প্রবন্ধ ২...
দুর্নীতি সমূলে উচ্ছেদ করা অসম্ভব
বরং, নিয়ন্ত্রণে সুফল মিলতে পারে

সাম্প্রতিক কালে বড়সড় দুর্নীতির খবরে জেরবার সারা দেশ। দুর্নীতির কোনও বিশেষ রাজনৈতিক রং থাকে না। তা-ও বোঝা যাচ্ছে। এক দিকে টেলিকম, কমনওয়েলথ গেমস জাতীয় আর্থিক কেলেঙ্কারি আর অন্য দিকে, খনিজ সম্পদের নয়ছয়। এক দল ভাবছেন লোকপাল বিলের সাহায্যে দুর্নীতির খানিকটা সুরাহা হবে কেউ ভাবছেন যাই করি না কেন দুর্নীতির থেকে আমাদের মুক্তি নেই। অনেকে নৈতিকতার শিক্ষা প্রসারের কথা ভাবছেন। অনেকে বলছেন যে অর্থনৈতিক সংস্কার বা উদারনৈতিক উন্নয়ন পন্থাই এই বিশাল দুর্নীতির প্রধান উৎস।
প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন যে পৃথিবীর সর্বত্রই দুর্নীতি যুগে যুগে চেহারা পাল্টেছে কিন্তু কখনওই নির্মূল করা যায়নি। দুর্নীতি নির্মূল করতে যে প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন এবং রসদ প্রয়োজন, তা ছাড়া যে ধরনের সর্বক্ষণ তদারকি দরকার ভারত কেন কোনও দেশের পক্ষেই তা সম্ভব নয়। তাই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করাই ‘সঠিক উদ্দেশ্য’। দেশে দুর্নীতি নির্মূল করতে গিয়ে সরকারি সব কাজ যদি বন্ধ করে দিতে হয়, যদি সরকারি রসদের এতটুকুও অবশিষ্ট না থাকে তা হলে দুর্নীতি নির্মূল হলেও সমাজের আখেরে লাভ হবে না। এ প্রসঙ্গে কতগুলো ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হতে পারে যা আপাত দৃষ্টিতে খুবই স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
যেমন, দুর্নীতির ঘটনা আগের চেয়ে বাড়ছে বা কমছে কি না, তা আগে সংবাদপত্রে জানতে পারতাম, এখন ছোট পর্দার কল্যাণে সব সময় জানতে পারি। ধরা যাক, আগে একশোটি দুর্নীতির ঘটনা ঘটত এবং পঞ্চাশটি খবরের কাগজে প্রকাশিত হত। এ বার টেলিভিশন চালু হল। তখন আমরা আরও পঁচিশটি ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারলাম। মনে হল, সমাজে দুর্নীতি বেড়ে গিয়েছে। আসলে কিন্তু তা নয়। দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে ওই একশোটিই। আমরা জানতে পারছি বেশি, এই যা। দুর্নীতির খবর বেশি বেশি করে প্রকাশিত হওয়া মানে এই নয় যে আগে দুর্নীতি বেশি হত না আমরা জানতে পারতাম না।
হকার হকার! রাজস্বের উপায়? ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
অনেকে উদারনৈতিক সংস্কার আর ক্রমাগত আর্থিক দুর্নীতিকে কার্য-কারণের সম্পর্কটিকে এক করে ফেলেছেন। নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির যুগের তাবড় দুর্নীতির খবর পাওয়ার এমন সুবিধা ছিল না। তার মানে এই নয় যে দুর্নীতির ঘটনা একশোটিতেই আটকে থাকবে। এখন প্রচার হওয়ার অবকাশ অনেক বেশি। যেমন অপরাধের সংখ্যা এক রাজ্যে বেশি বা এক রাজ্যে কম, এই ফারাকের মধ্যে কোন রাজ্যে অপরাধ নথিভুক্ত হওয়ার সুযোগ বেশি সেটাও দেখতে হবে। ফলে যেখানে অপরাধ নথিভুক্ত করা শক্ত সেখানে সব সময়েই কম অপরাধ হচ্ছে এমনটা মনে হতে পারে।
