বার্সেলোনার মতো অন্য গ্রহের দল! নেই। ম্যাঞ্চেস্টার সিটি বা প্যারিস সাঁজা-র মতো অর্থে উপচে পড়া দল! নেই। জুভেন্তাসের মতো ভস্ম থেকে উঠে আসা দল! নেই। বায়ার্ন মিউনিখের মতো ধারাবাহিক দল! নেই।
ঝড় তুলে দেওয়া নতুন কোনও নাম কি উঠে আসবে? না। রাতারাতি সব কিছু ঝলসে দেওয়ার মতো চমৎকার কোনও ঘটনা ঘটবে? না।
ফিফার ১৬০ নম্বর দেশের জাতীয় লিগে যা হয় আর কী!
তবু শনিবার ভারতীয় ফুটবলের ক্লাসরুমে হাজির হয়ে আই লিগ বলে উঠছে, “প্রেজেন্ট স্যর”।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের লোগোটা মুখস্থ হয়ে আছে সবার। সিংহের মাথায় মুকুট, পায়ে বল। ঘনঘন টিভিতে দেখে পাড়ার মাসিমাদেরও চেনা এখন।
আই পি এল শুরুর মাস খানেক আগে শপিং মল থেকে র্যাম্প শোকত বৈচিত্রময় অনুষ্ঠান।
এখানে, এই আই লিগে এ সব কিস্যু পাবেন না।
খুব ভাগ্যবান হলে শুধু দু’চারটে ট্যাবলো কলকাতায় রাস্তায় ঘুরতে দেখেছেন আপনি।
ওহ, ওই গাড়িগুলোর গায়ে লেখা ছিল ‘আই লিগ’।
স্রেফ দু’দিনের জন্যই প্রচার। তার পরে আরও কমে যাচ্ছে ট্যাবলো। শুরুতেই কলকাতায় ইস্টবেঙ্গল বনাম চার্চিল ব্রাদার্স, মারগাওতে সালগাওকর বনাম ডেম্পো। পুণে, বেঙ্গালুরুতেও ম্যাচ। আমজনতার জানার জন্য এ আই এফ এফ কিছুই করেনি। কর্তাদের মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরেছে এ ক’দিন। আই লিগ নিয়ে ভাস্কোর মামলা। সকালেই ভাস্কো পিছু হটায় এ আই এফ এফে যুদ্ধ জয়ের হাওয়া। আই লিগের যুদ্ধ সেই পুরনো আবহেই শুরু হচ্ছে। পঞ্চাশটি ঢাকের শব্দে। ঢাক এত পুরনো বাদ্যযন্ত্র, ভারতীয় ফুটবলের সঙ্গে এটাই মানায়!
শুক্রবার সকালের যুবভারতীতে ইস্টবেঙ্গলের অ্যালান গাওয়ের চুলের মাঝখানে দেখা গেল, নতুন রামধনু রং। সামান্য বাদে চার্চিলের বেটো হাজির প্র্যাক্টিসে। তাঁর চুলেও নতুন কাট। “নতুন টুর্নামেন্ট, তাই নতুন স্টাইল।” মজা করে বলে গেলেন বেটো। |
এ আই এফ এফ কি আই লিগে এমন নতুন স্টাইল কিছু দেবে?
নিশ্চিত থাকুন, মাত্র দুটো নতুন জিনিস থাকছে। লিগের একটা নতুন, ছোট্ট লোগো এবং আন্তর্জাতিক স্পোর্টস চ্যানেলে আই লিগের প্রত্যাবর্তন। সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় ফুটবলে সবচেয়ে সাড়া জাগানো দুই ভারতীয় নামও এ বার আই লিগে নেই। ভাইচুং ভুটিয়া এবং সুব্রত পাল।
বেঞ্চে বসে সতীর্থদের প্র্যাক্টিস দেখছিলেন মেহতাব হোসেন। গত আই লিগের সেরা ভারতীয় ফুটবলারও চোটের জন্য প্রথম দুটো ম্যাচে নেই। নতুন প্রজন্মের কোন ফুটবলার এ বার চোখ টানবেন? মেহতাবের চোখে এক নম্বর এখন চার্চিলের মালয়ালী মিডফিল্ডার জাকির মুন্ডামপারা। তার পরে একে একে বললেন, পুণে এফ সি-র জেজে, ইস্টবেঙ্গলের রাজু গায়কোয়াড়, পৈলান অ্যারোজের মিলন সিংহ, মোহনবাগানের জুয়েল রাজার নাম।
জাতীয় লিগ জেতা কলকাতার তিন কোচ আপাতত লিগের উত্তাপ থেকে বহু দূরে। সুভাষ ভৌমিক, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সাব্বির আলির ভবিষ্যদ্বাণী শুনলে আই লিগের ছবিটা কিঞ্চিৎ স্পষ্ট হতে বাধ্য।
আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হতে কোন ব্যাপারটা সবচেয়ে জরুরি? সুভাষ: দলে সিনিয়র-জুনিয়র ব্যালেন্স দরকার। রিজার্ভ বেঞ্চ ভাল হতে হবে। মালি থেকে কর্তা সবার বোঝাপড়া জরুরি। মনোরঞ্জন: রিজার্ভ বেঞ্চ ভাল থাকতে হবে। অঙ্ক কষে খেলা দরকার। সাব্বির: আত্মবিশ্বাস ও শৃঙ্খলা দরকার। ড্রেসিংরুমের পরিবেশ ভাল হওয়া জরুরি। সালগাওকর গতবার এটা দেখিয়েছে।
এর পরে অবধারিত প্রশ্ন, কোন চারটে দল ফেভারিট?
