|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি |
 |
ও দেবী তোর কেমন পা,
ধুলা লাগে না |
|
‘থিয়েটারে এখন সারা ভারতেই বাংলার জয়-জয়কার। বাংলার মঞ্চে গ্রুপ থিয়েটারের
একটার পর একটা প্রযোজনা আন্তর্জাতিক স্তরের।’ একটি নাটকে অভিভূত হওয়ার অভিজ্ঞতা।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
গল্পটা আমাকে বলেছিলেন, প্রখ্যাত অভিনেতা রবি ঘোষ। সেটা ষাটের দশকের কথা, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতাপ সারা দুনিয়ায় অপ্রতিহত, মস্কো থেকে নাটক ও চলচ্চিত্র জগতের দুই কেষ্ট-বিষ্টু পুডভকিন আর চেরকাশভ ভারত সফরে এসে পৌঁছেছেন কলকাতায়। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা এখানকার দু’একটি থিয়েটার দেখতে চাইবেন। তখন কলকাতার মঞ্চ একটা সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে, উত্তর কলকাতার পেশাদারি থিয়েটারগুলি ভাঙনের মুখে, গ্রুপ থিয়েটারগুলির অভ্যুত্থান ঠিক মতন শুরু হয়নি। গিরিশ যুগের পরবর্তী মঞ্চ সম্রাট শিশিরকুমারের তখন বেশ দৈন্য দশা, ভাঙা মঞ্চ, ছেঁড়া-খোঁড়া সেট নিয়ে তিনি তাঁর কয়েকটি শেষ অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং এক সন্ধ্যায় তাঁর একটি নাটক দেখতে নিয়ে যাওয়া হল ওই দুই প্রখ্যাত রাশিয়ানকে। যাবার পথে সরকারি অফিসাররা ওঁদের শিশিরকুমারের পূর্ব গৌরবের সব কাহিনি শোনাতে ছাড়লেন না। তার পর নাটক তো শুরু হল, এমন কিছু আহামরি তো নয়ই, বরং লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু দ্বিতীয় দৃশ্যে যে-ই শিশিরকুমার ঢুকলেন, তখন ওঁদের এক জন পাশ ফিরে এক সরকারি অফিসারকে বললেন, তোমরা যে লেজেন্ডারি অভিনেতার কথা বলছিলে, ইনি তো তিনি, তাই না? সরকারি অফিসারটি বললেন, হ্যাঁ, ইনিই শিশিরকুমার, কিন্তু আপনি কী করে চিনলেন? চেরকাশভ বা পুডভকিন বললেন, সত্যিকারের বড় অভিনেতারা মঞ্চে পা দিলেই বোঝা যায়, যত ছোট ভূমিকাই হোক, তাঁরা মুহূর্তে মঞ্চ অধিকার করে নেন। তাঁর সারা শরীরেই থাকে অভিনয়।
এই গল্পের কথক রবি ঘোষ, যিনি নিজেই ছিলেন এ রকম এক জন অভিনেতা। আমি তাঁর মঞ্চ অভিনয় বিশেষ দেখিনি। কত এলেবেলে সিনেমায় তিনি ছোটখাটো ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, তবু তাঁকে দেখামাত্র বোঝা যেত, কত বড় অভিনেতা তিনি, আন্তর্জাতিক মানে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। এখন আফশোস হয়, রবি ঘোষকে তাঁর যোগ্যতার সঠিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, কোনও গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রে বড় কোনও ভূমিকাও পাননি। তবে সত্যজিৎ রায় তাঁকে খুব পছন্দ করতেন।
রবি ঘোষ কথিত এই কাহিনিটি আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল মিনার্ভা রেপার্টারি থিয়েটারের দ্বিতীয় মঞ্চ উপস্থাপনা দেবী সপর্মস্তা দেখতে দেখতে। কথক আর লোকেন্দ্র এই দুই ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য, তাঁকে আমি চিনি না, আগে কোনও অভিনয়ও দেখিনি। তবু মনে হল, এই ছেলেটির মঞ্চ উপস্থিতিতেই খানিকটা জাদু আছে, এ এক জাত অভিনেতা। তা বলে তাকে আমি শিশির ভাদুড়ির তুল্য মোটেও বলতে চাইছি না, এমন কথা লিখলে সে নিজেই সম্ভবত লজ্জায় মরে যাবে। আমি এমন কিছু নাট্যবোদ্ধাও নই, তবে রবি ঘোষের কাহিনিটা অকস্মাৎ মনে পড়েছিল, এ কথাও ঠিক।
