ধাতব মেঝের ওপর একটা গদি পাতা। যেমন-তেমন করে অর্ধেকটা ছেঁড়া তার পলিথিনের আবরণ। আর অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে লাল ছোপ। রক্তের।
মৃতদেহটা ওই গদির ওপর পড়ে রয়েছে। অনাবৃত উর্দ্ধাঙ্গে ফালাফালা অগুনতি ক্ষত। সামান্য কাত হয়ে থাকা মুখটাতেও আঘাতের চিহ্ন। যে মুখের কয়েক ইঞ্চি দূরে ধরা একটা মোবাইল ক্যামেরার লেন্স। মোবাইলের মালিকের পাশে আরও কয়েকটা মুখ। কেউ হাসছে, কেউ দু’আঙুলে দেখাচ্ছে ‘ভিকট্রি’ চিহ্ন। যেন টুর্নামেন্টে জিতে আসা কোনও ট্রফি নিয়ে ছবি তোলার পর্ব চলছে।
শুধু ট্রফির জায়গাটায় রাখা রয়েছে মুয়ম্মর গদ্দাফির নিষ্প্রাণ দেহ।
চারটে দশক ধরে দুনিয়া কাঁপিয়েছেন। জীবন কাটিয়েছেন ঈর্ষণীয় ভোগবিলাসে। মৃত্যুর পরে সেই মুয়ম্মর গদ্দাফিই দাবিদারহীন দেহের মতো পড়ে রয়েছেন মিসরাতা শহরের পুরনো বাজারের এক হিমঘরে। ধাতব মেঝেওয়ালা ওই ঘরটায় আগে মাংস রাখা হত! শেষকৃত্য কবে হবে, ঠিক নেই। প্রবল দ্বিধা আর চাপের মুখে লিবিয়ার অন্তর্বর্তী প্রশাসন জানাতে বাধ্য হয়েছে, গদ্দাফির মৃত্যু কী ভাবে হল তার তদন্ত হবে। আর তাই এখনই সমাহিত করা হচ্ছে না তাঁর দেহ। |
লিবিয়ার মিসরাতা শহরের হিমঘরে গদ্দাফির মৃতদেহ। ছবি: রয়টার্স |
যত ধোঁয়াশা ওই মৃত্যু ঘিরে।
যার ঠিক আগের কয়েকটা মুহূর্ত ফ্রেমবন্দি হয়ে রয়ে গিয়েছে গদিচ্যুত এক শাসকের চূড়ান্ত অপমানের
দলিল হয়ে।
রক্তে মাখামাখি এক প্রৌঢ়কে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে একদল বন্দুকধারী। প্রৌঢ়ের কোঁকড়ানো চুলের নীচ থেকে গড়িয়ে আসা রক্তে ঢেকে গিয়েছে মুখের বাঁ দিকটা। তিনি রক্ত মুছতে এক বার হাত তুললেন। ঠিক তখনই একটা হাত এগিয়ে এসে মারল থাপ্পড়। একপ্রস্ত তুমুল হুড়োহুড়ির পর দেখা গেল, ওই প্রৌঢ়কেই কখন তুলে দেওয়া হয়েছে একটা মিনিট্রাকের বনেটে। সেখান থেকে তাঁকে টেনে নামিয়ে ঠেসে ধরা হল গাড়ির গায়ে। আশপাশে প্রবল উল্লাস।
৬৯ বছরের ওই প্রৌঢ়ই মুয়ম্মর গদ্দাফি। কাঁপা হাতে, সম্ভবত মোবাইলে তোলা ওই ভিডিওয় (এমনকী এ রকম একাধিক ভিডিও তোলা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে) যাঁকে সম্ভবত শেষ বার জীবিত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়।
অঙ্কটা এইখানেই মিলছে না। রক্তভেজা মুখে চড়থাপ্পড় খেতে খেতেও যে মানুষটা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি শেষ অবধি মারা গেলেন কী করে? কোনও অকাট্য প্রমাণ নেই। কারণ তার কোনও ভিডিও বা স্থিরচিত্র নেই। আছে শুধু নিহত গদ্দাফির ছবি। কোনওটা সির্তে থেকে মিসরাতা নিয়ে যাওয়ার পথে অ্যাম্বুল্যান্সে, কোনওটা মিসরাতার ওই হিমঘরে। সাদ্দাম হুসেনের ফাঁসির দৃশ্য ইউ টিউবে ছড়িয়ে গিয়েছিল। গদ্দাফির মৃত্যুর কোনও ‘লাইভ’ ছবি উঠে আসেনি। অন্তত এখনও অবধি। তাই সময় যত