বেনগাজি স্তব্ধ। রকেট লঞ্চার বসানো মিনিট্রাকের সাঁ সাঁ ঘোরাঘুরি নেই ত্রিপোলির রাস্তায়। সির্তে বা মিসরাতার আশেপাশে কাল পর্যন্ত যে একটানা গোলাগুলি-বিস্ফোরণের কানফাটা আওয়াজ শোনা গিয়েছে, আজ তা অনুপস্থিত। দীর্ঘ আট-আটটি মাস পার করে এ যেন অন্য রকম জুম্মাবারের সকাল লিবিয়ায়। বলা ভাল, দীর্ঘ ৪২টি বছর অতিক্রম করে এ যেন এক অভিনব সকাল। লিবিয়া রয়েছে, কিন্তু তার এত দিনের শাসক কর্নেল মুয়ম্মর গদ্দাফিকে ছাড়া।
অতঃপর?
সারা দিন ধরে বিচ্ছিন্ন মিছিল, উচ্চকিত স্লোগান, শূন্যে গুলি ছুড়ে অনন্দ প্রকাশ। কিন্তু তার মধ্যেই এই অনিবার্য প্রশ্ন উঠে এসেছে বার বার। গদ্দাফি জমানার পরে এ বার কোন পথে চলবে ৬৫ লক্ষ মানুষ ও বিপুল প্রাকৃতিক তেলে সমৃদ্ধ এই আরব দেশ? গদ্দাফির বিরোধী অজস্র ছোট ছোট রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় সংগঠন ও উপজাতি গোষ্ঠী মিলে তৈরি করেছে ‘ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল’ (এনটিসি)। ২৩ অগস্ট রাজধানী ত্রিপোলি দখলে আসার পরেই তারা বেনগাজিতে তৈরি করেছে একটি অস্থায়ী সরকার। গদ্দাফির মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করে সেই সরকারের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিব্রিল দেশবাসীর কাছে ওয়াদা করেছেন, “এখন নতুন লিবিয়া গড়া হবে। নতুন অর্থনীতি, নতুন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে তা হবে আধুনিক, সমৃদ্ধ লিবিয়া।” আজ সারা দিন দফায় দফায় বৈঠকে বসেছেন এনটিসি-র নেতারা। নিশ্চিত ভাবেই ক্ষমতা ভাগাভাগি ও প্রশাসন তৈরি নিয়ে কথা হয়েছে সেখানে। কিন্তু তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য, বা আশাপ্রদ বার্তা দেওয়া যায়নি দেশবাসীকে। শুধু এটুকু স্থির হয়েছে, রাজধানী ত্রিপোলিতে নয়, বিদ্রোহীদের ঘাঁটি বেনগাজি শহরেই কাল ‘মুক্তির ঘোষণা’ করবেন এনটিসি-র চেয়ারম্যান মুস্তাফা আব্দুল জলিল। প্রশাসন ও
শাসন পদ্ধতিতে ‘বড়সড়’ সংস্কারের কথাও বলা হবে। কিন্তু লিবিয়ায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রণয়ন প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট কোনও কর্মসূচির কথা সম্ভবত বলতে পারছেন না এনটিসি-র নেতা। বলা যাচ্ছে না, কারণ ঐকমত্যের অভাব। অথচ, আজকের
এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে লিবিয়ার সব চেয়ে বড় প্রয়োজন ঐকমত্যই।