|
 |
‘দেবী সর্পমস্তা’ নাটকের একটি দৃশ্য। |
স্টার থিয়েটারের নব্য রূপ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেখানে তেমন কোনও নাট্য প্রযোজনার খবর শুনিনি। কিন্তু প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত মিনার্ভা থিয়েটারের পুনর্জীবন পাওয়ার পর যে কাজ করছেন, তা সগৌরবে মঞ্চের ইতিহাসে স্থান পাবে। এর আগে সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কিং লিয়ার দেখে যে মুগ্ধতা নিয়ে বাড়ি ফিরেছি, তার রেশ এখনও রয়ে গেছে। এ বারে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় উপস্থাপিত করেছেন সম্পূর্ণ অন্য ধরনের এক নাট্য প্রযোজনা, একেবারে দেশজ, গ্রামীণ সংস্কৃতির শিল্প রূপ।
অনেক বাঙালির মধ্যে এমন একটা হীনম্মন্যতার ভাব দেখি যেন, কলকাতা তথা বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি জগতে ইদানীং নতুন কিছুই ঘটছে না। অন্যান্য ভারতীয়দের সামনে তাদের কাঁচুমাচু ভাব দেখে আমার আশ্চর্য লাগে। এখন বরং বাংলায় গর্ব করার মতন অনেক কিছু হচ্ছে। ফিরে এসেছে বাংলা সিনেমা। গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রমুখ কয়েক জন প্রবীণ তো রীতিমতন সক্রিয় বটেই, তা ছাড়া এক ঝাঁক নতুন তরুণ-তরুণী অভিনব বিষয়বস্তু নিয়ে, নতুন আঙ্গিকে, কম খরচে চমৎকার সার্থক সব সিনেমা বানাচ্ছেন। এবং মুম্বই মার্কা ফিল্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে বাংলার দর্শক দেখতে আসছেন সেই সব ছবি। ‘ইচ্ছে’র মতন বিখ্যাত নায়ক-নায়িকা বর্জিত ফিল্ম চলছে সপ্তাহের পর সপ্তাহ।
আর থিয়েটারে এখন সারা ভারতেই বাংলার জয়-জয়কার। এই শিল্পে এক সময় বাংলার প্রধান প্রতিযোগী ছিল মহারাষ্ট্রের থিয়েটার। এখন সেখানে চলছে কিছুটা ঝিমোনো ভাব। আর বাংলার মঞ্চে গ্রুপ থিয়েটারের একটার পর একটা প্রযোজনা আন্তর্জাতিক স্তরের। রুদ্রপ্রসাদ আর স্বাতীলেখা আজও অক্লান্ত ও সৃষ্টিশীল। তার প্রমাণ অজ্ঞাতবাস আর মাধবী; বিভাস চক্রবর্তী নিজেকে বদলাচ্ছেন বার বার, সম্প্রতি তাঁর পরিচালনায় ‘হ্যামলেট’ পৃথিবীর বহু পরিচালকের কাছেই চ্যালেঞ্জস্বরূপ। বিভাসও সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে শেকসপিয়রের রচনাকে জীবন্ত ও তাৎপর্যময় করে তুলেছেন এবং নামভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছেন সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, এই অভিনেতাটিকে যত দেখছি, ততই মুগ্ধ হচ্ছি। (হ্যামলেটের বাংলা অনুবাদের ভাষায় ব্যঞ্জনার অভাব আর শুরুতে হিন্দি গান আর শেষ দৃশ্যে গোলাগুলি চালিয়ে হ্যামলেটকে যে ভাবে ‘কলকাতা হ্যামলেট’ করা হয়েছে, তা ব্যক্তিগত ভাবে আমি পছন্দ করতে পারিনি।)
