তীব্র সমালোচনার ধাক্কায় শেষ পর্যন্ত নিজের গত দু’মাসের তৈরি করা ফর্মেশন বদলে দিচ্ছেন স্টিভ ডার্বি। তবে যখন ব্যারেটো-ওডাফাদের কোচ টিমের ছক বদলের সিদ্ধান্ত নিলেন ততক্ষণে ফেড কাপে সলিলসমাধি ঘটে গেছে পালতোলা নৌকার। বুধবার চার্চিল ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে নিয়ম রক্ষার গ্রুপ লিগ ম্যাচ জিতলেও মোহনবাগানের কোনও লাভ নেই। শুধু দুর্গাপুজোর মুখে ‘আমরাও পারি’র সান্ত্বনা নিয়ে বাড়ি ফেরা ছাড়া। আর ডার্বির দলের হারের সিরিজে তিন নম্বরটাও ঢুকে পড়লে লাভ চার্চিলের। গোয়ার ক্লাব সেমিফাইনালে চলে যেতে পারে।
মোহন-বিপর্যয় ঘটতে সোমবার রাত থেকেই শুরু হয়েছিল কটাক্ষ আর সমালোচনার ঢেউ। মঙ্গলবার তা উপচে পড়েছে ফেসবুক, টুইটার আর সবুজ-মেরুন ফ্যান ক্লাবগুলোর ওয়েবসাইটে। দুঃখ, বেদনা, হা-হুতাশের পাশাপাশি ‘কর্মকর্তা তাড়াও’ থেকে ‘ডার্বি হঠাও’, ‘মোহনবাগান ম্যাসকট ‘বাগ্গু’ এখন মাঠের বাইরেঅসংখ্য টিপ্পনিতে ভরে গেছে সাইটগুলো। সমালোচনার উৎসমুখের একটি অবশ্যই মোহনবাগানের তিন ব্যাক স্ট্র্যাটেজি। সময় পেলেই ফুটবল নিয়ে লেখেন ডার্বি। বিশ্বের বিভিন্ন কাগজে। ওয়েবসাইটে। নিয়মিত দেখেন সোস্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের বিভিন্ন সাইট। সদস্য-সমর্থকদের মনোভাব দেখেই টিম ফর্মেশনের মত বদল কি না, এ দিন তা বলতে চাননি মোহনবাগান কোচ। বলছেন, “সবাই যখন চাইছে তখন ছক পাল্টে দেখিই না। আমার ফুটবলাররা যদি আমাকে ভুল প্রমাণ করে ম্যাচ জিতে ফেরে তাতে তো আমি খুশিই হব।” লাজংয়ের কাছে বিশ্রী হারের পর সোমবার রাতেই ‘বন্ধু’ ইস্টবেঙ্গল কোচ ট্রেভর মর্গ্যানের সঙ্গে ফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন ডার্বি। বিষয়: অবশ্যই স্ট্র্যাটেজি। মোহন-কোচ বললেন, “আমি তিন ব্যাক, পাঁচ মিডিও সিস্টেমে খেলায় পরের পর ম্যাচে গোল খাচ্ছি সবাই বলছে। কিন্তু ট্রেভর বলল, ও আমার ফর্মেশনে খেলিয়েই পুণে এফসি ম্যাচ জিতেছে।” |
চার্চিলের বিরুদ্ধে ‘লজ্জা কমানোর’ ম্যাচে ৪-৩-১-২ ফর্মেশনে ফেরার পাশাপাশি প্রথম এগারোয় ব্যাপক রদবদলও ঘটাচ্ছেন ডার্বি। গোলে শিল্টন পালের বদলে ফিরছেন সংগ্রাম মুখোপাধ্যায়। রাইট ব্যাকে সুরকুমারের বদলে কিংশুক দেবনাথ, মাঝমাঠে মুরলির বদলে বুঁগো সিংহ ঢুকছেন। আজ বিকেলেই টিম মিটিংয়ে কালকের ম্যাচের দল জানিয়ে দিয়েছেন ডার্বি। অনুশীলনের মাঠ খারাপ বলে শেষ মুহুর্তে সিদ্ধান্ত বদল করে ওডাফা, ব্যারেটো, সুনীল ছেত্রীদের পাঠান সুইমিং পুলে। জিমে। নিজেও নেমে পড়েন পুলে। ভিজে প্যান্ট-জার্সিতেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বললেন, “ফুটবলারদের মানসিকতার বদল চাই। ওরা বিলিয়ার্ডস খেলুক, পুলে যাক, জিম করুক। এতে যদি কিছু বদলায়।” কিন্তু এ সব করেও লাল কার্ড দেখা বেটো-হীন চার্চিলের বিরুদ্ধে মোহনবাগানের খেলায় কোনও পরিবর্তন ঘটবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ থাকছেই। কারণ কাঠামোর দড়িগুলোই যে আলগা এখনও মোহনবাগানে। ব্যারেটো নিজেই বললেন, “চার ব্যাকে খেলে দেখি কী ফল হয়, তার পর তো বলব আগের স্ট্র্যাটেজি ভুল ছিল না ছিল না।”
