|
|
|
|
|
খুন্তি বা ফণা: যখন যেটা |
মেয়েরা মহা বেয়াদপ। সব জায়গায় সেঁদিয়ে যাবেই। কুমোরটুলি পোটোপাড়া অবধি ছাড় দিলে না গা!
যদিও শিল্পী হিসেবে বড় ব্যানারে তাদের নাম চোখে পড়বে না, কিন্তু দাপিয়ে তারা ঠাকুর গড়ছে বই কি! জয়ন্ত দাস |
ডান হাতে হিংস্র এক ফণা তোলা কালকেউটের মুদ্রা দেখিয়ে ফোঁস করে উঠলেন মায়ারাণী। বছর পঁচাত্তর বয়স। তবে ফুঁসে ওঠার তেজ কেউটেকেও লজ্জায় ফেলবে। মায়ারাণী তেমনই একটি বিষধর তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন যেটি মহিষাসুরকে দু’বার প্যাঁচ মেরে মোক্ষম ছোবলটি মারবে। মনে মনে আঁকা ছবিটিতে যতই বীররস থাকুক, বাস্তবে সেটি হচ্ছিল না।
মায়ের অসন্তোষ দেখে কন্যা মালা এক গাল হেসে বললেন, ‘মাটির কেউটে ফোঁস করবে কেমন করে মা?’ মায়ারাণী মাটির তাল মেয়ের দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, ‘ভঙ্গিটা করে দে না, তা হলেই ফোঁস করবে সাপ।’
কৃষ্ণনগরের গোয়ারি ষষ্ঠীতলার মেয়ে মায়ারাণী। স্মৃতি হাতড়ে বললেন, ‘বক্রেশ্বর পালের মূর্তি দেখে এই ভঙ্গি-ভাব বুঝতে শিখেছি। এক বার বক্রেশ্বর পাল মহিষের পেট চিরে অসুর বের করলেন, সঙ্গে নাড়িভুঁড়িও। সেই নাড়িভুঁড়ি দেখে ওপর থেকে জ্যান্ত শকুন নেমে এল। কত বড় কারিগর দ্যাখো। এই জন্যেই তো গোপেশ্বর পালের চেয়েও বড় শিল্পী বলে বক্রেশ্বরকে শকুন নামানো শিল্পী!’
দুলালচন্দ্রের স্ত্রী মায়ারাণী পুতুল তৈরির কাজটা শিখেছিলেন বাপের বাড়িতেই। ভাল সেলাই-ফোঁড়াইও জানেন। কিন্তু প্রতিমা তৈরিতে হাত পাকল ১৯৮৫ থেকে, স্বামীর মৃত্যুর পরে। নেমে পড়েন কন্যা মালাও। মা-মেয়েতে শুরু হয় নতুন অধ্যায়।
আড়াই দশক আগে কুমোরটুলিতে মা-মেয়ে ঠাকুর গড়ছেন, পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে লড়াই করছেন, সংসার সামলাচ্ছেন, এই মনের জোর এল কোথা থাকে?
মালা বললেন, ‘কামাখ্যাবালা পাল। তিনিই কুমোরটুলির মহিলা শিল্পীদের গুরুমা। তিনিই পথ দেখিয়ে গেছেন। বিরাশিতে গিরিশ মঞ্চে তাঁর হাত থেকে পুতুল তৈরির পুরস্কার নেওয়ার সময় মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। তাই এত দূর এগোতে পেরেছি।’ |
|
কাকলি পাল। |
কামাখ্যাবালা দেবীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ১৯৯০-এর সেপ্টেম্বরে। তখন মহিলা শিল্পী হিসেবে কুমোরটুলিতে তাঁর বেশ পরিচিতি। ধপধপে সাদা থান পরা অভিজাত চেহারা। কোলে গামছা পেতে মাটির কাজ করতেন। সহযোগী কারিগররা তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। বসেছিলেন, মাটির পুতুলের কাজ শিখেছিলেন বাপের বাড়ি শান্তিপুরে। রাস আর ঝুলনের পুতুল বানাতে বানাতে। বিয়ের পর মাটির কাজ প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বামী মাঝে মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে দায়দায়িত্ব নিতে হত। পুতুল বানানোর হাত এই ভাবেই প্রতিমা তৈরির সাহস জুগিয়েছিল।
কামাখ্যাবালা দেবী অবশ্য পরিবারের সূত্রেও শিল্পী হওয়ার যোগ্য। বলেছিলেন, ‘বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ি, দু’দিকেই আমার বড় খুঁটি। গোপেশ্বর পাল হলেন আমার দাদামশাইয়ের ভাগনে, ও দিকে শ্বশুরমশাইয়ের ঠাকুরদা হলেন বক্রেশ্বর পাল।’
