তিউনিশিয়া আর মিশরের পর লিবিয়া। এ বার কার পালা? ‘আরব বসন্তের’ হাওয়ার ধাক্কায় ওলটপালট হতে পারে কোন দেশের ভাগ্য? মূলত এই প্রশ্নটাই ঘোরাফেরা করছে আরব দুনিয়ায়।
এর আগে মিশরের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারককে স্ট্রেচারে শুয়ে আদালত কক্ষে যেতে দেখেছে আরব লিগের দেশগুলি। তার কিছু দিন আগেই সরে যেতে হয়েছে তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট জিনে এল-আবিদিন বেন গালিকে। আশায় বুক বেঁধেছেন লিবিয়া, সিরিয়া বা ইয়েমেনের মতো দেশের মানুষ।
কিন্তু কাল সারাদিন ধরে টেলিভিশনে যে ছবি দেখানো হয়েছে, তাতে শিউরে উঠেছে গোটা আরব দুনিয়া। কর্নেল মুয়ম্মর গদ্দাফির রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে রয়েছে সির্তের রাস্তায়। ছবিটা খুব ঝকঝকে নয়। তবে সেই ছবি দেখে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, কী নৃশংশ ভাবে মারা হয়েছে লিবিয়ার এই ‘লৌহপুরুষ’কে। আর এই ছবিটা থেকেই স্বপ্ন আর বাস্তবের ফারাকটাও ভীষণ ভাবে চোখে পড়ছে। সিরিয়া বা ইয়েমেনের মতো দেশ, যেখানে বিদ্রোহীদের ঢেউ আছড়ে পড়ছে এক শহর থেকে আর এক শহরে, তাদের ভবিষ্যৎ তা হলে কী? একনায়কের অপসারণ হলেই কি সেখানে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হবে? উত্তরটা পরিষ্কার করে জানেন না সে দেশগুলির পরিবর্তনকামী মানুষেরাই। |
সাজানো গোছানো সির্তে শহর জুড়ে এখন শুধু ধ্বংসেরই চিহ্ন। ছবি: রয়টার্স |
কাল বেইরুটের অফিসে বসে একটি আরবি চ্যানেল দেখছিলেন ৩২ বছরের মুস্তাফা হাইদ। সিরিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বিক্ষোভ চালিয়ে আসছেন মুস্তাফা। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সরিয়ে দেশে গণতন্ত্র ফেরানোর পক্ষপাতী তিনি। কিন্তু সেই মুস্তাফাই মনে করছেন যা হয়েছে, ঠিক হয়নি। লিবিয়ার স্বৈরাচারী শাসকের অন্তিম মুহূর্ত টিভির পর্দায় দেখেছেন মুস্তাফা। তাঁর উপলব্ধি, “কর্নেল গদ্দাফিকে জেলে পাঠানো উচিত ছিল, তাঁর বিরুদ্ধে বিচার ও তদন্ত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাঁকে এই ভাবে মেরে ফেলা উচিত হয়নি।” আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে শান্তিপূর্ণ ভাবে শুরু হওয়া বিক্ষোভ আস্তে আস্তে নৃশংসতার আকার নিচ্ছে। আইনের পথ থেকে সরে এসে মানুষ নিজেই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। আর সেটাই ভীষণ ভাবে ভাবাচ্ছে মুস্তাফার মতো পরিবর্তনকামীদের।
অনেকেই মনে করছেন, লিবিয়ার পরে যে দেশগুলিতে পরিবর্তন আসন্ন, তাদের মধ্যে সামনের সারিতেই রয়েছে সিরিয়া আর ইয়েমেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইয়েমেনের অবস্থাটা এখন সাম্প্রতিক লিবিয়ার মতো। প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালের সরে যাওয়াটাও নাকি সময়ের অপেক্ষা। যদিও তাঁদেরই একাংশ মনে করছে, সিরিয়ার পরিস্থিতি আলাদা। গদ্দাফির মতো মুশকিলে পরতে হবে না সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে। কারণ সেখানে ন্যাটো বাহিনীর অভিযান চলছে না। কিন্তু গদ্দাফির পরিণতি দেখে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে অনেকের কপালে। শুধু তো শান্তি প্রতিষ্ঠা নয়। বেকারত্ব হটিয়ে আর্থিক উন্নয়ন, মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখানো, পুরনো সরকারকে ফেলে দেওয়ার পরেও দেশে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখা একের পর এক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে আরব দেশগুলির জন্য।
তিউনিশিয়া হোক বা মিশর, দেশের যুব সম্প্রদায়ের একটা বিশাল অংশ তখন পথে নেমেছিল একটাই কারণে। বেকারত্ব থেকে মুক্তি। মানবাধিকার রক্ষা নিয়ে তারা কিন্তু খুব একটা চিন্তিত ছিল না। কিন্তু জিনে এল-আবিদিন বেন গালি বা হোসনি মুবারকের অপসারণ বেকারত্বের ছবিটা এখনও বদলাতে পারেনি।
তিউনিশিয়ার ছোট শহর কাসেরাইন। বিদ্রোহের আঁচে দেশের সরকার তো পড়ে গিয়েছে। কিন্তু কাসেরাইনের মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত। বিদ্রোহে বেকারত্বের সমস্যা তো মেটেনি। গদি থেকে এক জন সরেছেন। তাঁর জায়গায় অন্য কেউ বসবেন। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের লাভ? চাকরি মিলবে কি? এই ভাবনা থেকেই ভোট দেওয়ার রাস্তায় হাঁটতে চাইছেন না অনেকে। আবার বছর তেতাল্লিশের মাবরউকা ন্বারকি ভোট দিতে চান না অন্য কারণে। বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে প্রাণ গিয়েছে তাঁর ১৭ বছরের ছেলের। বললেন, “ভোট দেব কেন?” আগামী রবিবার তিউনিশিয়ায় প্রথম অবাধ নিবার্চন হতে চলেছে। আরব দুনিয়ার এই দেশটিতেই সম্ভবত প্রথম বারের জন্য উদারনৈতিক গণতন্ত্র সফল ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। অল্প জনসংখ্যা, যা অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত। জনগণের একটা বড় অংশ মধ্যবিত্ত। রাজনীতি-মুক্ত সেনাবাহিনী। গণতন্ত্রের সাফল্যের উপকরণগুলি মজুত। কিন্তু তিউনিশিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নন দেশের মানুষজনই। কারণ দেশের অভিজাত সম্প্রদায় দ্বিধাবিভক্ত। বিশেষত সে দেশের নতুন সমাজ, আইন আর সরকার চালনার ক্ষেত্রে ইসলামের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে বিশাল একটা প্রশ্ন চিহ্ন রয়েছে। তিউনিশিয়ারই এক প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত আহমেদ উয়ানাইসও জানালেন তাঁর উদ্বেগের কথা। বলেই ফেললেন, “সামনের রাস্তা খুবই দুর্গম। কারণ যুদ্ধটা আমাদের নিজেদেরই বিরুদ্ধে।” |