এখনও আতঙ্কে রাত জাগছে গ্যাংটক।
শুধু রাতই বা কেন, দিনদুপুরেও রেহাই নেই ভূমিকম্পের গুজব থেকে। মঙ্গলবারই দুপুর দু’টো নাগাদ গুজব ছড়াল শহরের লালবাজার এলাকায়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বাড়িঘর খালি করে রাস্তায় নেমে এলেন বাসিন্দারা। অনেক দোকানপাটও বন্ধ হয়ে গেল তড়িঘড়ি। বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে সন্ধ্যার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হল। তবে ভয়াল ভূমিকম্পের পরে রবিবার থেকে যে রাস্তায় রাত্রিযাপন শুরু হয়েছে গ্যাংটকের, মঙ্গলবারও সেই রুটিন বদলের সম্ভাবনা নেই।
সম্ভাবনা নেই এখনই জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে আসারও। গ্যাংটক জুড়ে এখন তীব্র জলকষ্ট। সরকারি জল সরবরাহ ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে ভূমিকম্পের ধাক্কায়। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে ভ্যানে ড্রাম বোঝাই করে জল সরবরাহ করা হচ্ছে। সেই জল নেওয়ার জন্য বাসিন্দারা দফায় দফায় লাইন দিচ্ছেন। আকাল জ্বালানিরও। ধসে সড়কের বেহাল দশা। ফলে জোগান এমনিতেই কম। তার উপর ফের ভূকম্পের আশঙ্কায় অধিকাংশ পেট্রোল পাম্পই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অবস্থাও তথৈবচ। যখন তখন লোডশেডিং।
গ্যাংটক তো তবু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে, ভূকম্পের মূল কেন্দ্র উত্তর সিকিমের অবস্থা ভয়াবহ। বহু চেষ্টার পর মঙ্গলবার সকালে কোনও মতে মঙ্গন যাওয়ার রাস্তা ৩১এ জাতীয় সড়ক খোলা গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর কয়েকটি দল ত্রাণ নিয়ে সেখানে গিয়ে পৌঁছয়। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরেই দিকচুর দু’কিলোমিটার আগে ফের ধস নামে। ফের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। দিনভর প্রবল চেষ্টায় বিকল্প একটা পথ করা গিয়েছে বলে খবর। তবে চুংথাঙের মতো আরও উত্তরের গ্রামে পৌঁছতে আরও তিন-চার দিন সময় লাগবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই সব এলাকায় আকাশপথে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে সেনা বাহিনী। ১৫টি হেলিকপ্টারকে উদ্ধার কাজে লাগানো হয়েছে। |
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে যে বেশ খানিকটা সময় লাগবে, তা কবুল করছেন সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন কুমার চামলিং নিজেই। এ দিন তিনি বলেন, “ধসে কেউ চাপা পড়ে রয়েছেন এমন খবর এখন নেই। তবে লাচুং এবং লাচেন-এর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে।” সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, সব কিছু ঠিকঠাক হতে অন্তত এক মাসের ধাক্কা। ঘটনা হল, দূরবর্তী এলাকাগুলির কী অবস্থা, সে সম্পর্কে কোনও তথ্যই রাজ্য প্রশাসনের কাছে নেই। রবিবার গ্যাংটকে এসেছিলেন লাচুঙের তিপন গ্রামের প্রধান চোঙ নাগিন। এখনও ফিরতে পারেননি। ইয়ুমথাং যাওয়ার পথে এই তিপন গ্রামে রাত কাটান অনেক পর্যটক। সে রকম কেউ আটকে আছেন কি না, নাগিনের কাছে খবর নেই। তবে সব মিলিয়ে গ্রামের অবস্থা যে খুব খারাপ সেই খবর পেয়েছেন। “আমার সহকারী খবর পাঠিয়েছে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। কত জন মারা গিয়েছেন, বা আহত হয়েছেন জানি না,” বললেন নাগিন।
তিপনের মতো বহু দুর্গম এলাকায় এখনও পৌঁছতেই পারেনি উদ্ধারকারী দল। ফলে ঠিক কত জন মারা গিয়েছেন, আহতের সংখ্যা কত সঠিক করে কিছুই বলা অসম্ভব। |
এখনও পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী সিকিমে মৃতের সংখ্যা ৫৩। পশ্চিমবঙ্গে ৯। এর মধ্যে দার্জিলিঙে ৬ জন, উত্তর দিনাজপুরে ২ জন ও জলপাইগুড়িতে ১ জন। এ ছাড়া, বিহারে ৯ জন, নেপালে ১১ ও তিব্বতে ৭ জন করে মারা গিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এ দিন ফের চামলিংকে ফোন করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীকে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। ভূকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আজ রাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনীতি বিষয়ক কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে।
