ধোনিদের সিরিজ জয় সাঙ্গ হল, না সিরিজ সবে শুরু হল? বিশ্বকাপ জয়ের শহরে এসে দ্বিতীয়টাই তো মনে হচ্ছে!
২ এপ্রিলের সেই মায়াবী রাতের পর এই প্রথম মুম্বইতে পদার্পণ ঘটছে ধোনির দৈত্যদের। এক দিকে কাপ জেতার মধুর স্মৃতি রোমন্থন। অন্য দিকে ইংল্যান্ডে কালা সফরের দুঃসহ স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা। আরব সাগরের পারে দুই বিপরীতধর্মী ক্রিকেট রঙের সহাবস্থান। আর পাঁচটা সিরিজে যেমন ট্রফির ফয়সালা হয়ে যাওয়ার পরে আগ্রহে ভাঁটার টান লক্ষ করা যায়, সচিন তেন্ডুলকরের শহরে মোটেও তেমন নয়। উল্টে ক্রিকেটের ঢাক যেন আরও বেশি করে বাজছে। হোটেল কর্তৃপক্ষ কী ভাবে কাপজয়ী অধিনায়কের মুম্বই-প্রত্যাবর্তনকে বরণ করবে, তা নিয়ে ভাবছে। বিকেলের দিকে ভারতীয় ক্রিকেটাররা হোটেলে ঢুকে পড়ার সময় যে রকম অভ্যর্থনা পেলেন, দেখে মনে হবে না তাঁরা নতুন সিরিজ খেলতে এসেছেন। মনে হবে, সাড়ে ছ’মাস পরে কাপ জয়ের সংবর্ধনা নিতে মুম্বই ফিরলেন। ক্লান্তি আর ঘরে ফেরার তাড়ায় সেই সময় যা নেওয়া হয়নি। শনিবার সকালে এখান থেকে বেরিয়ে ওয়াংখেড়েতে চতুর্থ ওয়ান ডে-র নেট প্র্যাক্টিসে তাঁরা যাবেন না। যাবেন মোটরকেড সংবর্ধনায় গোটা শহর ঘুরতে।
এবং কী আশ্চর্য! কাপ জয়ের ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের লগ্নে ধোনির সারথিরাও সব হাজির। যাঁরা কিনা ২ এপ্রিলের মহাযজ্ঞে মহাসমারোহে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু চলতি এক দিনের সিরিজে নেই। যেমন সচিন তেন্ডুলকর। মুম্বই তাঁর নিজের শহর ঠিকই। কিন্তু সিরিজে তো নেই। সদ্য ট্রেনিং শুরু করেছেন। কিন্তু সকাল থেকে তাঁকে নিয়ে বিস্তর হুড়োহুড়ি। নতুন বাড়িতে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করার জন্য জরিমানা দিতে হয়েছে বলে নয়। ছুটোছুটি এই কারণে যেহেতু সকাল থেকে বিমানবন্দরের পাশে একটি পণ্যের কাজে দীর্ঘ অনুষ্ঠান চলছে তাঁর। সেখানে নগদ টাকা ছাড়াও বিজয়ীদের জন্য পুরস্কার সচিনের সঙ্গে ছবি তোলার বরাত।
বিলাসবহুল হোটেলের সেই অনুষ্ঠানে সংবাদমাধ্যমের উপচে পড়া ভিড়। প্রতিযোগী, বিজেতা, আয়োজক, ব্যান্ড, ডান্স গ্রুপ মিলিয়ে রীতিমতো উৎসব যাপনের পরিবেশ। এক বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দিতে গিয়ে সচিন সেখানে বললেন, “জীবনে সাফল্যের কোনও শর্টকার্ট রাস্তা নেই। পরিশ্রম এবং কঠোর পরিশ্রম এটাই এক এবং একমাত্র পথ।” বিজয়ীরা সে সবের মধ্যেই একই সঙ্গে বাড়িয়ে দিয়েছেন শুভেচ্ছা আর অভিনন্দনের হাত। অভিনন্দন বিশ্বকাপ জেতার জন্য। আর শুভেচ্ছা শততম সেঞ্চুরির। একজন তার মধ্যেই সারা দেশের আবেদনটা পেশ করে ফেললেন। “সবাই এখন ওই মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করছি। কবে আপনার একশোতম সেঞ্চুরিটা হবে!” সচিন শুধু হাসলেন। কোনও জবাব দিলেন না।
