ন’বছর আগে সিপিএমের সশস্ত্র লোকজনের হামলায় তাদের সাত কর্মী নিহত হয়েছিলেন বলে দাবি তৃণমূলের। ২০০২-এর ২২ সেপ্টেম্বর কেশপুরের পিয়াশালার সেই ‘সপ্ত-শহিদ’কে স্থানীয় ভাবে এই প্রথম স্মরণের সুযোগ পাচ্ছে তৃণমূল। ‘বিরোধী’ থেকে ‘শাসকদল’-এ উত্তরণের পরে একদা তাদের কাছে ‘অবরুদ্ধ’ কেশপুরে আজ তৃণমূলেরই একাধিপত্য। উপরন্তু ওই ‘পিয়াশালা গণহত্যা’ মামলাও নতুন করে শুরু হয়েছে। যে মামলায় জড়িয়েই এখন জেল খাটছেন সুশান্ত ঘোষের মতো ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ সিপিএম নেতাও।
আগামীকাল, বৃহস্পতিবার দশ বছর ছুঁচ্ছে সেই গণহত্যা। এত দিনের অধরা ‘বিচার’ও এ বার মিলবেসে প্রত্যাশাও জেগেছে দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। এই অবস্থায় ‘পূর্ণ মর্যাদা’য় পিয়াশালায় ‘শহিদ-স্মরণে’র প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে তৃণমূল। মঙ্গলবার সকালে গিয়ে দেখা দেল, সভামঞ্চ ও শহিদ-বেদী তৈরির কাজ প্রায় শেষ। গ্রামের অদূরে তৈরি হয়েছে তোরণও। রক্তদান শিবিরেরও আয়োজন হচ্ছে ওই দিন। স্থানীয় তৃণমূল কর্মী আশিস হালদার বলছিলেন, “বহু মানুষের রক্ত ঝরেছে। কিন্তু আর নয়। এ বার আমরা রক্তদান শিবিরের আয়োজন করছি।” শহিদ পরিবারের সদস্যরাও সে দিন উপস্থিত থাকবেন। শহিদ-দিবসের কর্মসূচি ঘিরে পিয়াশালা জুড়েই এখন অন্য আবহ। |
চলছে শহিদ বেদী তৈরির কাজ। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল। |
২০০২-এর সেই দিনটার কথা মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠেন গোবিন্দ মাঝি। যে-যার ঘরের পথে তাঁরই বাড়িতে প্রথম জড়ো হয়েছিলেন ‘ঘরছাড়া’ জনা-পঞ্চাশ তৃণমূল কর্মী। সন্ত্রাস-দগ্ধ কেশপুর ছেড়ে দীর্ঘ দিন তাঁরা বাইরে ছিলেন। প্রশাসনের আশ্বাসে সে দিনই ফিরছিলেন। অভিযোগ, খবর পেয়ে আচমকা হামলা চালায় সিপিএমের ‘সশস্ত্র বাহিনী’। ৭ তৃণমূল কর্মী নিহত হন। দু’জনের দেহ কয়েক দিন পরে উদ্ধার হলেও খোঁজ মেলেনি বাকি ৫ জনের।
পিয়াশালার কিছু দূরেই দাসেরবাঁধ। রাজ্যে পালাবদলের পর, গত জুনের গোড়ায় এখানেই মাটি খুঁড়ে হাড়গোড় উদ্ধার হয়। আর তার পরেই উঠে আসে পিয়াশালা গণহত্যার ধামাচাপা প্রসঙ্গ। উদ্ধার হওয়া হাড়গোড়ের মধ্যে পিয়াশালার ঘটনার পর থেকে ‘নিখোঁজ’ তাঁর বাবা অজয় আচার্যের দেহাবশেষ রয়েছে বলে দাবি করেন শ্যামল আচার্য। ৪০ জন সিপিএম নেতা-কর্মীর নামে খুন, লাশ লোপাটের অভিযোগে নতুন করে মামলা দায়ের হয়। তদন্ত শুরু করে সিআইডি। ‘নিখোঁজ’ ৫ তৃণমূল কর্মীর পরিজনেদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে হাড়গোড়ের ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়। সেই পরীক্ষায় ইতিমধ্যেই শনাক্ত হয়েছে অজয় আচার্য এবং আরও এক ‘নিখোঁজ’ তৃণমূল কর্মী স্বপন সিংহের দেহাবশেষ। গ্রেফতার হন সুশান্তবাবু-সহ ১৬ জন সিপিএম নেতা-কর্মী।
মঙ্গলবার শহিদ-বেদী তৈরির কাজ তদারকির ফাঁকে গোবিন্দবাবু বলেন, “সে-দিনের কথা মনে পড়লে আজও ভয় হয়। এমন ঘটনা যেন আর না হয়। রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। তা বলে মানুষ খুন কেন? অশান্তি যা হওয়ার হয়েছে। আর নয়।” গোবিন্দবাবুর বাড়ির অদূরে ছোট একটি মাঠে বেদী তৈরির কাজ চলছে। সেখানেই নিহত ৭ তৃণমূল কর্মীর দেহ জড়ো করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। পরে অন্য একটি মাঠে দেহগুলি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এ বার হচ্ছে সভামঞ্চ। মঞ্চ বাঁধার কাজ দেখভাল করছিলেন স্থানীয় তৃণমূল কর্মী তারাপদ হালদার, প্রকাশ হালদার-রা। তাঁরা বলেন, “রাজ্যে পালাবদল না-হলে এ বারও কী আর শহিদ-স্মরণ করতে পারতাম! এত বছর বুকে পাথর চেপে, মুখ বুজে থাকতে হয়েছে। এ বার হয়তো বিচার হবে।” সেই শ্যামল আচার্যের কথাতেও বিচারেরই আশা, “দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলে তবেই সবাই শান্তি পাবে।”
|