আমাদের দেশে দুর্নীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু মানুষের নৈতিকতা নয়, মানুষকে অনৈতিক হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। যাঁরা নৈতিকতার জীবনদর্শনে দায়বদ্ধ, সারা পৃথিবীতেই তাঁদের সংখ্যা কম। সংজ্ঞা যা-ই হোক না কেন, জগৎ থেকে নৈতিকতা ধুয়েমুছে যায়নি। অন্য দিকে, বুনিয়াদি শিক্ষাস্তরে নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়ার পাঠ ধুয়েমুছে গিয়েছে সেটাও মহা সমস্যা। নৈতিকতার সঠিক চেহারা কী হবে তা নিয়েও শতধা বিভক্ত এই দেশে সমাধান খুঁজতে যাওয়া অসম্ভব। দেশকে ভালবাসলে দেশের দরিদ্রদের উপকারে, দশের উপকারে সরকারি টাকা-পয়সা খরচ করতে গেলে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব কর দেওয়া। এ ব্যাপারে তখন কোনটাই বা ‘দেশ’ আর কারাই বা ‘দশ’ তা নিয়ে আকাশপাতাল গবেষণা শুরু হবে। ফলে নৈতিকতা নিয়ে বেশি দূর এগোনো শক্ত। এ প্রসঙ্গে এক বার আমার এক বন্ধু বলেছিলেন যে আমরা ছোটবেলায় মহাপুরুষদের বাণী ও জীবনসংকলিত বই পড়তাম, তাঁদের মোটামুটি ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বুর্জোয়া ধারক ও বাহক হিসেবে। অন্য দিকে সমাজ-বৈজ্ঞানিক গবেষণায় তাঁরা যে আসলে কত খারাপ ছিলেন সেটাই বার বার উঠে এসেছে। ফলে নৈতিকতাকে হাতিয়ার করে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ শক্ত। এ বার আসি পদ্ধতিগত প্রশ্নে।

দুর্নীতির সূত্র মানুষের আর্থিক সম্পদ আহরণের প্রবৃত্তি। যে কোনও রকম সরকারি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যত কম মানুষে মানুষে কথোপকথন ও আলোচনা হয় ততই মঙ্গল। যন্ত্রের সাহায্যেই খানিকটা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। টু-জি অকশন বা জমি কেনাবেচা নিয়ে অজস্র দুর্নীতির কথা আমরা জানতে পারছি। যে কোনও নিলামজনিত প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কম্পিউটার যন্ত্রের অনেক বেশি ব্যবহার প্রয়োজন। ঠিক সময়ে আবেদন জমা না দিলে নিজে থেকেই কম্পিউটার আর সে আবেদনপত্র নেবে না। রাজা বা মন্ত্রীর কিছু করার থাকবে না। এই যন্ত্রের ব্যবহার আরও অনেক ভাবে হতে পারে। সরকারকে তা ভাবতে হবে এবং জানতে হবে।
সরকারি নিয়মের বেড়াজাল যত জটিল হবে, তত বাড়বে দুর্নীতির অবকাশ। একটা নিয়মকে এক এক জনের এক এক রকমভাবে ব্যাখ্যা করার অবকাশ থাকলে দুর্নীতি বাড়তে বাধ্য। তাই করের বিভিন্ন হার বা বিভিন্ন ঋণের কর একেবারে তুলে দিয়ে সহজ সরল কর কাঠামো তৈরি আবশ্যিক। নিয়ন্ত্রণের অর্থনীতির মূল সমস্যা এখানেই। সংস্কার পরবর্তী যুগে ভারতে জাতীয় আয় যথেষ্ট হারে বৃদ্ধি পেলেও কর আদায়ের হার তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। কারণ, করপ্রথার সরলীকরণ। তেমন ভাবেই যেখানে নিয়মবিধি আবশ্যক, সেখানেই নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে স্বচ্ছ বাতাবরণ সৃষ্টি করতে হবে। এই পরিবর্তনের জন্য শিক্ষিত পেশাদার বিশেষ প্রয়োজন। দীর্ঘকালের ধামাধরা, পাইয়ে দেওয়া নীতির ফলে সরকারি মহলে দক্ষ প্রশাসনিক কমর্চারীর বড়ই অভাব।
