‘স্বাধীন বিদেশনীতির’ পরিচয় দিয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমদিনেজাদের সঙ্গে নিউইয়র্কে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। শেষ মুহূর্তে ঠিক হওয়া এই কর্মসূচিটির কথা আগামিকাল ঘোষণা করবে ভারত।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় যোগ দেবার পাশাপাশি জাপান, ব্রাজিল ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে মনমোহনের বৈঠক আগেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। এ বার মনমোহন সিংহের সঙ্গে বারাক ওবামার বৈঠক হচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে জানানো হয়েছে, ওবামাকে অন্য কাজে
ওয়াশিংটন ফিরে যেতে হবে। কিন্তু খাস নিউইয়র্ক শহরের বুকে ইরানের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক? মার্কিন কর্তারা কি খুশি হবেন? মনমোহন তিন বছর রাষ্ট্রপুঞ্জের
অধিবেশনে যোগ দিতে যাননি। কিন্তু ইরানের প্রেসিডেন্ট প্রতি বছর সাধারণ সভায় বক্তৃতায় খোলাখুলি মার্কিন
নীতির বিরোধিতা করেছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের সদর
দফতরের সামনে ইরানের বিক্ষোভকারীরা একদা বুশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, এখন দেখান ওবামার বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন ইরানের। স্বাভাবিক ভাবেই আমেরিকা চায়, তাদের ‘সহযোগী’ হিসাবে ভারতও ইরানকে এড়িয়ে চলুক। এই পরিস্থিতিতে ভারত অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগেই মার্কিন কূটনীতিকদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছে, এই বৈঠককে যেন তাঁরা খুব বেশি কৌশলগত গুরুত্ব না দেন। ভারত চায় না, ইরান পরমাণু অস্ত্র বাড়াক। কিন্তু ভারত আমেরিকাকে বোঝাতে যায়, ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই ইরানের সঙ্গে ভারতের ঝগড়া করা উচিত নয়। প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের একটা সূক্ষ্ম শিয়া-সুন্নি সংঘাত আছে। প্রতিবেশীর বিরূপ প্রতিবেশীর সঙ্গে একটা সম্পর্ক রক্ষার বাধ্যবাধকতা ভারতেরও রয়েছে। |
ইরানের পাশাপাশি প্যালেস্তাইনকে রাষ্ট্রপুঞ্জের স্থায়ী সদস্য করার বিষয়েও ভারত সমর্থন জানিয়েছে। সমর্থন জানিয়েছে বাংলাদেশও। এ বারে সাধারণ সভায় প্যালেস্তাইনের স্থায়ী সদস্যপদ নিয়ে ভোটাভুটি হওয়ার কথা। ভোটাভুটি হলে ভারত কিন্তু প্যালেস্তাইনের পক্ষে ভোট দেবে। এখনও পর্যন্ত যা খবর, তাতে রাষ্ট্রপুঞ্জের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশই প্যালেস্তাইনের পক্ষে থাকবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য প্যালেস্তাইনের দিকে থাকায় ভারত কোনও ভিন্ন অবস্থান নিতে চায় না। নয়াদিল্লিতে বিদেশ মন্ত্রকের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, এটা নতুন কিছু নয়। প্যালেস্তাইন গঠনের দিন থেকেই ভারত রাষ্ট্রপুঞ্জে তাদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সওয়াল করে আসছে। কিন্তু ভারত চাইছে, বিষয়টি নিয়ে যাতে খুব বেশি হইচই না হয়। প্যালেস্তাইনের দাবির পক্ষে ভারত নিজে থেকে সরব হচ্ছে না। কিন্তু আনুষ্ঠানিক ভাবে প্যালেস্তাইনের পক্ষেই অবস্থান নিচ্ছে।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইওশিহিকো নোদা সম্প্রতি চিনের ‘সামরিক শক্তির বাড়বাড়ন্তের’ বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তাঁর মতে, কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়াই সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলেছে চিন, যা জাপানের মতো প্রতিবেশী দেশের পক্ষে অস্বস্তিকর। নোদা বলেছেন, দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত চিনের। আর এক প্রতিবেশী দেশ হিসাবে ভারতও চিনের বাড়তি সামরিক শক্তির চাপ অনুভব করছে বইকি। সম্প্রতি নানা বিষয়ে চিনের ‘আধিপত্যবাদী’ মানসিকতা দিল্লির বিড়ম্বনা বাড়িয়েছে। উত্তরের সীমান্ত থেকে দক্ষিণ-পূবের আন্দামান, সর্বত্রই চিনা সেনাবাহিনীর অনাকাঙ্ক্ষিত উপস্থিতি মাঝেমাঝেই টের পাচ্ছে দিল্লি। এই পরিস্থিতিতে নিউইয়র্কে জাপানের প্রধানমন্ত্রী নোদার সঙ্গে মনমোহনের আলোচনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন দিল্লির কূটনীতিকরা।
কিন্তু, আহমদিনেজাদ-মনমোহন বৈঠক কি ভারত-মার্কিন সম্পর্কে কোনও ছাপ ফেলবে না?
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় ও বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে ভারত। কিন্তু তৃতীয় কোনও রাষ্ট্রের সম্পর্কে ভারত কী অবস্থান নেবে, সেটা ভারত নিজের স্বার্থ অনুযায়ী স্থির করবে, আমেকরিকার কথায় নয়। মার্কিন বিদেশসচিব কন্ডোলিজা রাইস অতীতে নিউউয়র্ক সফরে আসা তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ভারত মায়ানমারের জুন্টা সরকারকের সমর্থন না করে আউং সান সুচির গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন করুক। ভারত কিন্তু সুচির সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রেখেও সামরিক জুন্টা সরকারের সঙ্গে বিবাদে যায়নি। বরং প্রণববাবু বেজিংয়ের সঙ্গে জুন্টা-সরকারের সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে তাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক রক্ষার প্রয়োজনীয়তা আমেরিকাকে বুঝিয়েছিলেন। ভারত সে দিন পাল্টা প্রশ্ন করেছিল, পাকিস্তানে পারভেজ মুশারফের সেনাশাসনকে সমর্থন করতে হবে, অথচ মায়ানমারে সেনাবাহিনীর সরকার বলে তাদের বিরোধিতা করতে হবে, এই যুক্তি মানা যায় না। আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নীতি আর ভারতের নীতির মধ্যে বিভিন্নতা থাকতেই পারে। তার অর্থ কিন্তু ভারত-আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে চিড় নয়।
আপাতত মনমোহন সিংহ এই ‘সাবালক বিদেশনীতি’ মাথায় রেখেই আগামিকাল নিউইয়র্ক পাড়ি দিচ্ছেন। |