এ পুজোর সূচনা বলা যেতেই পারে পুলিশের ভাবনার ফল। আজ থেকে ৬৬ বছর আগে যে ভাবনা রূপ পেয়েছিল, তা আজও ঐতিহ্যে অমলিন।
সালটা ১৯৪৫। দেশভাগকে কেন্দ্র করে অবিভক্ত ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়তে শুরু করেছে। হাওড়ার সাঁকরাইলে যাতে এর রেশ না পড়ে, তার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন সাঁকরাইল থানার তৎকালীন ওসি কমল মুখোপাধ্যায়। তিনি প্রস্তাব দেন, হিন্দু-মুসলিম যৌথভাবে আয়োজন করুক দুর্গাপুজোর। ঈদের সময়ে আনন্দ করুন হিন্দুরাও। তৈরি হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নতুন বাতাবরণ।
প্রস্তাবটি লুফে নিলেন এলাকার বাসিন্দারা। ওই বছরই চালু হয়ে গেল দুর্গাপুজো। আয়োজকদের মধ্যে ছিলেন উভয় সম্প্রদায়ের মানুষজনই। সেই থেকে ৬৬ বছর ধরে দুই সম্প্রদায়ের মানুষের উদ্যোগে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রয়েছে সাঁকরাইলের ধর্মতলা-শীতলাতলা সর্বজনীন দুর্গাপুজো। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এ বারেও তাঁরা মেতে উঠেছেন দুর্গাপুজোর আয়োজনে।
ওড়িশার লিঙ্গরাজ মন্দিরের আদলে হচ্ছে মণ্ডপ। মণ্ডপের ভিতরের দেওয়ালে থাকছে পটচিত্র। এর জন্য থার্মোকলের উপরে বাটালি দিয়ে কেটে নকশা করা হচ্ছে। রামায়ণের একটি অংশ তুলে ধরা হবে পটচিত্রের মাধ্যমে।
মাসখানেক আগে থেকে চলছে মণ্ডপ তৈরির কাজ। এই কাজে নিযুক্ত ডেকোরেটর সংস্থার কর্ণধার স্বপন মাঝি বললেন, “তৃতীয়ার দিনেই মণ্ডপ তৈরির কাজ শেষ হয়ে যাবে।”
সাঁকারাইল এক সময়ে জমজমাট ছিল চটকলগুলির কারণে। শুধুমাত্র ন্যাশনাল জুটমিলে কাজ করতেন অন্তত ২৫ হাজার শ্রমিক। দীর্ঘদিন ধরে চটকলটি বন্ধ হয়ে রয়েছে। বেলভেডিয়া জুটমিলও বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। চলছে শুধুমাত্র মানিকপুরে ডেল্টা জুটমিল।
চটকলগুলিতে কাজ করার সুবাদে দেশের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে শ্রমিকেরা এসে এখানে থেকে গিয়েছেন। দুর্গাপুজোর আয়োজনে হিন্দু-মুসলিমের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুক্ত হয়ে গিয়েছেন বিহার, ওড়িশা-সহ ভিন্ রাজ্য থেকে আসা শ্রমিক পরিবারের যুবকেরাও। সব মিলিয়ে একটা ‘কসমোপলিটন’ সংস্কৃতি রয়েছে এই পুজোর।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, প্রতিমা আসবে কুমারটুলি থেকে। প্রতিমা বসানো হবে স্থায়ী মন্দিরে। এখানে নতুন রঙের পোঁচ পড়েছে। কুমারটুলি থেকে নিরাভরণ প্রতিমা আনা হয়। সাজ আসে কৃষ্ণনগর থেকে। সেখানকার শিল্পীরাই এসে সাজ পরিয়ে যান। উদ্যোক্তাদের মধ্যে শিবশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরজিৎ চন্দ্র, প্রভাত মুখোপাধ্যায়, সানোয়ার মোল্লা, শামসুদ্দিন মণ্ডলেরা বললেন, “এটি সাঁকরাইলের অন্যতম প্রাচীন সর্বজনীন পুজো। সব সম্প্রদায়ের মানুষ আমাদের পুজো দেখতে আসেন।”
তবে শুধু দুর্গাপুজো নয়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির দেখা যায় ঈদের সময়েও। প্রভাতবাবু এ বিষয়ে বললেন, “ঈদের সময়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে আমরা আনন্দ করি।” শামসুদ্দিন মণ্ডলের বক্তব্য, “শুধুমাত্র পুজোয় আমরা অংশ নিই না। কিন্তু বাকি সব আয়োজনে আমরা অবশ্যই জড়িয়ে থাকি।”
পুজো কমিটির সভাপতি হলেন অঞ্জলি দে। খাতায় কলমে নয়, পুজোর আয়োজনের সব কাজের তত্ত্বাবধান করছেন তিনি। দিনে দু’তিনবার চলে আসছেন পুজো মণ্ডপে। আরও একটা পরিচয় রয়েছে অঞ্জলিদেবীর। সাঁকরাইল গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান তিনি। কিন্তু পুজো কমিটির সভাপতি হিসাবে ‘প্রধান’-এর পরিচয়টি সরিয়েই রেখেছেন তিনি। অঞ্জলিদেবীর কথায়, “এখানেই আমার বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি। প্রধান পদে নির্বচিত হওয়ার আগে থেকেই আমি পুজো কমিটির সভাপতি।” |