প্রতি পক্ষ
আলোয় ঢাকা অন্ধকার...
লো নেই? উঁহু, কে বলল নেই? আছে। আপনারা যা দেখেন, ঠিক সে রকম নয়। আলো মানে একটা অনুভূতি। সেটা ঠিক কী রকম তা বুঝিয়ে বলা অসম্ভব। আমার এই প্রায়-জন্মান্ধ চোখে কালী মানে একটা আলো।
আলো? কিন্তু, কালী বলতে তো বরাবর অন্ধকারটাই ভেসে ওঠে।
না, আমার কাছে আলো। ওই যে বললাম, ঠিক কী রকম আলো, তার ঠিকানা আপনাকে দিতে পারব না। এটা যে নিজে বুঝেছে, শুধু সে-ই বুঝতে পারে।
তবু...
আহ্হ, কী করে বলি? আচ্ছা, আমাকে বোঝান দেখি, চাঁদটা কেমন দেখতে!
চাঁদ...মানে...
হ্যাঁ, চাঁদের ছবিটা বোঝাতে গেলেই আপনাকে কোনও না কোনও একটা ছবির কথা পাড়তে হবে। চাঁদ মানে এই। চাঁদ মানে ওই। একটা কোনও চেনা ছবির আদল দিয়ে অন্য একটা ছবিকে বোঝানো। কিন্তু, আমার চোখে তো কোনও ছবি নেই। কী করে বুঝব, আপনি কার কথা বলছেন, তার রং কী রকম, গড়ন কী রকম...তা বলে কি আমি চাঁদ জানি না? জানি। আমার মতো করেই জানি। কালীও ঠিক সে রকম। অনেকটা আলো। আর শব্দ...
একেবারে অডিও-ভিস্যুয়াল!
(হাসি) ঠিক, অডিও-ভিসুয়্যাল। থাকতাম পাইকপাড়ায়, জানেন, কালীপুজোর দিন, নাকি রাত, কালীপুজোর রাত মানে আমার কাছে একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতা। হালে তো শব্দবিধি-টিধি হয়েছে, বোমাটোমার আওয়াজ কমেছে, তখন অত নিয়মকানুন ছিল না, কালীপুজোয় বোমা ফাটত বিস্তর, চকোলেট বোম, দোদোমা, আরও কত রকম হাড়-কাঁপানো বোম, এ দিক ও দিক গুমগুম আওয়াজ, কখনও কালীপটকা ফাটছে পরপর, কয়েক সেকেন্ড অন্তর অন্তর হু-উ-শ হু-উ-শ সব আওয়াজ পাচ্ছি, ওগুলো নাকি আকাশে উড়ে যায়, নাম হাউই। আর, আলো...তুবড়ি, রং মশাল...কত আলো...আমি একা বসে আছি, সিঁটিয়ে। অবশ্য, আরও একটা আওয়াজ ছিল।
কী?
ভুলে গেলেন, শ্যামাসঙ্গীত।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক...
এখন তো বক্স হয়েছে, তখন পুজো মানেই রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট-এ লাগানো লম্বা লম্বা সব চোঙা, আর কালীপুজো মানেই তাতে পান্নালাল ভট্টাচার্য।
ঠিক। পান্নালাল আর ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। কালীপুজো মানেই কলকাতার ঘুম ভাঙছে ‘শ্যামা মা কি আমার কালো রে’ কিংবা ‘আমার সাধ না মিটিল আশা না পূরিল’। ভোর থেকে শুরু হয়েছে গান। ঘুমের মধ্যেও একটু একটু করে হানা দিচ্ছে। সেই শব্দের পথ ধরেই আমার অন্ধকার-মাখা চোখে কালীপুজোর আলো এসে হাজির হত।
অন্ধকার-মাখা চোখে...আলো!
ওটাই তো মজা। আপনারা যাঁরা দেখতে পান, চক্ষুষ্মান, তাঁরা অনেকেই ভাবেন, সম্পূর্ণ অন্ধ মানে হয়তো চোখের সামনে নিকষ কালো ছাড়া আর কিছুই নেই। সে কথা আমাদের বলেনও অনেকে। আমরা হাসি। মনে মনে। সব সময় সামনে তো আর হাসতে পারি না (মৃদু হাসি), খারাপ দেখায়, তাই ভেতরে ভেতরে হাসি। কিন্তু, আলো নামে একটা জিনিস আমাদের চোখেও ধরা দেয়। সেটা কী আপনারা বুঝবেন না। আমিও বোঝাতে পারব না। রবি ঠাকুরের একটা গান, শুনেছেন নিশ্চয়ই...