গড়াচ্ছে, উঠে আসছে একের পর এক পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা। প্রাক্তন একনায়ককে পিটিয়েই মেরে ফেলা হয়েছিল বলে গত কাল এক বিদ্রোহী সেনা দাবি করেছিলেন। কিন্তু সমস্যা হল, নিজেদের ‘প্রত্যক্ষদর্শী’ বলে দাবি করে এই বিদ্রোহী সেনাদেরই অনেকে গদ্দাফির মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন রকম কথা বলেছেন। কারও বক্তব্য, সির্তের রাস্তায় জড়ো হওয়া ভিড়ের সামনেই মেরে ফেলা হয়েছিল গদ্দাফিকে। কেউ বলেছেন, গদ্দাফিকে বিদ্রোহী সেনার ‘অপমানের’ হাত থেকে বাঁচাতে এক দেহরক্ষীই তাঁর বুকে গুলি করে দেন। কারও আবার দাবি, তাঁকে মিসরাতায় নিয়ে যাওয়ার পথে অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে নিজের সোনা-বাঁধানো পিস্তল বার করে শেষ লড়াইয়ের চেষ্টা করেছিলেন গদ্দাফি। আবার গদ্দাফির দেহ খুঁটিয়ে দেখা এক চিকিৎসক বলেছেন, পেটে লাগা একটা গুলিই গদ্দাফির মৃত্যুর কারণ। আবার সংবাদসংস্থা রয়টার্স বলছে, গদ্দাফির কপালে বুলেটের ক্ষত স্পষ্ট। ব্যাখ্যাটা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ ওই ভিডিওরই একটা ফ্রেমে দেখা গিয়েছে, গদ্দাফির কানের কাছে ধরা রয়েছে পিস্তল। |
|
|
|
|
প্রকাশিত হল মুয়ম্মর গদ্দাফির অন্তিম মুহূর্তের সেই ছবি। জন্মভিটে সির্তে শহরে বিরোধীদের হাতে ধরা
পড়ার পর মারধরে রক্তাক্ত লিবিয়ার একদা একনায়ক। কী ভাবে মারা গিয়েছেন গদ্দাফি, বৃহস্পতিবার সেই
নিয়ে স্পষ্ট কোনও উত্তর দেয়নি লিবিয়ার অন্তর্বর্তী প্রশাসন বা বিদ্রোহী সেনারা। কেউ বলেছেন, তাঁকে
গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছে। কেউ আবার জানিয়েছিলেন, গণপ্রহারে নিহত হয়েছেন লিবিয়ার
চার দশকের স্বৈরশাসক। শুক্রবার প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়নি। এ দিন
গদ্দাফির মৃত্যুর ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছে অসন্তুষ্ট রাষ্ট্রপুঞ্জ। ছবি: রয়টার্স |
|
সেলিম বকির নামে এক বিদ্রোহী সেনা বলছিলেন, “রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা লোক গুলি চালাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ সে-ই গুলি ছোড়া বন্ধ করে চিৎকার করে বলল, ‘আমার প্রভু এখানে রয়েছেন মুয়ম্মর গদ্দাফি! তিনি আহত।’ সম্ভবত গদ্দাফিই ওকে গুলি চালাতে বারণ করেছিলেন। আমরা গিয়ে গর্ত থেকে ওঁকে বার করলাম। উনি বললেন, ‘কী হয়েছে? কী চলছে এখানে?” গত কাল শোনা যাচ্ছিল, বন্দুকধারীদের দেখে মুহূর্তে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন লিবিয়ার আহত, কোণঠাসা ‘লৌহপুরুষ’। বলেছিলেন, “আমাকে গুলি কোরো না তোমরা।” পরে ভিডিওয় দেখা যায় গদ্দাফিকে নিয়ে প্রবল টানাহেঁচড়ার সময়ে পাশ থেকে চিৎকার ভেসে আসছে ‘বাঁচিয়ে রাখো। ওকে বাঁচিয়ে রাখো।’ এর পর গদ্দাফি হারিয়ে গেলেন ফ্রেম থেকে। আর একটা গুলির শব্দ। মনে হতে পারে, সেই গুলিতেই হয়তো শেষ করে দেওয়া হল তাঁকে। কিন্তু কোনও প্রমাণ নেই।