সিকিমে নতুন করে ধস নামার একটা বড় কারণ বৃষ্টি। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের গ্যাংটকের আধিকারিক গোপীনাথ রাহা বলেন, “মৌসুমি অক্ষরেখা হিমালয় পাদদেশ থেকে পুরোপুরি সরে যায়নি। ফলে বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকছেই। ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতিতে মাঝারি বা ভারী বৃষ্টি হলে ব্যাপক ধসের আশঙ্কা থাকেই। সোমবার গভীর রাতে গ্যাংটক লাগোয়া কিছু এলাকায় ধস নেমেছে।”
রাস্তা বন্ধ থাকার ফলে গোটা উত্তর ও পশ্চিম সিকিম জুড়েই বহু মানুষ আটকে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে স্থানীয় মানুষজন তো রয়েছেনই, আছেন পর্যটকেরাও। যাঁদের একটা বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া। স্বস্তির কথা এটাই যে, এই সময় সিকিমে পর্যটকের চাপ খুব বেশি থাকে না। ভিড় জমতে থাকে পুজোর সময়। তখন ভূমিকম্প হলে অবস্থা আরও ঘোরালো হত। তবে এখনও বিপাকে পড়া পর্যটকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। মহাকরণ সূত্রে বলা হচ্ছে, মঙ্গনের উত্তরে লাচুঙে পশ্চিমবঙ্গে ৬৮ জন পর্যটক আটকে রয়েছেন। বুধবার বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার তাঁদের উদ্ধার করার চেষ্টা চালাবে। পশ্চিম সিকিমের রাবংলায় কয়েক জন ছাত্র আটকে রয়েছেন। তাঁদের উদ্ধারের পথ খুঁজতে হেলিকপ্টারে এলাকা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। আটকে থাকা পর্যটকদের সম্পর্কে খোঁজখবর দিতে শিলিগুড়িতে একটি ২৪ ঘণ্টার হেল্পলাইন খোলা হয়েছে। যার নম্বর ০৩৫৩-২৪৩৩৯০০। |
গ্যাংটকে থাকা পর্যটকেরাও এখন যত শীঘ্র সম্ভব সিকিম ছাড়তে পারলে বাঁচেন। এ দিন সিংতাম এলাকায় দাঁড়িয়ে রাঁচির বাসিন্দা ব্রজেশ পাণ্ডে বলেন, “প্রায় চার মাস আগে সিকিম ঘোরার পরিকল্পনা তৈরি করে এসেছিলাম। এখন ভিড়ের চাপ থাকে না বলেই এই সময়টা বেছেছিলাম। ১৫ দিন ঘোরার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু রবিবার সন্ধ্যায় যে ভাবে বাড়িগুলো দুলতে দেখলাম, তাতে তিন দিনের মাথায় ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছি।”
পর্যটকেরা না হয় ফিরে যেতে পারেন। কিন্তু যাঁরা কাজে এসেছেন, তাঁরা কী করবেন? যেমন হুগলির মহেশ্বরপুরের মনোজিৎ সামন্ত। সরকারি পরিকাঠামো সমীক্ষার কাজে গ্যাংটক এসেছেন আজ পাঁচ মাস হল। ভূমিকম্পের তিন দিন পরেও তাঁর গলায় আতঙ্কের সুর, “শহরের সব লোক সন্ধ্যা থেকে রাস্তায় বসে থাকছেন। আমরাও তাঁদের সঙ্গে বসে রাত কাটাচ্ছি। বলা যায় না, আবার যদি ভূমিকম্প হয়!” ভূমিকম্পে গ্যাংটক শহর লাগোয়া লুমসে এলাকায় একটি প্রাথমিক স্কুলের কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে। পাশেই তৈরি হতে থাকা একটি দোতলা বাড়ি ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। গ্যাংটকের অন্যতম বাজার এলাকা নান্মান রোডের বহুতল শপিং মল, মেট্রো চার্চ, বাহাই স্কুল, মহাত্মা গাঁধী মার্গ, হেলিপ্যাড লাগোয়া বোদাখরি এলাকার অনেক বহুতলে বিপজ্জনক ফাটল ধরেছে। রাজভবন এবং রাজ্য পুলিশের সদর দফতরও ফাটলের হাত থেকে রেহাই পায়নি। গ্যাংটকের পুলিশ কর্মী বিনোদ সুনদাস বলেন, “শহরের বাসিন্দারা রাতে বাড়িতে থাকছেন না। রাস্তায় সব রাত কাটাচ্ছেন। সেই সঙ্গে চলছে ফের ভূমিকম্পের জোর গুজব।” সিকিমের নিরীক্ষা দফতরের কর্মী তপন থাম্বি বললেন, “রাতে আতঙ্কে দুই চোখের পাতা এক করতে পারছি না। বাড়িতে থাকতেও ভরসা পাচ্ছি না।”
সিকিমের ভূমিকম্প বিধ্বস্ত এলাকায় উদ্ধার কাজ চালাতে এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য দশ সদস্যের একটি দল পাঠাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ওই দলে পাঁচ জন চিকিৎসক আছেন।
দলটির নেতৃত্ব দেবেন এভারেস্টজয়ী বসন্ত সিংহরায়। মঙ্গলবার মহাকরণে এ কথা জানিয়ে রাজ্যের যুবকল্যাণমন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস বলেন, সিকিমের যুবকল্যাণমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে তাঁর এ ব্যাপারে কথা হয়েছে। প্রতিনিধি দলের চিকিৎসকেরা সবাই ট্রেকিংয়ে দক্ষ। ফলে তাঁরা দুর্গম এলাকায় পৌঁছতে পারবেন বলেই আশা করা হচ্ছে। |