একটা উদাহরণ খুব জনপ্রিয়। রেলপথে জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য ওয়াগন প্রতি সর্বোচ্চ পরিমাণ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল বেশ খানিকটা নিম্নস্তরে। ফলে একটু বেশি জিনিস নিয়ে যেতে গেলেই উপরি দিতে হত। সরকার সেই উচ্চসীমা বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দেওয়ায় রেলমন্ত্রকের প্রভূত আয় বেড়ে গেল। অর্থাৎ উৎকোচ বা ঘুষকে রাজস্বে পরিণত করা একটা নীতি হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সৃষ্টিশীল চেতনা, শিক্ষা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। জনগণের বিশাল সমর্থন যে সব সরকারের পিছনে থাকে তারাই এটা ভাল ভাবে করতে পারেন। আমাদের রাজ্যে বিগত সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিশেষ অভাব ছিল কারণ সেই জমানায় সমান্তরাল অর্থনীতির মারফত রাজনৈতিক মুনাফা অর্জিত হত। আশা করি বর্তমান সরকার এ বিষয়ে কিছু ব্যবস্থা নেবেন।
কলকাতার রাস্তায় প্রচুর হকার ব্যবসা করেন। যেমন কলকাতার রাস্তায় প্রচুর গাড়ি পার্ক করা থাকে দিনে ও রাতে। শোনা যায়, হকার এবং অসংগঠিত ছোট ব্যবসায়ীরা তোলাবাজ, পুলিশ এবং রাজনৈতিক মদতে পুষ্ট স্থানীয় দুষ্কৃতীদের টাকা দেন। এটাই হকারদের কর। সরকার পেলেন কি পেলেন না তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। এর সামগ্রিক পরিমাণ মোটেই কম নয়। শুধু কলকাতাতেই সারা বছরের চটজলদি হিসেব মতো কয়েকশো কোটি টাকার তোলা-লেনদেন হয়। সরকার এই প্রক্রিয়াকে কেন উপেক্ষা করবেন? এই উপেক্ষা করা অনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে অনুচিত।
যেগুলো ছোট ছোট নথিভুক্ত আইনানুগ ব্যবসা তাদের ওপর কর বসিয়ে সরকার রোজগার করেন আর হকারদের দেওয়া ‘কর’ বেআইনি ভাবে ব্যবহৃত হয়, এ তো সামাজিক বৈষম্য। দিনের পর দিন এই বেআইনি ‘কর’ ব্যবস্থা চালু রেখে বিগত সরকার অসংগঠিত ক্ষেত্রকে মজবুত করেছেন কারণ এই সব হকার বা এই রকমের ছোট ছোট ব্যবসায়ীই ছিলেন ভোটব্যাঙ্কের জোগানদার।
অথচ, হকারগোষ্ঠী এক এক জায়গায় বসার জন্য পারমিট হিসেবে কলকাতা পুরসভা থেকে পার্কিং কুপন কিনতে পারেন। তাঁদের সম্পত্তির অধিকার না থাকলেও ব্যবসার অধিকার থাকবে। তোলাবাজদের হাত থেকে মুক্তি মিলবে। কুপন না করে কম্পিউটারাইজড স্মার্ট কার্ড বা লাইসেন্স চালু করলে সেগুলি নকল হওয়ার সম্ভাবনা কম। অল্প রেজিস্ট্রেশন ফি এবং মাসে মাসে বা ছ’মাসে নবীকরণ বাবদ স্বল্প রাজস্ব আদায় করলেও সরকারের লাভ হবে প্রচুর। এই রাজস্বের একটা অংশ হকারদের স্বাস্থ্য বিমায় খরচ করা যায়। এর ফলে হকারদের সামাজিক সম্মান বাড়বে কারণ তাঁরা করদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন। বেকার যুবকদের ‘পার্কিং’ প্রক্রিয়ার দেখভালে লাগানো যেতে পারে। যে ভাবে, ‘পার্কিং’-এর জন্য বিভিন্ন এজেন্সিকে ব্যবহার করা হয়।
অর্থাৎ, আমাদের যা প্রাতিষ্ঠানিক রসদ আছে যন্ত্রের সাহায্যে এবং বুদ্ধির সাহায্যে সেগুলোকে ভাল ভাবে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতিকে বেশ খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। রাজনীতিকে সামলেই তা করা সম্ভব। সব ধরনের দুর্নীতি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। এবং দুর্নীতি নির্মূল করতে যাওয়া এবং চাওয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক থাকাটাই স্বাভাবিক, এটা অর্থনীতির কথা। অন্য দিকে হাতের কাছেই যে উপায়গুলো আছে, সেগুলোর দিকে নজর না দেওয়াটাও বোকামি।

লেখক সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.