|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
আমাদের শহরের এক পদাতিক |
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় তৃতীয় ভুবন, মৃণাল সেন। আনন্দ, ৩০০.০০ |
আকিরা কুরোসাওয়ার আত্মজীবনীর নাম ছিল সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি। মৃণাল সেনের তৃতীয় ভুবন অনেকটাই সে রকম। পার্থক্য শুধু কুরোসাওয়া তুলনায় দার্শনিক বলেই অনেক মগ্ন ও গহন চেতনার যাত্রী; মৃণাল সেখানে আমাদের শহরের এক পদাতিক, যিনি আযৌবন সময়ের নাড়ি ছুঁয়ে বসে আছেন। মৃণাল সেন কথা বলেছেন একেবারে চলচ্চিত্রকারের ধরনে। তাতে সময়ের পরম্পরা নেই। এমন নয় যে বাস্তব জীবনে সময় যে ভাবে এগিয়ে যায়, মৃণাল তাকে অনুসরণ করেছেন। বরং আধুনিক চলচ্চিত্রের রেওয়াজে তিনি ফ্ল্যাশ ব্যাক ও ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড মিলিয়ে দিয়েছেন। এই তিনি ‘ওকা উড়ি কথা’ নিয়ে কথা বলছেন হঠাৎ প্যারিসে চলে গেলেন অঁরি লংলোয়া-র স্মৃতিভ্রমণে, সিনেমাতেক ফ্রঁসেইজের সেই ঐতিহাসিক পুরুষ স্বয়ং জঁ ককতো যাকে চলচ্চিত্রের রত্নভাণ্ডারের যক্ষপ্রহরী বলতেন। তার পরেও মাও স্মৃতিসৌধ ছাড়িয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসের আলোচনাচক্রে। ১৯৮০-তে ‘আকালের সন্ধানে’-র লোকেশন দেখতে দেখতে ঢুকে পড়েন তিনি তেতাল্লিশের মন্বন্তরে, আর তার সঙ্গে জুড়ে দিতে পারেন সেমিনারে প্রশ্নোত্তর পর্বের ফেলিনি, আর গীতা সেনের জন্য না-পোস্ট-করা চিঠি। কান উৎসবে ‘খণ্ডহর’ দেখানোর বিবরণ দিতে দিতে চলে যান স্পেনের গৃহযুদ্ধে ও আবার ফিরে আসেন শতাব্দীর শুরুতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের উত্তর গেটে পুত্র কুণালের প্রতিনিধি হিসেবে কোনও পুনর্মিলন সভায়।
তাঁর এই যাওয়া-আসা, অরৈখিক এই স্রোতে-ভাসা যেমন সিনেমায় স্থান নিয়ে নির্বাক চলচ্ছবির আচার্য কুলেশভের ভাষায় ‘সৃজনশীল ভূগোল’ গড়ে তোলে তেমনই জীবনে আঁদ্রে বাজাঁর মতো বাস্তববাদী চলচ্চিত্রতাত্ত্বিক যাকে বলেন ‘মন্তাজের বিমূর্ত অনুমিত সময়’ তা রচনা করে। কী এক অলৌকিক রসায়নে ফরিদপুরের বাঙালবাড়ির ছেলে মৃণাল সেন রূপান্তরিত হয়ে যান বিশ্বনাগরিকে; একদিন গীতা সেনের মুখে দেখা লাজুক অভিব্যক্তি অনুবাদ করে দেন স্মিতা পাটিলের আধেক আঁখির কোণে!