কেউ কাউকে এগিয়ে রাখছেন না। কিন্তু কলকাতার দুটো বড় দলই থাকছে। সুভাষ: চার্চিল, ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, ডেম্পো। মনোরঞ্জন: ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, সালগাওকর, ডেম্পো। সাব্বির: ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, ডেম্পো, সালগাওকর।
কারা তারকা হবেন তা হলে? সুভাষ:১) বেটো ২) ওডাফা ৩) ওপারা। মনোরঞ্জন: ১) বেটো ২) চিডি ৩) ওপারা।
সাব্বির: ১) টোলগে ২) ওডাফা ৩) হেনরি।
এমনিতে আই লিগের দলগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা সোজা। যারা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য খেলবে: সালগাওকর, ইস্টবেঙ্গল, ডেম্পো, চার্চিল, মোহনবাগান। যারা চ্যাম্পিয়ন না হলেও সবার চিন্তার: পুণে এফ সি, প্রয়াগ ইউনাইটেড, লাজং। যারা অবনমন বাঁচালেই খুশি: এয়ার ইন্ডিয়া, মুম্বই এফ সি, চিরাগ কেরল, স্পোর্টিং ক্লুব, হ্যাল। এবং কলকাতার চার নম্বর দল, পৈলান অ্যারোজ বোধহয় সারা বিশ্বের লিগে একমাত্র দল, যাদের অবনমন নেই।
কোচদের অঙ্ক, হিসেব শুরু হয়ে গিয়েছে। কোনটাতে তিন পয়েন্ট চাই। কোনটাতে এক পয়েন্ট। সুভাষ-মনোরঞ্জনদের অভিজ্ঞতা বলছে, “প্রথম পাঁচটা ম্যাচে খারাপ খেললেই চ্যাম্পিয়ন হওয়া অসম্ভব।”
শনিবারের যুবভারতীতে দুই প্রতিপক্ষের দুই বিদেশি কোচের অন্য হিসেব।
ট্রেভর মর্গ্যান এখন একটুতেই মেজাজ হারাচ্ছেন। এ দিনও এক সাংবাদিকের সঙ্গে দৃষ্টিকটু আচরণ করলেন। গাও, না টোলগেএই বিষয় নিয়ে ইস্টবেঙ্গল দু’ভাগ। ব্যাপারটা আপাতত মিটে গিয়েও মিটছে না। দু’জনকেই নথিবদ্ধ করার পরেও যে সমস্যা থাকছে, তা শান্ত মর্গ্যানের উত্তেজিত হওয়া থেকেই স্পষ্ট। সুপার কাপ জিতেও হাসিখুশি লোকটা হারিয়ে যাচ্ছে। ধরা পড়ছে চাপ। সুব্রত ভট্টাচার্যরই বরং মনে হচ্ছে চাপ কম।
|
ব্রিটিশ কোচের অন্দরমহল |
দলের খবর: কোচ মর্গ্যান খুব চাপে। গাওকে কেন্দ্র করে কর্তাদের সঙ্গে সংঘাত চাপা থাকছে না। কোচকে ঘনঘন মেজাজ হারাতে দেখে টিমের অনেকে অবাক।
চোট-আঘাত: মেহতাব হোসেন প্রথম দুটো ম্যাচে নেই। রাজু গায়কোয়াড়, অভিষেক দাস চোটের জন্য নেই।
প্রথম দল: সুপার কাপের দলটাকেই নামাতে চান মর্গ্যান। টোলগের বদলে গাওকেই পছন্দ। মেহতাবের জায়গায় সুশান্ত ম্যাথু।
কাদের দেখবেন: ওপারা, পেন, গাও।
কোচ উবাচ: আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়েছে সুপার কাপ জিতে, ভিয়েতনামে খেলে। অতীতে কে কী খেলেছে, সেটা ভাবছি না। আগের সব ভুলে নতুন চিন্তা। |