ব্রাত্য বসুর কৃষ্ণ গহ্বর আর রুদ্ধসঙ্গীত আমাদের থিয়েটারের গৌরব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। কিছু দিন আগে নাটুয়া নামে একটি দলের ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’-এর মঞ্চরূপ দেখে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি, এও কি সম্ভব? ‘ফুরুৎ’ নামের একটা নাটককেও স্মৃতিতে স্থায়ী স্থান দিয়ে রেখেছি। এ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি মঞ্চ-নাটক নতুন নতুন বিষয়বস্তুতে সফল। সব আমার দেখা হয়ে ওঠে না, তা আমারই ক্ষতি। নান্দীকার, পূর্ব-পশ্চিমের মতন দল আয়োজন করছে নাট্য উৎসব। মঞ্চ এখন জমজমাট।
মনোজ মিত্রের নাটক খানিকটা সিজিল মিছিল করে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় উপস্থিত করেছেন দেবী সর্পমস্তা। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংখ্যা চব্বিশ, শুনলাম তাদের মধ্যে মাত্র চার জন সুমনের প্রযোজনায় অংশ নিয়েছেন, বাকি সবাই একেবারে নতুন। নানান জেলা থেকে আনা হয়েছে তাদের একেবারে আনকোরা অবস্থায়, তাদের শেখানো হয়েছে নাচ-গান এবং অবশ্যই অভিনয়, পাঁচ মাস ধরে টানা রিহার্সাল। তার ফল যে এমন চমকপ্রদ হতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। নাটকের আঙ্গিক খানিকটা অপেরা-ধর্মী, কাহিনি এগিয়েছে নাচ ও গানে, অর্থাৎ মঞ্চে উপস্থিত সবাইকে নাচ শিখতে হয়েছে, মাঝে মাঝে বেশ উদ্দাম নৃত্য। অধিকাংশ গানই সমবেত, খুবই সাবলীল। এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা, সব নতুন নতুন ছেলেমেয়ের অভিনয়ে অপূর্ব সৃষ্টি।
এই নাটকের কাহিনি বর্ণনা করার কোনও প্রয়োজন নেই। প্রায় দুশো বছর আগেকার পটভূমিকায় একটি উপকথার জীবন্ত রূপ। যেহেতু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চিনি না, তাই মনে হয় প্রত্যেকেই ওই সব সত্যিকারের চরিত্র। অবশ্য এর জন্য অনেকটা কৃতিত্ব পরিচালক দেবেশের। প্রধান ভূমিকায় অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের নাম উল্লেখ করতে গিয়ে আমার মনে হল, চব্বিশ জনেরই নাম লেখা উচিত। কারণ এরা সবাই মিলেই তো প্রাণের ছন্দ আর টগবগে ভাব ফুটিয়ে তুলেছে।
নাটকটি দেখেছি বিভোর হয়ে। শেষ হওয়ার পর বেরুবার সময় আমি গুনগুন করছি, এর মূল গান, ‘ও দেবী তোর কেমন পা, ধুলা লাগে না।’ আমার সঙ্গে যে কয়েক জন বন্ধুবান্ধব গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এক জন বাইরে এসে বললেন, এটা আবার দেখতে হবে! ঠিক কথা, নাচে-গানে মাতিয়ে দেওয়ার এমন নাটক বার বার দেখা যায়।
|
রক্ত গড়িয়ে ধানের খেতে |
বারুইপুরের দিকে একটি সমাজসেবী প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু ছেলে-মেয়েকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, যাদের রক্ত এইচ আই ভি পজিটিভ। বাচ্চা থেকে কিশোর-কিশোরী, বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই, তাদের মুখে চোখে রয়েছে কৈশোরের লাবণ্য, তারা একটা নাটক করতেও শিখেছে।
