বিপন্ন সৈকত: পাঠকদের মতামত

চাই পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ
সমুদ্র-সৈকত ও নদী-পাড় ভাঙনের মূল কারণ অবৈধ নির্মাণ এবং নির্বিচারে বৃক্ষ-নিধন। এই ভাঙন কেবল প্রাকৃতিক ভাবেই রোধ করা সম্ভব। কৃত্রিম ভাবে দেওয়াল দিয়ে বা পাড় বাঁধিয়ে সৈকত-ভাঙন রোধ করা সম্ভব নয়।
মাটিক্ষয় রোধকারী গুচ্ছমূল জাতীয় বৃক্ষ পাড় বা সৈকত বরাবর লাগাতে হবে। এই গুচ্ছমূল জাতীয় উদ্ভিদ মাটিকে কংক্রিটের থেকেও শক্ত ও ভাল ভাবে আঁকড়ে থাকে। যদি মাটিক্ষয় হয়ও, এই জাতীয় উদ্ভিদ নিজের বেঁচে থাকার তাগিদেই মাটির খুব গভীরে শিকড় চালিয়ে দেয়। মাটিক্ষয় তার ফলে রোধ হয়। আমাদের দেশে নারকেল, সুপারি ও বাঁশ জাতীয় উদ্ভিদ মাটিক্ষয় রোধে খুবই সহায়ক। সমুদ্র-সৈকত বা লবণাক্ত জায়গায় নারকেল ও সুপারি এবং অন্য জায়গায় নারকেল, সুপারি ও বাঁশ গাছের মিশ্র-বেড় তৈরি করা যেতে পারে। এই উদ্ভিদ-বেড় তৈরি করতে হবে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে। প্রতিটি নারকেল গাছ ৮ ফুট অন্তর লাগাতে হবে। এবং একই সারিতে দু’টি নারকেল গাছের মাঝে দু’টি সুপারি গাছ লাগাতে হবে। পরের সারিতে নারকেল গাছের জায়গায় সুপারি ও সুপারি গাছের জায়গায় নারকেল গাছ লাগাতে হবে। গাছ লাগাতে হবে বর্ষার শেষে বা শীতের শুরুতে। যাতে পরের বর্ষার আগে গাছ শিকড় বুনতে পারে। কিন্তু কখনও গ্রীষ্ম বা বর্ষার সময়ে গাছ লাগানো যাবে না। তাতে গাছ শিকড় বোনার সময় পাবে না এবং জলোচ্ছ্বাসে গাছ নষ্ট হয়ে যাবে।
গাছ প্রথমে সরকারি ভাবে লাগাতে হবে। পরে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থানীয়দের চুক্তি-ভিত্তিতে কাজে লাগাতে হবে। যাতে এই উদ্ভিদগুলি থেকে সরকার ও চুক্তিগ্রহীতা উভয়েই অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হয়। বহিরাগতকে এই কাজে লাগালে রক্ষণাবেক্ষণ ঠিক মতো নাও হতে পারে। গাছ কোনও ভাবে নষ্ট হলে চুক্তিগ্রহীতাকে নিজ ব্যয়ে লাগাতে হবে। এবং সেই চুক্তিগ্রহীতা স্থানীয় প্রশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। আর অবশ্যই সমুদ্রপাড় থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে কোনও নির্মাণ করা যাবে না। এই ১০০ মিটারকে দু’ভাগে ভাগ করে ডাঙার দিকে ৭০ মিটার ও জলের দিকে ৩০ মিটার পর্যন্ত জিগ-জ্যাগ পদ্ধতিতে গাছ লাগাতে হবে।