কোন গান?
চেনা। অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো, সেই তো তোমার আলো।
হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনেছি।
জানেন, আমাদের নিয়ে লেখালিখির সময় এই গানটার কথা কেউ কেউ লেখেন, আগেও লিখেছেন, পরেও লিখবেন হয়তো, কালীর প্রসঙ্গেও এই গানটার কথা আসে। কিন্তু, ঠিক কেমন সেই আলো, অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত? রবি ঠাকুর একটা গভীর কথা লিখে গিয়েছেন। তার মানেটা আপনাদের কাছে এক রকম। আমাদের কাছে আর এক। অন্ধকার যে শুধুই একটা ঠাস কালো দেওয়াল নয়, তারও একটা আলো আছে, সে কথা নানা সময়েই বুঝেছি। আর বিশেষ করে, কালীপুজোর রাতে তো সেই জিনিসটা অদ্ভুত ভাবে ধরা দিত আমাদের কাছে। আপনার সামনে একটা তুবড়ি জ্বলে উঠছে, বা ধরা যাক, বেশ কয়েকটা রংমশাল আলো ছড়াচ্ছে, আপনি বুঝতে পারছেন...
আলোয়? মানে, আলোটা দেখে...
শুধু আলো, গন্ধ নেই? বাজির ধোঁয়ার গন্ধ। কালীপুজোর রাতের গায়ে একটা অদ্ভুত গন্ধ পাননি কখনও? বাজির গন্ধ, আলোর গন্ধ, একটানা শ্যামাসঙ্গীতের গন্ধ, পুজোর ছুটি ফুরিয়ে আসার গন্ধ...
হ্যাঁ...
আসলে চোখে দেখলে, কী জানি, আমরা বোধহয় ভুলেই যাই, আমাদের অন্য আরও কয়েকটা ইন্দ্রিয় আছে! সরি, অন্যায় কিছু বললে মাফ করে দেবেন।
না না, ঠিকই তো!
যা বলছিলাম...ইয়ে চা খাবেন? অনেকক্ষণ কথা বলছি, অ্যাই, একটু চা...দ্যাখ না, একটু চা কোথায়...ভাঁড়ে বলবি।
আরে ঠিক আছে, চা-টা আবার কেন?
উঁহু, টা দিচ্ছি না, একটু চা তো খান। যাক গে, গন্ধের কথা হচ্ছিল। আবার শব্দ মানেই বুঝি বোমা আর শ্যামাসঙ্গীত শুধু? মোটেই নয়। রাতের বেলা বাজির আওয়াজে, আলোয় কা কা করে ডেকে উঠছে কাক, ডানা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে আরও কত পাখি, আওয়াজ পাননি? বা, অনেক রাতে, যখন বোমাটোমা একটু কমেছে, তখন বিছানায় শুয়ে পড়ার পরে দূর থেকে ভেসে আসছে ঘণ্টাধ্বনি। পুজো হচ্ছে! কোত্থেকে কোথায় চলে এলাম, দেখুন। বলছিলাম তো রবি ঠাকুর...
অন্ধকারের উৎস হতে...
হ্যাঁ, ওই গানটা আমরা যে ভাবে অনুভব করেছি, করি, সে ভাবে আর কেউ, মানে ওই আর কি, দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন আর কেউ করতে পারবে বলে তো মনে হয় না। সেটা সম্ভবও নয়। যাক গে, এ বার আপনি বলুন, তখন থেকে তো নিজেই বকবক করছি।
না, আমার তো কয়েকটা প্রশ্ন শুধু...একটা কথা বলি। আমরা কালী বলতে অন্ধকারটাই আগে বুঝি। তিনি অন্ধকারের প্রতিমা, রবি ঠাকুরের কথা ধার করে বললে, নিবিড় অমা তিমির... অথচ, আপনারা কালী বলতে আলোর কথা আনছেন। কেন?