ফেব্রুয়ারিতে ‘গ্রিন স্কোয়্যার’-এ গদ্দাফি-বিরোধী বিক্ষোভে যে বিদ্রোহের সূচনা, আট মাসে দ্রুত পল্লবিত হয়ে তা দেশে ৪২ বছর ধরে গেড়ে বসা এক স্বৈরশাসনকে শাসক-সমেত উপড়ে ফেলেছে। আর তার সঙ্গে এক সঙ্কটকেও ডেকে এনেছে লিবিয়ায়। ৪২ বছর ধরে কোনও সংগঠিত রাজনৈতিক দল বা দায়িত্বশীল প্রতিপক্ষ ছিল না শাসক গদ্দাফির। যে সব ছোট ছোট দল, ধর্মীয় গোষ্ঠী ও উপজাতি গোষ্ঠী মিলে এনটিসি গড়েছে, তাদের মধ্যে যোগসূত্র ছিল একটাই, গদ্দাফি-বিরোধিতা। ধর্ম ভাবনা, মতাদর্শ, বাকি পুরোটাই অনৈক্য। আট মাস ধরে বিদ্রোহীদের কাজও ছিল একটাই, দেশজুড়ে দখল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গদ্দাফিকে খুঁজে বার করা। খানিকটা অতর্কিতেই সে কাজ শেষ হয়েছে কাল। আর তার পরেই ঢিলে হয়ে গিয়েছে সেই যোগসূত্র। এর পরে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা, সংবিধান রচনা, ভোটের মাধ্যমে গণতন্ত্রে পদার্পণ। আজকের বৈঠকে তাই আলোচ্যের অভাব ছিল না, আর তাতেই প্রকট হয়েছে সকলের মতবিরোধ। এমনকী কাল কোথায় করা হবে ‘স্বৈরাচার মুক্তির’ ঘোষণা, তা নিয়েও নানা মত। কেউ চান ত্রিপোলি, কেউ সির্তে, কেউ বা বেনগাজি। শেষ পর্যন্ত বেনগাজিকেই বেছে নেন বিদ্রোহীরা। কিন্তু কেমন হবে সরকার বা সংবিধান, কী হবে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার ধাঁচ, তার কিছুই ঠিক করা যায়নি। আর সেই কারণেই পরিস্থিতি অনুধাবন করে বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, “ভয়াবহ সঙ্কট লিবিয়ার সামনে।”
গদ্দাফি যদি ভেবে থাকেন, বলপ্রয়োগে হেলায় ভেঙে দিতে পারবেন বিদ্রোহ, তবে সেই ভাবনা প্রতিহত করতে বিরোধীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো। সরকারি সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য ঢালাও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছে তারা। এমনকী বিমান হানাও চালিয়েছে গদ্দাফির প্রাসাদ ও সেনাঘাঁটির উপরে। এখন লড়াই শেষের পরে সেই অস্ত্রশস্ত্রও শান্তির প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে এনটিসি টুকরো হয়ে গেলে গৃহযুদ্ধ বেধে যাওয়ার ভয়ও পাচ্ছেন তাঁরা। গদ্দাফির পতনকে কাল স্বাগত জানিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সে দেশের বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন আজ জানিয়েছেন, গণতন্ত্রে উত্তরণের এই সন্ধিক্ষণে ‘বন্ধু হিসাবে, সাথী হিসাবে’ তাঁরা লিবিয়ার মানুষের পাশে থাকবেন। কিন্তু এর পাশাপাশিই আজ জরুরি বৈঠকে বসেছিলেন ন্যাটোর কর্তারা। গদ্দাফি-বিরোধী অভিযান শেষ। লিবিয়া থেকে হাত তুলে নিচ্ছে তারা। ন্যাটোর বাহিনী সরে গেলে ফের অশান্তি ছড়াবে না তো লিবিয়ায়? ন্যাটোর এক কর্তার কথায়, “এর পরের দায়িত্ব আমাদের নয়। আমরা যত শীঘ্র সম্ভব সরে যেতে চাই। আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব রয়েছে। তারাই লিবিয়া পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিক।”
গদ্দাফিকে ছাড়া অস্বস্তিকর ২৪ ঘণ্টা কাটিয়েছে লিবিয়া। আরও কঠিন, আরও অনিশ্চিত বেশ কিছু দিন এখনও কাটাতে হবে তাদের। |