এমন ভাবেই আমরা দেখেছিলাম ‘ইন্টারভিউ’ ছবিটির সেই বিবস্ত্র ম্যানিকিন। অবাক বিস্ময়ে বুঝেছিলাম একটি প্রজন্মের রাগ আর ঘৃণা মৃণাল কী অনায়াসে ছেপে দিতে পারেন ছায়াছবিতে। ‘ইন্টারভিউ থেকে কোরাস’ যখনই সত্তর দশকের রাস্তায় হাঁটতাম, মনে হত অদৃশ্য সহযাত্রী মৃণাল সেন। আমাদের গীতবিতান তছনছ হয়ে যেত চৌরঙ্গিতে, আমাদের পাড়ায় পাড়ায় ব্যর্থ বসন্ত আর আমাদের জমায়েতে, চত্বরে, ছাত্রদের তর্কমালায় ছড়িয়ে পড়ত মৃণাল সেনের শহরের টুকরো সৌন্দর্য! আজও দেখতে পাই যাদবপুরের ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে মৃণাল সেন; তাঁর সৌজন্যেই ছাত্রদের জন্য টুলের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন বার্লিনের পাল্টা উৎসবের দায়িত্বে থাকা উলরিশ গ্রেগর। কিন্তু সে তো চল্লিশ বছর আগের কথা। আজও এই বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে সময়ের সঙ্গে সহবাসের চিহ্ন; নিজের সময়ের ঠোঁটে চুম্বনের দাগ গোপন করায় মৃণাল সেনের কোনও আগ্রহই নেই। আইরিশ মারডক একবার জঁ-পল সার্ত্র প্রসঙ্গে সুন্দর একটি অভিধা খুঁজে পেয়েছিলেন সেলফ কনশাসলি কনটেমপোরারি। মৃণাল সেনও বস্তুত তাই: আত্মসচেতন ভাবে সমসাময়িক। এত স্ব-বিরোধ আর কোনও চলচ্চিত্রস্রষ্টার নেই। কিন্তু এক নিশ্বাসেই বলার যে, নিজেকে অবিরত পাল্টে নেওয়ার দৃষ্টান্ত কি আর কারও আছে? মৃণাল সেন কতটা প্রতিভা, এ নিয়ে যে উন্নাসিকেরা একদা প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাঁরা খেয়াল করেননি যে সারিবদ্ধ জনসাধারণের এক জন যাঁর হওয়ার কথা ছিল, তিনি গোপনে এক প্রণালিবদ্ধ সাধনায় বিশিষ্ট হয়ে উঠেছেন। এ বই আমার বিবেচনায় তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতার পক্ষে উচ্চাশার নীল নকশা। |
|
বারে বারেই আমরা দেখছি বড় ইতিহাসকে তিনি দেখতে চান ছোট কোনও আখ্যানের মধ্য দিয়ে। ধ্বংসস্তূপের একটি ছোট টুকরো নিয়ে মৃণাল পুরো প্রাসাদটির পুনর্নির্মাণ সম্ভব করেন। তাঁর লেখা বেশ বুঝিয়ে দেয় ‘বাইশে শ্রাবণ’ শুধু একটি সুনির্মিত সমাজবাস্তববাদী আখ্যান নয়। মাধবী-জ্ঞানেশের প্রণয়কথা ও তার ব্যর্থতা আসলে ইতিহাসের অমঙ্গলকে পারিবারিক সীমানায় ধরতে চেয়েছে। বিষ্ণু দে রবীন্দ্রপ্রয়াণ তিথিকে সমগ্র জাতীয় জীবনের শোকোচ্ছ্বাসের প্রতীক হিসেবেই ভেবেছিলেন। মৃণাল এই বিয়োগগাথাটিকে রবীন্দ্র-বিরহিত করে টেনে এনেছেন ইতিহাসের প্রান্তসীমায়। সেন্সর কর্তৃপক্ষের রবীন্দ্রপ্রীতি এ খেলার নিয়ম স্বভাবতই একদা অনুমান করতে পারেনি। লেখক সে কাহিনি চমৎকার পুনরুদ্ধার করেছেন। স্পেক্ট্যাকলের বিরুদ্ধে দৈনন্দিনতা আধুনিক চলচ্চিত্রের তত্ত্ববিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মুসোলিনির পতনের থেকে অনেক মূল্যবান মনে হতে পারে ‘বাইসাইকেল চুরি’। ‘মুক্ত শহর, রোমে’ মৃতা তরুণীর মুক্ত উরুদেশ তাচ্ছিল্য করতে থাকে সমুদ্রশাসনের দম্ভকে। মৃণাল সেনের অন্বিষ্ট ছিল ইতিহাসের অশুভ যাত্রাকে একটি তুচ্ছ দম্পতির তুচ্ছতর মিলনরজনীতে পৌঁছে দেওয়া। শেষ পর্যন্ত পরিবার ও প্রেম জাতীয় ধারণাগুলিকেই যখন মৃণাল অর্থনৈতিক ইতিহাসের সূত্রে আপেক্ষিক প্রমাণ করতে থাকেন, তখন আমরা বুঝি অতিকথার রোজনামচা।
