গায়ে কাছা। হাতে মাইক্রোফোন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাবু মণ্ডল বলছেন, “সাপে কাটলে ওঝার কাছে নয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান। আমি ভুল করেছিলাম। সেই ভুলে বাবাকে হারিয়েছি।”
বাবু একা নন। সঙ্গে রয়েছেন স্বাস্থ্য দফতরের কর্মীরা। মাঝে-মধ্যে বিডিও-ও। স্বাস্থ্যকর্মীদেরও বাড়ি-বাড়ি পাঠানো শুরু হয়েছে।
ঝাড়ফুঁক করা হলেও সাপের ছোবলে এক গৃহবধূর মৃত্যুর পের বছর চারেক আগে পুরুলিয়ায় হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়েছিল ওঝাকে। চিরাচরিত সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে। সামগ্রিক সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। ঘটনা হল, সাপে ছোবল খাওয়া রোগীদের নিয়ে বর্ধমানেও ছবিটা বিশেষ আলাদা নয়।
বর্ষাতেই সাপের ছোবলে মৃত্যু সবচেয়ে বেশি হয়। অথচ গত তিন মাসে বর্ধমানের কাটোয়া ২ ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক জনও সাপে কাটা রোগী যাননি। সেখানে যে বিষনাশক ইঞ্জেকশন ‘অ্যান্টি-ভেনম সিরাম’ (এভিএস) মজুত আছে, তা-ও জানতেন প্রায় কেউই। কিছু রোগী কাটোয়া হাসপাতালে গিয়েছিলেন। বাকিরা থেকে গিয়েছেন কুসংস্কারের ভরসাতেই। |
পরিণাম? কাটোয়া হাসপাতাল সূত্রের খবর, গত কয়েক দিনে ওই ব্লক থেকে অন্তত আট জন সাপে কাটা রোগী হাসপাতালে আনা হয়েছে। পাঁচ জন মারা যান। এর মধ্যে চার জনকেই প্রথমে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আনা হলেও তাঁদের বাঁচানো যায়নি।
বাবুর বাবা, স্থানীয় বেঙা গ্রামের বাসিন্দা বছর পঞ্চাশের সুনীল মণ্ডল এঁদেরই এক জন। তিনি ছাড়াও মৃত্যু হয়েছে পলাশি গ্রামের দিলীপ হালদার, রোন্ডা গ্রামের বছর বারোর রাকেশ ঘোষ, পাইকপাড়ার কিশোরী নার্গিস খাতুন ও ঘোড়ানাশ গ্রামের লক্ষ্মীরানি পালের। এই ‘পরিস্থিতি’তে ব্লক স্বাস্থ্য দফতর সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের আওতায় থাকা ২০টি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে ভিত্তিতে করে গ্রামে-গ্রামে প্রচার চালানো হবে। সদ্য পিতৃহারা বাবু তাতে সামিল হন।
প্রচার হচ্ছে গত বৃহস্পতিবার থেকে। শুক্রবার দাঁইহাট শহরের কাছে ব্যান্ডেল-কাটোয়া রেললাইনের ধারে পাইকপাড়ায় মাইকে বেজে ওঠে বাবুর কান্নাভেজা গলা, “বাবাকে দাঁইহাটে এক ওঝার কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি বেশ কয়েক ঘণ্টা কেরামতি করার পরে জানিয়ে দেন, আর কিছুই করার নেই। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে বাবা মারা যান।”
উপস্থিত সকলের কাছে প্রতি বাবুর আবেদন, “আমরা ভুল করেছিলাম। আর বুজরুকি নয়, বিজ্ঞানে ভরসা রাখুন আপনারা। কাউকে সাপে কাটলে তৎক্ষণাৎ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান।” পাইকপাড়ার সদ্য কন্যাহারা দম্পতি বাবর আলি শেখ ও ফিরোজা বিবির চোখে তখন জল। আর আক্ষেপ, “আমরা তো জানতামই না, ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সাপে কাটার ওষুধ আছে!”
সভায় বিডিও নির্মলকুমার দাস এবং ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক চন্দ্রশেখর মাইতিকে সামনে পেয়ে স্থানীয় বাসিন্দা কুতুব শেখ, সোনা বিবি, ইয়াকুব মল্লিকদের ক্ষোভ “পাইকপাড়া থেকে মাত্র কয়েকশো মিটার দূরে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। অথচ সেখানে সাপের বিষের ওষুধ রয়েছে বলে আগে আমাদের কেউ কিছু জানায়নি।” ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকের সাফাই, “ওঁরা যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এভিএস থাকার কথা জানেন না, সেটাই আমরা জানতাম না!”
দু’তরফেই এই ‘না জানা’র জন্য কিন্তু অনেক মাসুল দিতে হয়েছে। ওঝার বদলে হাসপাতালে যাওয়ার সচেতনতা যাঁদের আছে, তাঁরাও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না গিয়ে আরও ১০-১২ কিলোমিটার দূরে কাটোয়া হাসপাতালে ছুটতেন। মাঝপথে মৃত্যুও কম হয়নি।
চন্দ্রশেখরবাবু জানান, প্রচারে কাজও হচ্ছে। বুধবার অর্থাৎ প্রচার শুরু হওয়ার সাত দিনের
মধ্যে পাঁচ জন সাপে কাটা রোগী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছেন। বেঁচেও গিয়েছেন। তাঁর মতে, “এ বার ওঝাগিরি বন্ধ করা দরকার। তবে মৃতের ছেলে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বলায় গ্রামবাসী সহজে ভুল বুঝতে পারছেন।” “আমাকেও যদি আগে কেউ বলত!” আফশোস যাচ্ছে না বাবুর। |