|
পর্তুগিজ কোচের অন্দরমহল |
দলের খবর: পর্তুগিজ কোচ ম্যানুয়েল গোমস বলছেন, চোট সারেনি বলে বেটোকে খেলাব না। বেটো নিজে পারলে খেলতে চান। কোচ বলছেন, অরিন্দম ভারতের অন্যতম সেরা কিপার। কিন্তু চোট সারেনি বলে খেলছেন না। অরিন্দম নিজে বলছেন, আমি খেলার মতো ফিট।
চোট-আঘাত: মহম্মদ রফি চোটের জন্য আসেনি।
প্রথম দল: বেটো না খেললে প্রধান ভরসা গ্যাবনের স্ট্রাইকার হেনরি। গোলে অরিন্দমের জায়গায় ফেলিক্স ডিসুজা।
কাদের দেখবেন: গৌরমাঙ্গি, স্টিভন ডায়াস, হেনরি
কোচ উবাচ: ইস্টবেঙ্গল সুপার কাপ জিতেছে। আমরা ডুরান্ড কাপ। দুটোই ভাল দল। এখানে এত বড় স্টেডিয়াম, এত ভাল ঘাস। দারুণ খেলা হবে। |
|
বেটোদের কোচ ম্যানুয়েল গোমস ২০০২ বিশ্বকাপে ফিগোদের সহকারী কোচ ছিলেন। বাঙালি বাঙালি দেখতে গোমস মারাত্মক শান্ত। সুভাষ-মনোরঞ্জনদের চোখে আই লিগের এক নম্বর বেটো আহত। কোচ তবু শান্ত। বেটো না খেললেও তাঁর গাবনের স্ট্রাইকার হেনরি অ্যানচয়েট, অস্ট্রেলিয়ান স্টপার আন্টুন কোভাসিক বেশ ভাল। আই লিগে একমাত্র চার্চিলই নিয়মিত নতুন ভাল ফুটবলার আনছে। সেই ইয়াকুবু-ওসেমানু-আনসা থেকে শুরু।
ডেম্পো বনাম সালগাওকর যুদ্ধে আবার আর্মান্দো কোলাসো উত্তেজিততাঁর সেরা বিদেশি ডেঞ্জিলের ছাড়পত্র আসেনি। হাতে মাত্র দুই বিদেশি। করিম বেঞ্চারিফার এত সমস্যা নেই। তাই সুপার কাপে হেরেও শান্ত।
ভারতের মানচিত্রে আই লিগের দলগুলোকে বসালে অদ্ভুত ছবি তৈরি হচ্ছে। মাত্র ৭টা শহরে খেলা। পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে ৯টি দল। পূর্ব ভারতে ৫টি। এ রকম চললে সত্যিকারের জাতীয় লিগ হয়?
চরম কৌতূহল যদি কিছু থাকে, তবে সেটা একটাই। জাতীয় লিগের নাম আই লিগ হওয়ার পর কলকাতার একটা ক্লাবও জেতেনি। ২০০৪-এর পরে জাতীয় লিগে শুধু ব্যর্থতা। আই লিগ আসলে কলকাতার ‘এফ’ লিগ। এফ ফর ফেলিওর।
লিয়েন্ডার পেজের সামনে কলকাতার ‘এফ লিগে’ মর্গ্যান, ওপারা, গাওদের যুদ্ধ শুরু আজ। এক দিন পরে সুব্রত-ওডাফা-ব্যারেটোদের। যে দিকে তাকিয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালি।
একটা আবেগের রং লাল-হলুদ। অন্যটার রং সবুজ-মেরুন। ভারতীয় ফুটবলে এই দুটো আবেগই শুধু একই রকম অম্লান হয়ে দাঁড়িয়ে। |
আই লিগ ফুটবল
ইস্টবেঙ্গল: চার্চিল ব্রাদার্স (যুবভারতী ৬-৩০)
ডেম্পো: সালগাওকর (মারগাও)
পুণে এফ সি: লাজং (পুণে)
হ্যাল: চিরাগ ইউনাইটেড কেরল (বেঙ্গালুরু) |