তাদের বাবা-মা এই বিষ দিয়েছে, ওরা কিছু জানেই না। এইচ আই ভি পজিটিভ মানেই কিন্তু এডস্ রোগাক্রান্ত নয়। এখন তাদের জীবন স্বাভাবিক, অন্য বাচ্চাদের মতনই, তবে তাদের ভবিষ্যতে ওই মারাত্মক রোগের সম্ভাবনা খুবই প্রবল।
এই ছেলেমেয়েগুলিকে যখন এখানে আনা হয়েছিল, তখন স্থানীয় কিছু লোক আপত্তি জানিয়েছিল। তাদের বক্তব্য, এই ছেলেমেয়েরা যে জল ব্যবহার করবে, তার খানিকটা গড়িয়ে গড়িয়ে ধান খেতে গিয়ে পড়বে, তার ফলে সেই খেতের ফসলে এই রোগের জীবাণু ছড়িয়ে পড়বে। এই হচ্ছে এডস্ রোগ সম্পর্কে আম জনতার জ্ঞানের নমুনা। কথাটা শুনতে শুনতে আমার মনে হয়েছিল, জল নয়, যেন রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির নাম অফার। তার পরিচালক কল্লোল ঘোষ এমনিই আর পাঁচ জন মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে, উত্তর কলকাতায় বাড়ি, স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসার পথে দেখত রেল লাইনে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ট্রেন থেকে কয়লা চুরির কাজ করে, অনেক সময় খুব ঝুঁকি নেয়, দু’এক জন মারাও যায়। এ সব দৃশ্য তো আমরাও দেখি কিংবা এই সব কাহিনি শুনি, কিন্তু গা করি না। কিন্তু কল্লোলের মনে হয়েছিল, ওদের জন্য কিছু একটা করলে হয় না? দু’এক জন বন্ধুর সাহায্য নিয়ে সে শুরু করল একটা ছোটখাটো স্কুল। তার পর সল্ট লেকে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেবা প্রতিষ্ঠান।
এখন কল্লোল এক জন মধ্যবয়সী, প্রাণবন্ত মানুষ। নিছক মনের জোরে তাঁর প্রতিষ্ঠানটিকে অনেক বড় করে ফেলেছেন। বারুইপুরের কাছে নিজস্ব জমি-বাড়িতে আছে অনাথ ছেলেমেয়েদের জন্য আবাস, শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাবার ব্যবস্থা, এবং ওই এইচ আই ভি পজিটিভ বাচ্চাদের স্বাভাবিক জীবনের জন্য প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে নানা রকম ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গাটি, কল্লোলের সঙ্গে এই কাজে যুক্ত হয়েছেন আরও অনেকে। টাকাপয়সা তুলতে হয় নানান জায়গা থেকে, একটি ইতালিয়ান প্রতিষ্ঠানও সাহায্য করে। সেয়জু নামে এক বাংলা-প্রেমিক ইতালিয়ানকে চেনেন এই শহরের অনেকেই, এক সময় তিনি গৌতম ঘোষের সঙ্গে চলচ্চিত্র প্রযোজনায় যুক্ত হয়েছিলেন, সেই সেয়জু মাঝে মাঝেই কলকাতায় এসে এই প্রতিষ্ঠানে কিছু সময় কাটিয়ে যান। এখন কল্লোলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন কানাডা-প্রবাসী দীপ্তেন্দু চক্রবর্তীও। কোথাও কোনও বাচ্চা বিপদে পড়েছে শুনলে কল্লোল তাকে তুলে নিয়ে আসেন। মাত্র কয়েক দিন আগে, হাওড়ায় দুই মহিলা, সম্পূর্ণ উন্মাদ, তাদের বাচ্চাদের মেরে ফেলতে চেয়েছিল। এখন সেই শিশুদুটি আছে অফার-এর আশ্রয়ে। ওরা বেঁচে যাবে। দুই বাচ্চাকে এখানকার মহিলা কর্মীরা কোলে নিয়ে নিয়ে ঘুরছেন, বাচ্চা দুটির কী সুন্দর মুখ আর টলটলে চোখ, আমার এক এক বার ইচ্ছে করে ওদের এক জনকে কোলে নিয়ে আদর করতে। কিন্তু নিই না, বরং দূরে সরে যাই। মায়ায় জড়িয়ে পড়তে আমার ভয় করে। ওরা বেঁচে থাক। |
|
|
 |
|
|