আর ‘ভুবন সোম’ তো উপমারহিত। অবসিত গরিমা আমলাতন্ত্রের প্রতি এমন ঠাট্টা আমাদের ছায়াছবিতে আর নেই। পুতুলনাচের ইতিকথা যেমন গ্রাম নিয়ে লেখা কোনও উপন্যাস নয়; আদ্যন্ত শাহরিক। তেমন ভাবেই ‘ভুবন সোম’ আশিরপদনখে একটি নাগরিক সমকালীনতা প্রবর্তন করে ভারতীয় সিনেমায়। সুহাসিনী মুলে, প্রায় বনলতা সেনের মতো দেহলতা থেকে হয়ে উঠেছেন স্থির দামিনীর মতো শরীর! ভুবন সোম কোনও ট্র্যাজেডির নায়ক নয়, বরং একটি সম্ভ্রান্ত বিদূষক। তাকে বুঝতে গেলে ডন কিহোতে যতটা কার্যকরী, শেক্সপিয়র ততটা নন। এ তো এখন সকলেই জানেন বা মানেন যে ‘ভুবন সোম’ থেকেই আমাদের চলচ্ছবির দ্বিতীয় তরঙ্গের সূচনা, যাকে আজকাল পারিভাষিক অর্থে নবীন ভারতীয় চলচ্ছবি বলা হয়ে থাকে।
এ ভাবেই একদিন মৃণাল সেন দেখেন বার্লিন দেওয়াল ধসে পড়েছে মধ্যবিত্তের শয়নকক্ষে। তাঁর ছবিগুলি ক্রমেই কলকাতাকে এমন পরিসর হিসেবে বর্ণনা করে, যার অণুবাস্তব ধারণ করে থাকে ‘সর্বজনীক দক্ষিণ’-এর বাস্তবতা। যৌবনের বামপন্থা তাঁকে একটি পৃথিবী ছেড়ে আসতে পরামর্শ দেয়। আর একটি তাঁর চোখের সামনে বিপর্যস্ত হল। এখন তো ‘তৃতীয় ভুবন’ তাঁর একমাত্র আশ্রয়। আশ্চর্য! এই মুহূর্তে তিনি আসমুদ্রহিমাচলে চলচ্চিত্রের প্রবীণতম পথিক, তবু নন্দনের সিঁড়িতে তাঁকে পয়গম্বর মনে হয় না। তাঁর সঙ্গে আমাদের এই মৈত্রী; এই মনান্তর! মৃণাল সেন লুকোচুরি খেলে যান তাঁর বার্ধক্যের সঙ্গে; তাঁর ক্যালেন্ডারে পাতা হলদে হয় না।
আর মৃণাল সেন কিন্তু জীবনে লেখায়-সিনেমায় সর্বত্র মধ্যবিত্ত বাঙালিয়ানা রেখে যেতে চান। হয়তো ‘বাইশে শ্রাবণ’ থেকেই তিনি নথিভুক্ত করে এসেছেন কী ভাবে বাঙালি মধ্যবিত্ত যুগের অদৃশ্য আয়নায় নিজেকে প্রসাধিত করে। মূলত স্ব-শ্রেণির ব্যর্থতা ও বিচ্যুতির তিনি সমালোচক। তবু এই বইয়ের লেখক সাবেকি ও পারিবারিক; সস্ত্রীক, সপুত্র ও সপুত্রবধূ তিনি বেঁচে আছেন। যেমন বার্গমান ‘ম্যাজিক লণ্ঠনে’ বা বুনুয়েল ‘শেষ নিশ্বাসে’ বলতে পারেন কোলাহল তো বারণ হল, এ বার কথা কানে কানে। মৃণাল সেন তা পারেন না, চানও না। ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড’ বা ‘নন-ওয়েস্ট’ যা-ই বলা হোক না কেন, তাঁর তৃতীয় ভুবন-এ সিনেমা আর সিনেমার সংলাপ কখনওই ক্লান্তি ছড়ায় না। এই বইয়ের প্রতিটি পাতায় তো আমরা যারা সিনেমা-বায়োস্কোপ দেখে মজে আছি, তাদের হাসিখুশি... আনন্দের বর্ণপরিচয়।
কী ভাল ছাপা! কী ভাল মলাট! একটু বড় হরফে চোখের কী আরাম! মনে হল বড় একটা ইতিহাসকে ছোট একটা জীবনীতে ছুঁয়ে ফেললাম! |
|
|
|
|
|