আরও ৩ জনের মৃত্যু হয়। |
|
শোকস্তব্ধ রঘুনাথচক। বাঁশের চালি বাঁধতে ব্যস্ত বৃদ্ধ। |
শুক্রবার সকাল ১০টা নাগাদ রঘুনাথচক গ্রামে গিয়ে দেখা গেল চারদিকে থমথমে পরিবেশ। এরই মধ্যে ডেবরা থানা থেকে একটি ভ্যানে বাড়ি ফিরলেন মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসা গ্রামের আরও দশ জন। চোখে-মুখে আতঙ্কের রেশ তখনও কাটেনি। কোনও রকমে সামলে তাঁদেরই এক জন জহরলাল করণ বলেন, “চাকা ফেটে যেতেই দাঁড়িয়ে পড়ে বাস। আমাদের নামিয়ে সারানো হচ্ছিল। মহিলারাই মূলত সামনের দিকে ছিলেন। আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। হঠাৎ চিৎকারের শব্দ শুনে দেখি একটা ট্যাঙ্কার পেছন থেকে ধাক্কা মেরেছে। আর বাসটা হেলতে-দুলতে সামনের দিকে এগিয়ে পিষে দিল কয়েক জনকে। রাতের কথা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।”
দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে একই পরিবারের তিন বধূর মধ্যে শেফালি দাস (৩৮) ও ছায়ারানি দাসের (৪৬)। দুই ছেলে প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জিত ও জা ছায়ারানিকে সঙ্গে নিয়ে পুরী যাচ্ছিলেন শেফালিদেবী। দুই ছেলে বেঁচে গিয়েছে এ যাত্রায়। সামান্য চোট পাওয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসার পরে তাঁদের ছেড়েও দেওয়া হয়। দুর্ঘটনার ভয়াবহতায় ও মায়ের মৃত্যুশোকে কথা বলার শক্তি হারিয়েছে দুই ভাই। কোনও রকমে চোখের জল সামলে বছর পনেরোর চিরঞ্জিত বলে, “দুর্ঘটনার পরে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় মা মাটিতে পড়ে রয়েছে। চোখে-মুখে জল দিয়ে বার বার ডেকেছি। কিন্তু মা আর ওঠেনি।” |
|
মৃতের পড়শি-পরিজনেরা। |
অদূরেই বাড়ি মৃত রমেশ দাসের (৫৫)। যাত্রাদলে লাইট ও মাইকের কাজ করতেন তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন বাকি সদস্যরা। মৃতের স্ত্রী ছবিরানি দাস বলেন, “বাড়িতে কিছু না বলেই এই ভাবে ঘুরতে চলে যেত ও। এ বারও না বলেই গিয়েছিল। কিন্তু ও যে আর কোনও দিন আসবে না তা তো দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।”
স্বামী সুদর্শন বেরা ও দেওরের ছেলে রাহুলের সঙ্গে পুরী যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে গ্রামেরই মিনতিদেবীর (৪৫)। তাঁর পুত্রবধূ ঝর্না বেরা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “মায়ের সঙ্গেই বেশি সময় কাটাতাম। এখন ওনাকে ছাড়া কী ভাবে দিন কাটবে জানি না। আমি একা হয়ে গেলাম।” গ্রামের বধূ মালতি দোলইয়ের (৫৫) মৃত্যুসংবাদ শুনে শ্বশুরবাড়ি থেকে ছুটে এসেছেন তাঁর তিন বিবাহিত কন্যা। ছেলে কার্তিক দোলই রওনা দিয়েছে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের উদ্দেশে। বাড়ির উঠোনে বসে পুত্রবধূ কনকদেবী বলেন, “ভোরেই দুর্ঘটনার খবর পাই আমরা। সকলেই একেবারে ভেঙে পড়েছে।” |
মৃতের তালিকা |
ছায়ারানি দাস (৪৬)।
সনকা মাইতি (৫০)।
কনা মাইতি (৫৬)।
মিনতি বেরা (৪৫)।
শেফালি দাস (৩৮)।
অলকা মাইতি (৫৩)।
আরতি প্রামাণিক (৪৬)।
মালতি দোলই (৫৫)।
কাজল দাস (৬৫)।
মমতা মিশ্র (৩৮)।
সৌমেন উত্থাসিনী (২৩)।
রমেশ দাস (৫৫)। |
|
ছবি তুলেছেন আরিফ ইকবাল খান। |
|