|
নিরানব্বই সেঞ্চুরির মালিককে নিয়ে বিমানবন্দরের পাশে যখন এ রকম মাতামাতি চলছে, তখন বিশ্বকাপের ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট আবার শহরের কেন্দ্রস্থলে অন্য অনুষ্ঠানে ব্যস্ত। যুবরাজ সিংহ জানা গেল তিনিও মুম্বইতে এবং সকাল থেকে সচিনের মতোই ব্যস্ত। একটা পণ্যের প্রচার সেরে এখন যাচ্ছেন সোহা আলি খানের সঙ্গে আর একটা অনুষ্ঠানে। সংবাদমাধ্যম সচিনের অনুষ্ঠান সেরে সেখানে ছুটল। সেখানে আর এক রাউন্ড কাপ জয়ের স্মৃতি রিওয়াইন্ড হল। শ্রীসন্থ। তিনিও দু’তিন দিন ধরে মুম্বইতে। চোটের জন্য তিনিও চলতি সিরিজে নেই। কিন্তু তাতে কী হল? বিশ্বকাপ ফাইনালে তো ছিলেন। ততক্ষণে তিনি বলে দিয়েছেন, কাপ-জয়ের শহরে ফেরার অনুভূতিটাই আলাদা। ২ এপ্রিলের পর এই প্রথম এলাম এখানে। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই ঐতিহাসিক রাতের কথা!
মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে এই আবহের মধ্যে আবিষ্কার করে মনে হবে তিনি হচ্ছেন মুম্বইয়ের নবনির্মিত সি-লিঙ্ক ব্রিজের মতোই ভারতীয় ক্রিকেটের সেতুবন্ধনকারী। মধ্য অক্টোবরের অল্প শীতের আমেজের মধ্যে মেরিন ড্রাইভের ওপর দু’টো দলের মধ্যে পারাপারের দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে। একটা তাঁর বিশ্বকাপজয়ী দল। যেটা এখনও প্রথম দল। আর একটা চলতি সিরিজের তরুণ ব্রিগেড। সমুদ্রের ঢেউয়ের আনাগোনার মতোই একটা দলের হাত থেকে ব্যাটন চলে যাবে আর এক প্রজন্মের হাতে। আর ধোনি সেনাপতি হিসেবে কখনও দেখবেন বিশ্বকাপের সেরা ক্রিকেটার যুবরাজ সিংহ বেরিয়ে যাচ্ছেন। কখনও দেখবেন অজিঙ্ক রাহানে নামের তরুণ উঠে আসছেন। গত কালই মোহালিতে সিরিজ জিতে উঠে বলেছেন, ‘বদলা’র মতো একটা কঠোর শব্দ খেলাধুলোর দুনিয়ায় থাকা উচিত নয়।
এমনিতে অসাধারণ উদাহরণ তৈরি করা মন্তব্য। ক্রিকেট অধিনায়কের মতো নয়। তাঁকে দেখাচ্ছিল ক্রিকেট-দূতের মতো। যেমন দেখিয়েছিল ইংল্যান্ডে ইয়ান বেলকে ফিরিয়ে আনার সময়। কিন্তু একদম মনের কথা জানতে চাইলে নিশ্চয়ই এর সঙ্গে যোগ করবেন, এই সিরিজটা পর্যন্ত শব্দটা না-হয় থাক। অন্তত ওয়াংখেড়ে বা ইডেন নিয়ে তাঁর যা চিন্তাভাবনার ছবি পাওয়া গেল, তাতে তাই মনে হচ্ছে। একে তো তাঁর ক্রিকেটীয় স্পিরিটের বিনিময়ে ইংল্যান্ডের প্লেয়াররা অশ্রাব্য গালিগালাজ ফিরিয়ে দিচ্ছে। ব্যক্তিগত মন্তব্য করতেও ছাড়ছে না। যা নিয়ে খোলাখুলি ক্ষোভ প্রকাশ করতে ছাড়েননি। টিম ব্রেসনানের এ দিন ম্যাচ-ফির মাত্র ৭.