সময় এল কাছে... ছো থেকে মধুবনী, পোড়ামাটি
থেকে পাটকাঠি
সৌদামিনীর বড় শখের ছিল চাটাইটা। বরের দেওয়া প্রথম উপহার। সত্যনারায়ণের সাথে বিয়ের পরে কলকাতায় প্রথম বার দুর্গাপুজোয় আসে ‘সদু’। কত বড় মণ্ডপ! কী সুন্দর ঠাকুর! মেলা লোক! “যেটা ভাল লাগে বল।” বিস্মিত ‘সদু’কে বলেন সত্যনারায়ণ। শাশুড়ি ঠাকরুণ একটা চাটাইয়ের কথা বলেছিলেন বটে। সে কথা মনে পড়তেই চাটাইয়ের সঙ্গে এক জোড়া বেতের মোড়াও শিমুরালি নিয়ে গিয়েছিল সৌদামিনীরা।
বাঁশ, বেত আর চাটাইয়ে মোড়া মণ্ডপ এ ভাবেই সৌদামিনীদের স্মৃতি উস্কে দেবে। ৭৫ বছর আগের উৎসবের আমেজ ফেরাতে মাটি, খড় আর বাঁশ বেছেছেন ৭৫-এ পা দেওয়া ‘শিবমন্দিরে’র উদ্যোক্তারা। ‘আগডুম বাগডুম ঘোরাডুম সাজে...’। ‘ডুম’ অর্থাৎ ‘ডোম’। বাঁশের কাজে দক্ষ ডোমদের সম্মান জানাতে মণ্ডপের ভিতর ও বাইরে থাকছে বেতে মোড়া বাজনদারদের দল। সাবেক একচালার প্রতিমা দর্শনের অভ্যর্থনায় থাকছে ৩০ ফুট উচ্চতার বেতের ময়ূর।
ছেলে ঋককে প্রথম বার কলকাতার পুজো দেখাতে বার্মিংহাম থেকে আসছে নাতি সুমঙ্গল। পুজোয় বাংলার সংস্কৃতি আর কুটিরশিল্পের ঝলক। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। তাড়াতাড়ি চিঠি শেষের তাড়ায় ‘সদুমা’ লেখেন ‘এগুলো পড়ে দেখিস, মনে হয় বেশ ভাল লাগবে ঋ
কের’।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাড়ার পুজো ‘ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা’র মণ্ডপে ‘ছো-এর ছোঁয়া’। প্রধান শিল্পী বাঘমুণ্ডির চড়িদা গ্রামের বাসিন্দা রাজীব দত্ত। ছো নাচের মুখোশ, পোশাক, বাদ্যযন্ত্রে সাজবে মণ্ডপ। প্রবেশপথে ১৫টি তোরণ। মূল তোরণ ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র আদলে। বাকি তোরণগুলি বিভিন্ন পুরাণ-কাহিনির চরিত্র ভিত্তি করে। থাকবে কিরাত-অর্জুন, অভিমন্যু বধ, রাম-রাবণের যুদ্ধ, লব-কুশ, তারকাসুর বধ-সহ নানা ঘটনার নৃত্যরূপ।
ঘটপুজো প্রাচীন। মূর্তি বা পটপুজো প্রচলিত। এই দুয়েরই মেলবন্ধন ‘বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘে’। মাটির ঘটে মাটির বাহারি লতা, ফুলের উপরে বসছে ছ’ফুটের মাটির সরা। তাতে দুর্গার রিলিফওয়ার্ক। সাজ নিয়ে প্রতিমার উচ্চতা ১১ ফুট। মঙ্গল কাজে মাটির ঘট, ফুল, পাতা অপরিহার্য। তাই লতা-পাতা, ফুলের বিস্তার থাকবে মণ্ডপ জুড়ে। একই ভাবে মাটির সরায় থাকছেন অন্যান্য দেব-দেবী। দেওয়ালে সাদা, লাল ও গেরি মাটির রং। থাকবে পিতল, তামা, টিনের কাজ।
মধুবনের সিক্কি ঘাসের বুনোটে তৈরি হচ্ছে লেকটাউনের ‘নেতাজি স্পোর্টিং ক্লাবে’র এ বছরের মণ্ডপ। মধুবনী শিল্পীরা গড়ে তুলছেন মধুবনী শিল্পকলা। সঙ্গে থাকছে মানানসই মাতৃমূর্তি। উদ্যোক্তাদের বক্তব্য, মণ্ডপে সিক্কি শিল্প এর আগে দেখেনি থিমপুজোর শহর।