সব চেয়ে গা বাঁচিয়ে চলছে লিবিয়ার অন্তর্বর্তী প্রশাসন ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (এনটিসি)। প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিব্রিল বিবৃতিতে বলেন, সির্তে থেকে গদ্দাফিকে নিয়ে যাওয়ার পথে গদ্দাফি-অনুগামীদের সঙ্গে বিদ্রোহী সেনাদের লড়াই হয়। তার মধ্যে পড়েই মারা যান গদ্দাফি।
আসলে অন্তর্বর্তী প্রশাসনের অস্বস্তিটা অন্য জায়গায়। বিদ্রোহী বাহিনী গদ্দাফির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল ‘মানবাধিকার আর সুবিচারের’ দাবি তুলে। কিন্তু গদ্দাফির অন্তিম মুহূর্তের ভিডিও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, মৃতপ্রায় একটা মানুষকে হেনস্থা করে কোন মানবাধিকারের প্রমাণ দিলেন বিদ্রোহী সেনারা? রাষ্ট্রপুঞ্জ কিন্তু ইতিমধ্যেই গদ্দাফির মৃত্যুর পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি তুলেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাইকমিশনার জানিয়েছেন, লিবিয়ার নানা হিংসাত্মক ঘটনার তদন্তের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের যে প্যানেল গড়া হয়েছে, সম্ভবত তারাই গদ্দাফির মৃত্যু-রহস্য খতিয়ে দেখতে পারে। তার পর জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে তদন্তেরও সুপারিশ করতে পারে।
স্বামীর মৃত্যুর তদন্তের দাবি তুলেছেন গদ্দাফির নির্বাসিতা স্ত্রীও।
কাজেই সন্দেহ রয়ে যাচ্ছে, গদ্দাফির পতনে সত্যিই লিবিয়ায় ‘নতুন ভোর’ এল কি না। লিবিয়া ও বিভিন্ন দেশের তাবড় রাষ্ট্রনায়করা গত কাল এই কথা বলেই বিবৃতি দিয়ে এসেছেন সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু দিনের শেষে প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত, এতটা ছন্নছাড়া কয়েকশো বিদ্রোহীকে আবার একজোট করে কী ভাবে নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার দিকে এগোবে অন্তর্বর্তী প্রশাসন? যাদের এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে গদ্দাফির ছায়া। মিসরাতার বিদ্রোহী সেনার কম্যান্ডার আব্দুল সালাম এলেইওয়া যদিও বলছেন, “ইসলামি রীতি মেনেই সমাহিত করা হবে গদ্দাফিকে।” কিন্তু একই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে, গদ্দাফি ও তাঁর নিহত ছেলে মোতাস্সিনকে গোপন কোনও জায়গাতেই সমাহিত করার কথা ভাবছে লিবিয়ার অন্তর্বর্তী প্রশাসন। তাদের ভয়, গদ্দাফির সমাধিস্থল হয়তো তাঁর অনুগামীদের কাছে ‘পবিত্র স্থান’ হয়ে উঠতে পারে।
তাই এত যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর পরেও ‘ছুটি’ পাচ্ছেন না মুয়ম্মর গদ্দাফি। |