৫ শতাংশ জরিমানা করলেন ম্যাচ রেফারি রোশন মহানামা। ভারতীয় শিবির মনে করছে, জরিমানা শুধু কম নয়, একই অপরাধ করে ইংল্যান্ডের আরও কয়েক জন ক্রিকেটার পার পেয়ে যাচ্ছেন। এই জিনিস তাঁরা করলে ম্যাচ সাসপেনশনের ধারা এসে পড়ত।
সচরাচর ৩-০ সিরিজ জিতে যাওয়া মানে বাকি দুই ম্যাচে রিজার্ভ বেঞ্চকে সুযোগ দেওয়ার একটা ব্যাপার থাকে। কিন্তু এখানে তো নিছকই একটা সিরিজ চলছে না। চলছে কালা সফরের বদলা সফর। এখানে সিরিজ জিতলে তো ট্রফি নেই। আছে একমাত্র ৫-০ করতে পারলে তবেই। ধোনি তাই বিশ্রামের ভাবনা-টাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন। “আমরা বাকি দু’টো ম্যাচে সেরা দলই নামাতে চাই। উমেশ যাদবের চোট লেগেছে। ওর জায়গায় নতুন কেউ আসবে হয়তো। আর কোনও বদলের আশা কম,” বলে দিচ্ছেন তিনি। আপনার নিজের বিশ্রাম? সেটার কী হবে? ধোনি এ বার যেন হেলিকপ্টার শট বের করলেন। “আমি মাত্র ৩০ আর যথেষ্ট তরুণও, তাই না?”
কী দাঁড়াল? না, গোটা দেশের কাছে কাপ-জয়ের শহর। সচিন-যুবরাজদের কাছে ক্রিকেট-কোহিনূর জেতার শহর। আর কাপ-জয়ী অধিনায়কের কাছে আপাতত বদলার শপথ পূরণের শহর। ২ এপ্রিলের সুখস্মৃতিতে ডুবে বিশ্রামের কেদারায় গা এলিয়ে দেওয়ার সুযোগ কোথায়?
|
কুকদের একহাত নিলেন যুবরাজ
সংবাদসংস্থা • মুম্বই |
মাঠে গালিগালাজের জন্য এ বার অ্যালিস্টার কুকের ইংল্যান্ডকে একহাত নিলেন যুবরাজ সিংহ। তাঁর কথায়, “ইঁটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হবে!” রীতিমতো ক্ষুব্ধ যুবরাজ এক অনুষ্ঠানে বলে দেন, “ব্রিটিশ ক্রিকেটার আর ওদের মিডিয়া বড্ড বেশি কথা বলছে। ওদের বোঝা উচিত ‘হোয়াট গোজ অ্যারাউন্ড কামস অ্যারাউন্ড।’ আপনি কাউকে অহেতুক গালাগালি করলে সেটা ফিরে আসে। ইংল্যান্ড প্লেয়াররা মাঠে কী বলছে না বলছে তা নিয়ে ওদের সতর্ক থাকা উচিত।” যুবরাজ পাশাপাশি ভারতীয় দলের প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত, “আমাদের তরুণরা নিজেদের কাঁধে দায়িত্বটা নিয়েছে।” বিরাট কোহলির নাম আলাদা করে বলেছেন “বিরাট সহজাত এবং খুব আকর্ষণীয় ক্রিকেটার। বল হাতেও টিমের কাজে লাগতে পারে। ফিল্ডার হিসাবেও অবদান অস্বীকার করা যায় না।” আঙুল ভাঙার জন্য চলতি একদিনের সিরিজে খেলতে পারছেন না যুবরাজ। জানিয়েছেন, তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন।
|