‘ধানের শীষে রঙিন বেশে, মায়ের চরণ পড়ল এসে।’ ধান্যরূপী অন্ন, সূত্ররূপী বস্ত্র ও শিল্পের মাধ্যমে শিক্ষার প্রার্থনায় বেহালার ‘নস্করপুর সর্বজনীন’। পাটকাঠি ও বেতায় হচ্ছে মণ্ডপ। মণ্ডপ ও প্রবেশপথে থাকবে ধান ও রঙিন সুতোয় তৈরি দ্বি-মাত্রিক ও ত্রি-মাত্রিক নানা শিল্পকর্ম। ওড়িশার নবরঙ্গপুর জেলার লিম্বাটা গ্রামের গণ্ড উপজাতির এই শিল্প সম্পূর্ণ অপরিচিত বলে দাবি উদ্যোক্তাদের।
বেলঘরিয়ার ‘বাণী মন্দিরে’র পুজোর অন্যতম আকর্ষণ কাটোয়ার শিল্পীদের তৈরি মেহগনি কাঠের ছ’ফুট উঁচু প্রতিমা। প্রবেশপথের দু’পাশ ও মণ্ডপ জুড়ে থাকবে দেব-দেবী ও তাঁদের বাহনের ছোট-বড় প্রায় সাত হাজার কাঠের পুতুল। কাঠেই হবে অন্দরসজ্জা। বেলঘরিয়াতেই ডানলপ ব্রিজের কাছে ‘নরেন্দ্রনগর সর্বজনীন’-এর ভাবনায় আবার ‘ব্রাত্যজনের শিল্প’। মণ্ডপ সাজাতে হাওড়ার ডোমজুড়ের ডোম সম্প্রদায়ের শিল্পীরা কঞ্চি দিয়ে তৈরি করছেন ছোট-বড় অসংখ্য প্রদীপ, শঙ্খ, কুলো, চুবড়ি-সহ নানা উপকরণ। কঞ্চির ঝাড়লণ্ঠন, প্রদীপের আঠারো ইঞ্চির বৈদ্যুতিক শিখায় আলোকিত হবে চারপাশ।
ওড়িশার মন্দিরের আদলে ‘সিঁথি বাঙালি সঙ্ঘে’র মণ্ডপের চূড়ো। কাঁথির শিল্পীরা খড়, হোগলা, মাদুর, দড়ি, কাঠের গুঁড়ো আর থার্মোকলের মণ্ডপে হোগলা ও চাটাইয়ের ঝাড়বাতি। মা দুর্গার শাড়ি-গয়নাতেও ব্যবহার হচ্ছে হোগলা পাতা।
‘গোয়াবাগান সর্বজনীন’-এর এ বার আশি বছর। লালপেড়ে সাদা শাড়ি-মাটির গয়নায় দেবী এখানে চিন্ময়ীরূপে। নাটমন্দিরের আদলে মণ্ডপে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ির কুন্নুর গ্রাম, উত্তর দিনাজপূর, বাঁকুড়া, কৃষ্ণনগর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মাটির শিল্পকর্ম। আলোকসজ্জায় ব্যবহার হচ্ছে মাটির কারুকার্য করা ল্যাম্প শেড।
নন্দীগ্রামের শিল্পীদের হাত ধরে দক্ষিণ ভারতের আলমপুরের মন্দির তুলে আনছে ‘নিমতলা সর্বজনীন’। সাবেক প্রতিমায় পোড়া মাটির রং। মাটির দেওয়ালে বসছে কাগজের মণ্ড, প্লাস্টার অফ প্যারিস এবং থার্মোকলে তৈরি বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। মণ্ডপ ও গোটা চত্বর জুড়ে থাকবে পোড়া মাটির শিল্প।
বাঁকুড়ার টেরাকোটা শিল্পের অনুকরণ ‘বড়িশা মিলনী সঙ্ঘে’র পুজোয়। ধানের গোলার আকারে মণ্ডপে প্রতিমাও মানানসই। বাংলার আটচালা ধাঁচে হচ্ছে ‘ফুলবাগান অধিবাসীবৃন্দে’র মণ্ডপ সাজবে কাঁথার কাজে। তবে মণ্ডপ যাতেই সেজে উঠুক, বেশিরভাগ পুজোতেই অবশ্য মা দুর্গা থাকছেন সাবেক ডাকের সাজে।
আজ আপাতত এই পর্যন্ত। ভাল থাকিস তোরা। ইতি, সদুমা।
পাঁচদিন পর ফোন করে সুমঙ্গল। “প্ল্যান একটু বদলেছে সদুমা। তোমার চিঠি পড়ে অবাক ঋক। মণ্ডপ, ভাসান দেখতে আরও কয়েক দিন থাকতে চায় কলকাতায়। মহালয়ায় যাচ্ছে। ফিরবে আমাদের সাথে।” ফোনের এ পারে তখন উচ্ছ্বসিত সদুমা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.