স্বামীর অকালমৃত্যুতে কামাখ্যাবালা দুই কন্যাসন্তানকে নিয়ে কুমোরটুলিতে আসেন গত শতকের পঞ্চাশের দশকে। তার পর নিরবচ্ছিন্ন জীবনযুদ্ধ। বছর পনেরো বড় বড় প্রতিমা গড়েছিলেন। শেষ দিকে প্রতিমা বানাতেন ছোট ছোট। তখন তাঁর সহযোগী ছোট্ট নাতিটি।
কুমোরটুলিতে যেমন কামাখ্যাবালা দেবীর গল্প মুখে মুখে, কালীঘাটের পোটোপাড়ায় তেমনই শোনা যায় কুমারী চিত্রকর, সরলা চিত্রকর, বিমলা চিত্রকরদের কথা। কেউ বলেন, ওঁরা পট আঁকতেন, কারও মতে মূর্তি-শিল্পী। তবে এ পাড়ার গুণী দেবী ওরফে গুণধর চিত্রকরকে অনেকেই দেখেছেন নিজের হাতে খড় বেঁধে মূর্তি গড়তে। সেই ট্র্যাডিশন এ পাড়ায় ধরে রেখেছেন নমিতা চিত্রকর। চৈতন্যপুরের মন্মথ চিত্রকরের মেয়ে। কাজ শিখেছিলেন বাবার কাছে। রঙের কাজে হাতযশ বালিকা বয়সেই। নীহার চিত্রকরের বউ হয়ে পোটোপাড়ায় এসেও রঙের কাজ ছাড়েননি। তাঁর আঁকা প্রতিমার চোখ অল্প দিনেই খ্যাতি অর্জন করে। কিন্তু হলে কী হবে, দেবীর সুনজর থেকে তিনিও বঞ্চিত হলেন এগারো বছর আগে। নীহারবাবু চোখ বুজলেন। আর চার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁকে হাতে তুলে নিতে হল মাটি।
নমিতা দেবীর শ্রম ব্যর্থ হয়নি। মরসু্ম পড়তেই দুই কন্যা মধু আর মালতী এবং দুই বউমা খুকু ও পার্বতী তাঁর কাজে পালা করে হাত লাগাতে ছুটে আসছে। তাঁর ক্ষুদ্র কুটিরে তৈরি হবে গোটা আষ্টেক মূর্তি। সবই এক চালের ঠাকুর।
ফিরে চলুন কুমোরটুলিতে। কারণ কামাখ্যাবালার পথ ধরে ও পাড়ায় আরও কয়েক জন মহিলা শিল্পী এসে পড়েছেন। মালা পাল, চায়না পাল, কাকলি পাল। মালা আর চায়না পিতার মৃত্যুর পর প্রতিমা শিল্পী হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। কাকলি তাঁর স্বামী অসীম পালের অকালপ্রয়াণের পর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিন কন্যাই এই বঙ্গের মেয়ে। মালা আর চায়না কৃষ্ণনগরের। কাকলি ধুবুলিয়ার। |
|
মালা পাল ও তাঁর মা মায়ারাণী পাল। |
চায়না পালের ডেরায় গিয়ে দেখা গেল প্রায় ডজনখানেক মূর্তি গড়ার কাজ চলছে। মূল কারিগর দয়াল পাল। চায়না কখনও হাত লাগাচ্ছেন, কখনও বাড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছেন রান্না সারতে। সংসার, শিল্প, দুইই সামলাচ্ছেন। বললেন, ‘সবই অভ্যেস। গোড়ার দিকে অসুবিধে হত, এখন রপ্ত হয়ে গেছে।’ রপ্ত করে নিয়েছেন মালাও। তিনি এখন অনেকটাই কারিগর-নির্ভর। স্বামীও মূর্তি-শিল্পী। মূর্তিশিল্পের রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতা হোক বা দিল্লি মুম্বই চেন্নাইয়ে নিজের গড়া মূর্তি নিয়ে হাজির হওয়াই হোক, যথেষ্ট সময় পান তিনি।
তুলনায় কাকলি অনেক অপেশাদার। সংসারের কাজই বেশি করেন। ধুবুলিয়ার বর্ধিষ্ণু কৃষক পরিবারের মেয়ে। বললেন, ‘আমাকে ওখানে দেখলে পালবাড়ির মেয়ে বলে বোঝা যাবে না।’ শুধু মেয়ে দুটিকে মানুষ করতেই স্বামীর কাজ চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
এতক্ষণে মায়ারাণীর সেই কালকেউটে হয়তো তৈরি হয়ে গেছে। ভঙ্গিতেই ফোঁস করে ওঠার ইঙ্গিত। তবে কুমোরটুলি আর পোটোপাড়া অপেক্ষায় থাকল সেই মেয়েটির, যে পিতার মৃত্যু বা স্বামীর অবর্তমান হয়ে যাওয়ার জন্য নয়, যথার্থ শিল্পী হিসেবেই ফোঁস করে উঠবে। অন্তত ভঙ্গিতে।
|
ছবি: শুভেন্দু চাকী |
|
|
|
|
|