|
|
|
|
চিন্তা নেই, পাশে আছি, পড়শি রাজ্যে গিয়ে আশ্বাস মুখ্যমন্ত্রীর |
কিশোর সাহা • গ্যাংটক |
রাস্তাতে অন্তত ২৫ জায়গায় ধস। ঝুরঝুর করে পাথর পড়ছে। অনেকেই বললেন, “যাবেন না।” কিন্তু তাঁর সোজা কথা, “যা হয়, হবে। বিপদের দিনে শুধু নিজের ঘর দেখলে চলবে?”
তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার দুপুরে ফেরার টিকিট বাতিল করে, ফুলবাড়ির এনএইচপিসি বাংলো থেকে গাড়িতে উঠে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়ের উদ্দেশে যিনি বললেন, “চলো মুকুল, কালিম্পং দেখে সিকিম।”
সিকিম পৌঁছতে মুখ্যমন্ত্রী কতটা উদগ্রীব, বোঝা গেল কালিম্পঙের লোহাপুলের কাছে তাঁর গাড়িটা হঠাৎ বিগড়োনোর পরে। বারবারই বলতে লাগলেন, “দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাকে ওখানে পৌঁছতেই হবে।”
দ্রুত গাড়ি বদলানো হল। কালিম্পঙের কির্নে এলাকায় থামল মুখ্যমন্ত্রীর নতুন গাড়ি। জনে-জনে দুর্গতদের খোঁজ নিলেন মমতা। আশ্বাস দিলেন। শহর পেরিয়ে রাস্তায় ছ’জায়গায় ধস দেখে ফোনেই যোগাযোগ করলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষের সঙ্গে। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা বলে।
সিকিমের প্রবেশদ্বার রংপোয় মমতার গাড়ি পৌঁছল দুপুর দেড়টায়। সেখানে তখন হাজির সিকিমের সাংসদ পি ডি রাই, গ্রামোন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী চন্দ্রবাহাদুর কার্কি। রীতিমাফিক ‘খাদা’ (উত্তরীয়) পরিয়ে মমতাকে বরণ করে নিতে নিতে চন্দ্রবাহাদুর বলেই ফেললেন, “আজ নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন আপনি। গত তিন দশকে পশ্চিমবঙ্গের কোনও মুখ্যমন্ত্রী এ ভাবে দুর্র্যোগের দিনে আসেননি সিকিমে।” মমতা প্রথমেই যান মনিপাল হাসপাতালে। ভূমিকম্পে আহতদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাঁর আশ্বাস, “আহতদের জন্য আমরা আগেই কিছু ওষুধ পাঠিয়েছি। আরও পাঠাব। চিন্তা করবেন না।” |
 |
সাহায্যের বার্তা নিয়ে ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত সিকিমে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্যাংটকের অদূরে লুমসেতে মঙ্গলবার। |
পরবর্তী গন্তব্য গ্যাংটক থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে গ্রাম, লুমসে। চন্দ্রবাহাদুর মমতাকে বললেন, “যেখানে ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল, তার থেকে আপনি বড়জোর ৬৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছেন।” লুমসেতে মারা গিয়েছেন ৩ জন। আহত ৩০-৩৫। ৬০-৭০টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত। হাওয়াই চটি পায়ে পাকদণ্ডী দিয়ে রাস্তা থেকে প্রায় ৬০০ ফুট নীচে ধ্বংসস্তূপ দেখতে নামলেন মমতা। বাড়ি ধসে গিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দা উমেশ ত্রিখত্রির। মমতার হাত জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। পড়শি মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়ে বললেন, “ভাবনার কিছু নেই। আমরা তো আছি। বিপদের দিনে প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে না দেখলে, কে দেখবে?” পরে গ্যাংটক শহরে সিকিম স্টেট জেনারেল হাসপাতালে গিয়েও রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। |
 |
সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিংয়ের সঙ্গে কথা বলছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার সিকিমে। |
তত ক্ষণে মমতার সঙ্গে বৈঠকের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে সিকিম প্রশাসন। গ্যাংটকে যে হোটেলটি প্রথমে বাছা হয়েছিল, সেটি বেসরকারি বলে সেখানে বৈঠকে রাজি হননি মমতা। সন্ধ্যায় গ্যাংটকে এনএইচপিসি-র অতিথিশালায় ওঠেন তিনি। সেখানে তাঁর সঙ্গে কথা হয় এনএইচপিসি-র পাঁচ নম্বর প্রকল্পের মুখ্য কার্যনির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার দেবজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের। দেবজিৎবাবু জানান, ভূমিকম্পে বিদ্যুৎ প্রকল্পের কোনও ক্ষতি হয়নি। ঘণ্টা চারেকের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছিল শুধু। ওই অতিথিশালাতেই সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিং ও অন্য মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন মমতা। বৈঠকের আগেই চামলিং মমতাকে বলেন, “আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব, ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।” মমতাকে তিনি জানান, ভূমিকম্পে সিকিমে আহত ১০০-রও বেশি। মৃতের সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়েছে। কিছু কিছু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় এখনও পৌঁছনো সম্ভব হয়নি। মমতা বলেন, “কোনও চিন্তা নেই। আমরা আছি। আপনাদের কী কী লাগবে, বলুন।” চামলিং বলেন, “আপনি যা দিয়েছেন, তা-ই যথেষ্ট।” এর পরে দু’জনের মধ্যে একটি একান্ত বৈঠকও হয়। সিকিম সরকার সূত্রে জানা গিয়েছে, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সাহায্য চাওয়া নিয়েই মূলত কথা হয়েছে তাঁদের মধ্যে। |
 |
সিকিমে ভূমিকম্পে জখম এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |
মমতার আগ্রহের মানচিত্রে সিকিমের অবস্থান অবশ্য নতুন নয়। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন গত সেপ্টেম্বরে তিনি উত্তরবঙ্গের সেবক থেকে রংপো পর্যন্ত রেল প্রকল্পের শিলান্যাস করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, ধস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলেও সিকিমের মানুষ যাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়েন, সে জন্যই ওই প্রকল্প। গ্যাংটক থেকে নয়াদিল্লি পর্যন্ত রেল যোগাযোগের বিষয়টি নিয়েও চিন্তাভাবনার আশ্বাস দিয়েছিলেন। সে সময় তো বটেই, এ দিনও মমতার উদ্দেশে পবন চামলিংকে বারবার বলতে শোনা গিয়েছে, “আমরা এত খুশি, বলে বোঝাতে পারব না।”
আর সিকিমের জনতা? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সফর ঘিরে তাঁরাও তো উচ্ছ্বসিত! গ্যাংটকের মিষ্টির দোকানদার রমেশ সিংহ, সব্জি বিক্রেতা লামচু ভুটিয়াদের কথায়, “বরাবর দেখেছি, বড় বড় নেতারা আমাদের এখানে বেড়াতে আসেন। ছাঙ্গু, নাথুলা ঘুরে ফিরে যান। এখানে এত বার প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তো দূর, কোনও মন্ত্রীকেই দেখিনি। এ বার দিদি এলেন। আমাদের পাশে দাঁড়ালেন। পশ্চিমবঙ্গে যে পরিবর্তন হয়েছে, বুঝতে পারছি।”
সিকিমের মন জয় করে সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ফেরার পথ ধরলেন মমতা। শিলিগুড়ি ফিরতে ফিরতে বেজে গেল রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ। রাতটা কাটিয়ে আজ, বুধবার কলকাতাগামী প্রথম বিমানটি ধরার কথা তাঁর।
|
ছবি: বিশ্বরূপ বসাক। |
|
|
 |
|
|