ফিরিয়ে দিন ‘নোনা চাতর’
‘বিপন্ন সৈকত’-এ আমাদের মতো উপকূল অঞ্চলের বাসিন্দাদের আতঙ্ক তুলে ধরার জন্য আনন্দবাজারকে ধন্যবাদ। আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক। এখন বয়স তেষট্টি। আমার জন্ম উপকূলবর্তী ঝাউগেড়িয়া গ্রামে। শৈশব, কৈশোর ও যৌবন কেটেছে সমুদ্রের ঢেউ-এর সঙ্গে খেলা করে, মাছ ধরে, নোনা জলের আস্বাদ গ্রহণ করে। ছোটবেলায় দেখেছি বর্তমান পুরনো দিঘা শহর থেকে সমুদ্র কমপক্ষে দু’কিলোমিটার দূরে ছিল। বেলাভূমি ছিল ভিজে অথচ শক্ত। বেলাভূমিতে দিঘার আদি বাসিন্দা জে এফ স্মিথ সাহেবের ছোট প্লেন নামত। দেখেছি দিঘার বর্তমান নেহরু ময়দানে ১৯৬৪ সালে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন। বাবা-ঠাকুরদার কাছ থেকে শুনেছি, প্রায় ১৫০ বছর আগে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকরা দিঘা থেকে কাঁথি পর্যন্ত বিরাট উপকূলভাগ রক্ষা করার জন্য প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু সমুদ্রবাঁধ তৈরি করিয়েছিলেন।
এই সমুদ্রবাঁধ ছিল একটু অন্য রকম। সমুদ্রের ঢেউ বা জোয়ারের জল যাতে উপকূল এলাকায় খেলে বেড়াতে পারে, সে জন্য ওই বাঁধগুলি অশ্বক্ষুরাকৃতি আকারে তিন-চার কিমি অন্তর গ্রামের দিকে অর্থাৎ উত্তর দিকে ঘুরিয়ে নেওয়া হত। যেমন নায়কালি খাস গ্রাম থেকে বর্তমান রামনগর পর্যন্ত বাঁধটি ঢুকে এসে আবার দক্ষিণ দিকে ঘুরে সোজা শঙ্করপুর পর্যন্ত চলে গিয়ে আবার জলধা থেকে উত্তর দিকে গিয়ে ফের দাদনপাত্রবাড়ের কাছে ঠেকেছে। এই ভাবে সমুদ্রবাঁধ তৈরির পর দেখা যেত যে সমুদ্রের ঢেউয়ের ধাক্কা তীরভূমিতে না লেগে ওই অশ্বক্ষুরাকৃতি ফাঁকা জমিতে খেলে বেড়াত। ওই ফাঁকা জমিকে আমরা বলতাম ‘নোনা চাতর’। জোয়ারের খেলে বেড়ানোর ফলে দিঘার বিস্তীর্ণ ও সুপ্রশস্ত ঝাউবন রক্ষা পেত। এ ছাড়া উপকূলবর্তী এলাকার জনজীবনের আর্থিক স্বচ্ছলতায় ওই নোনা চাতরের বিশেষ ভূমিকা ছিল। উপকূলবর্তী এলাকার প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষ নোনা চাতরে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সমুদ্রের বেলাভূমি প্রশস্ত হওয়ার জন্য বহু মৎস্যজীবী ‘সারানি’ জালের সাহায্যে মাছ শিকার করতেন। এই সারানি জাল ওড়িশার উপকূলে এখনও দেখা যায়।
এ বার মূল প্রসঙ্গে আসি। গত চল্লিশ বছর ধরে দেখছি, সমুদ্রবাঁধের ওই অশ্বক্ষুরাকৃতি নোনা চাতরগুলিতে মাছের ঘেরি তৈরি করা হয়েছে। তার ফলে সমুদ্রের জোয়ারের ঢেউ আর নোনা চাতরে খেলে বেড়াতে পারছে না। তাই সমুদ্রের ঢেউ ধাক্কা মারছে দিঘাকে এবং শংকরপুর, জামড়া, তাজপুর, জলধা গ্রামগুলিকে। সমুদ্রের আন্ডার কারেন্ট এই সব এলাকার মাটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওড়িশার তালসারির দিকে।
ছোটবেলায় শুনেছিলাম, আমার জন্মের আগে ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে যে সুপার সাইক্লোন এই মেদিনীপুরে হয়েছিল, তাতে সমুদ্রের ঢেউ প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু হয়েছিল। কিন্তু ওই সমুদ্রবাঁধকে (sea dyke) টপকাতে পারেনি। উপকূলবাসী হিসাবে আমার প্রার্থনা, ওই ‘নোনা চাতর’ আমাদের ফিরিয়ে দিন।

অবৈধ নির্মাণ বন্ধ হোক
আপনাদের এই সুন্দরী দিঘাকে নিয়ে প্রতিবেদন ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ আজ নয় যুগ-যুগ ধরে চলছে। আমার মনে হয় নিম্নলিখিত কার্যক্রমের মাধ্যমে ভাঙন সমস্যার সমাধান সম্ভব।
(১) নতুন করে দিঘা থেকে রসুলপুর পর্যন্ত বালিয়াড়ি সৃষ্টি করতে হবে।
(২) খুব কম করে ২০ লক্ষের মতো ঝাউ, আকাশমণি গাছ ওই বালিয়াড়িতে লাগাতে হবে।
(৩) বালিয়াড়িগুলোর ঠিক পিছনে কংক্রিটের ব্লক তৈরি করতে হবে যাতে ঢেউ-এ বালিয়াড়ি না ভেঙে যায়। খুটি-বল্লির দ্বারা পাইলিং করে বালিয়াড়ি-ব্লককে আরও মজবুত করতে হবে। জিও-টিউবের থেকে গাড়ির পুরনো টায়ারের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। তাই পুরনো টায়ার দিয়ে ব্যারিকেড করতে হবে। ব্লক বানাতে হবে।
(৪) অবৈধ হোটেল নির্মাণ বন্ধে প্রশাসনকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
(৫) সৈকত ও আশপাশকে ‘প্লাস্টিক-বর্জিত’ এলাকা ঘোষণা করতে হবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.