ঠিক। আলোর কথাই আনছি। কারণ, কালী মানে একটা বিরাট অন্ধকার, সেই জিনিসটা আমার কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়। অনেক আলোর মধ্যে থাকলে একটা অন্ধকারের প্রতিমা গড়া যায় হয়তো, কিন্তু, অনেক অন্ধকারের মধ্যে থাকলে? যদি ধরেন যে অন্ধকারের শরীরের মধ্যেই আমরা বাস করি, সেই আঁধারের মধ্যে আবার কালী নামের একটি আঁধারের আকার কেমন হয়, সেই হদিশ, কী জানি, আমি ততটা বুঝতে পারি না। তবে, এখানে অন্য একটা কথা আছে।
কী?
জানেন, জন্মের পরে বছর দুয়েক আমার চোখে দৃষ্টি ছিল। তার পরে, আস্তে আস্তে সেটা চলে গেল। আর দু’বছর যে আলো দেখেছিলাম, তার কোনও স্মৃতিও আমার চোখে নেই। মাঝে মাঝে যেন মনে পড়ে কিছু আদল, কোথায় যেন একটা কাঠের সিঁড়ি মতো ছিল, কিন্তু সে-ও খুব আবছা, বলতে গেলে না-থাকারই মতো। যাক গে, পাড়ায় আমাদের একটা কালীমন্দির ছিল। আমার ছোটবেলাটা অনেকখানি সেখানেই কেটেছে।
তাই নাকি? কালীমন্দির!
হ্যাঁ। হুটোপাটি করতাম। বসে থাকতাম। আর, কালীমূর্তি গড়তাম।
মূর্তি!
কেন, দেখতে না পেলে মূর্তি গড়তে নেই বুঝি?
না না, তা কেন? আসলে অবাক লাগল, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
আমার কালীমূর্তি কেমন ছিল বলুন তো? চারটে হাত। দুটো পা। আর জিভ। মুখ থেকে বেরিয়ে আসা একটা বিরাট জিভ! কী যেন বলে, লোলজিহ্বা! ওই লোলজিহ্বাটিই আমার কালী! সেই জিভের চারপাশে যা থাকবে, সেটাই মুখ। আপনারা এ রকম করে ভাবেন না, জানি, কিন্তু আমার কালীঠাকুর এ রকমই ছিল...কী হল, চুপ করে গেলেন যে...
না, আসলে ‘সুবর্ণরেখা’র কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই বহুরূপী, কালী সেজে এসে দাঁড়াল, বিরাট জিভ...
ঠিক। ঋত্বিক ঘটক। ছবিটা দেখিনি, তবে শুনেছি। ওই বিরাট জিভটাই আমার কাছে কালী। একটা বাচ্চা মাটির তাল নিয়ে থাবড়ে থাবড়ে কালীমূর্তি, আর ঠিকঠাক বললে একটা জিভ গড়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, এই ছবিটা...হ্যাঁ, ছবিই বলব, আমি মনের ভেতরে স্পষ্ট দেখতে পাই।
দেখতে পান?
খটকা লাগল? কিন্তু, দেখি। আমি, সুভাষ দে, জানেন তো মঞ্চে অভিনয় করি। দর্শকেরা আমাদের দেখেন। আমিও দর্শকদের দেখি। শুধু, ওঁরা যে ভাবে আমাদের দেখেন, আমরা ঠিক ওই ভাবে দেখি না, কিন্তু তাতে তো আর দেখাটা মিথ্যে হয়ে যায় না। আর, এই আমরা যারা এক সঙ্গে ‘অন্য দেশ’-এ নাটকের কাজ করি, এই যে, এরা...এরাও অন্ধ, শিবশঙ্কর বর্মা, চন্দন দে আর সুকুমার সাঁতরা, ওদের জিজ্ঞেস করুন, কালীপুজো আমরা দেখতে পাই কি না! কী গো? বলো সবাই! (সকলের হাসি) আর ওই যে দিলীপ, দিলীপ সরদার, ও অবশ্য দেখতে পায়, কিন্তু ও জানে, আমরাও দেখতে পাই! সুকুমার রায়ের সেই কবিতাটা পড়েছেন নিশ্চয়ই, সেই যে আবোল তাবোল-এ ছিল, আলোয়-ঢাকা অন্ধকার, ঘণ্টা বাজে গন্ধে তার...ও রকমই আমাদের কালীপুজো। শব্দ, গন্ধ, আলো, অন্ধকার...

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.