তেরো কোটির টিম কেন মরসুমের প্রথম দু’টো ম্যাচেই মুখ থুবড়ে পড়ল তা নিয়ে শুরু হয়েছে কাঁটাছেঁড়া। কেন তাঁর টিমের এই হাল, এই প্রশ্নে তিনটি কারণ দেখাচ্ছেন ডার্বি।
এক) যে সব ফুটবলারের ব্যক্তিগত নৈপুণ্য বেশি তারা কেউই সফল হচ্ছে না।
দুই) মাঠে টিমের গতি কম।
তিন) গোল করার ব্যর্থতা। কোচের চেয়ারে বসে প্রকাশ্যে এর চেয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয় ডার্বির পক্ষে। বিশেষ করে ক্লাবের সঙ্গে যখন তাঁর চুক্তি দু’বছরের। কিন্তু এর বাইরে টিম হোটেলে কান পাতলে বা মোহনবাগানের দু’টো ম্যাচের ১৮০ মিনিটের সিডি নিয়ে বসলে, বেরিয়ে আসছে আরও প্রচুর তথ্য।
এক) ওডাফা, প্রদীপ, রাকেশ মাসি-সহ একঝাঁক ফুটবলার এখনও পুরো ফিট নন।
দুই) শক্তিশালী দলের সঙ্গে অনুশীলন ম্যাচ না খেলায় প্লেয়ারদের মধ্যে কোনও সমঝোতাই গড়ে ওঠেনি।
তিন) যে তিন জন ডিফেন্ডারকে দু’ম্যাচে খেলিয়েছেন ডার্বি তাদের প্রত্যেকেরই টার্নিং খুব খারাপ। গতিও কম। ফলে উইং দিয়ে বিপক্ষের আক্রমণের সময় তারা পৌছতে পারেনি। প্রথম দু’ম্যাচে মোহনবাগান যে পাঁচ গোল খেয়েছে তার চারটির ক্ষেত্রেই বল এসেছে উইং দিয়ে।
চার) মাঝমাঠে বল ‘হোল্ড’ করে খেলানোর লোক নেই। চার্চিলে যে সুবিধেটা পেতেন ওডাফা, সেটা মোহনবাগানে পাচ্ছেন না। ছয়) প্রথম একাদশে পাঁচ ফুটবলারের গড় বয়স তিরিশের বেশি। দ্রুত গতির টিমের বিরুদ্ধে যারা ব্যর্থ হবেই।
টিমের দুঃসময়ে সাধারণত ম্যাচ জেতান দলের তারকা ফুটবলাররা। যখন-তখন গোল করে দলকে জেতানোর জন্যই ওডাফা, ব্যারেটো, সুনীলদের মতো ফুটবলারদের নেওয়া হয় কোটি কোটি টাকা খরচ করে। এক কোটি আশি লাখের ওডাফা লাজং ম্যাচে গোল পেলেও মাঠে বেশিরভাগ সময় তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। মাঝেমধ্যে ডান পা-টা এমন ভাবে ফেলছেন যে, হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট আছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকে। হোসে ব্যারেটো প্রচুর সাফল্য এনে দিয়েছেন মোহনবাগানকে। কিন্তু এখন বয়স তাঁর পারফরম্যান্সের উপর থাবা বসিয়েছে। ক্লাব কর্তারা তাঁকে অধিনায়ক করেছেন শেষ মরসুম বলে। কিন্তু ওয়েবসাইটে তাঁর বন্ধুরাও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, ৪৫ মিনিটের বেশি সবুজ তোতাকে মাঠে রাখা সত্যিই ন্যায্য কি না? শেষ দুটো ম্যাচে দেখা গেছে, নতুন পজিশনে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর তিনি হাঁফাচ্ছেন। বাকি রইলেন সুনীল ছেত্রীমাত্র দশ দিন দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন যিনি। ফলে ওডাফার সঙ্গে তাঁর একাত্মতা গড়ে ওঠেনি। দু’ম্যাচে অন্তত চারটে নিশ্চিত গোলের বল জালে ঢোকাতে পারেননি দেশের সেরা স্ট্রাইকার।
ডার্বি এ দিন বললেন, “এর পর আমার লক্ষ্য আই লিগ। ইস্টবেঙ্গলের মতো বিদেশে গিয়ে কোনও টুর্নামেন্ট খেলতে পারলে আমার টিমটা সংঘবদ্ধ হত।” ফুটবল নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করা অস্ট্রেলীয় কোচ মনে হয় ভুল বলেননি। ডার্বির মোহনবাগান দলের সবথেকে বড় সমস্যাএগারো জন এখনও ‘টিম’ হয়ে উঠতে পারেননি।
|