সম্প্রতি এই পত্রিকার এক পাঠক সংস্কৃত ভাষাকে বিদ্যালয়ে অবশ্যপাঠ্য করিবার আবেদন জানাইয়াছেন। (‘বিদ্যালয়ে সংস্কৃত আবশ্যিক হোক’, ৮-৯) প্রস্তাবটি মূল্যবান। সংস্কৃত যে ঐতিহ্যপূর্ণ এক সাহিত্যভাণ্ডারের প্রকাশ মাধ্যম, জ্ঞানবিজ্ঞানের ধারক তাহা আমরা অনেক সময় বিস্মৃত হই। বিশেষ করিয়া পশ্চিমবঙ্গে একদা আগমার্কা জনদরদি বামেরা ভাষার প্রশ্নে বৈপ্লবিক সংকীর্ণতা জারি করিয়াছিলেন। তাঁহাদের বিপ্লববাদী দরদিয়া চক্ষে ইংরাজি কেবল উপনিবেশের প্রভুদের ভাষা হিসাবে পরিগণিত হইয়াছিল আর তাঁহারা ভাবিয়াছিলেন সংস্কৃত বুঝি কেবল পুরোহিততন্ত্রের ভাষা। ফলে সংস্কৃত ও ইংরাজি শিক্ষার ব্যবস্থাপনাকে নিকেশ করিয়াছিলেন। সর্ব স্তরে সহজিয়া এক ফাঁকিবাজি কায়েম হইয়াছিল। জ্ঞানের অবনমন ঘটিয়াছিল। বঙ্গবাসী তাহাদের ভাষা শিক্ষার ঐতিহ্য ভুলিয়াছিল। এ ক্ষণে ইংরাজির প্রয়োজন বঙ্গজগণ টের পাইয়াছেন, যেমন করিয়া পারেন তাহা শিখিবার প্রয়াস করিতেছেন। কিন্তু সংস্কৃতের প্রতিও মনোযোগ আবশ্যক। পাশ্চাত্যে ইংরাজি, ফরাসি, জার্মান এই তিন ভাষা জানা শিক্ষিত মানুষ শিক্ষাক্ষেত্রে সহজেই চোখে পড়ে। ইংরেজি, সংস্কৃত ও বাংলা এই তিন ভাষাই বা শিক্ষিত বাঙালি জানিবেন না কেন! একদা তো জানিতেন।
শুধু বিদ্যালয় স্তরে নহে, উচ্চশিক্ষায় কতকগুলি বিষয় পড়ার জন্য সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যের জ্ঞান আবশ্যক। বিশেষ করিয়া বাংলা ভাষা-সাহিত্যের ও প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের পড়ুয়াদের সংস্কৃত না জানিলে চলিবে কেন! প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির কথা জানিতে হইলে সংস্কৃতে রচিত মূল গ্রন্থাদি পড়িতে হইবে। বাংলা ভাষার গতিপ্রকৃতিই বা কেমন করিয়া সংস্কৃত ছাড়া জানা সম্ভব! যদুনাথ সরকার একটি পত্রে প্রাচীন ইতিহাসের পড়ুয়াদের সংস্কৃত পাঠ করিতে নির্দেশ দিয়াছিলেন। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের শ্রুতকীর্তি অধ্যাপকরা সচরাচর সংস্কৃতে পারঙ্গম। ফাঁকিবাজি করিয়া যে উচ্চশিক্ষিত হওয়া যায় না, এ কথা স্বীকার করিবার সময় আসিয়াছে।
আর এক দিকও বিবেচনাযোগ্য। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা ভাষণে উইলিয়াম জোন্স সংস্কৃতকে গ্রিক ও লাতিন ভাষা অপেক্ষাও উন্নততর বলিয়াছিলেন। আধুনিক কালে ভাষাবিদরা সকল মানবভাষাকেই গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া মনে করেন। কোনও ভাষাই কম মর্যাদাপূর্ণ নহে। সত্য কথা। তবে একটি ভাষা অপর ভাষার তুলনায় ব্যাকরণগত দিক দিয়া অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত হইতে পারে। পুরাতন ভাষাবিদরা ও অধুনা গণকযন্ত্রবিশারদরা দেখাইয়াছেন, সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মাবলি অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিনির্ভর। পাণিনি এই ভাষাকে যে নিয়মের সীমায় প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহার বর্ণবিন্যাস হইতে শুরু করিয়া ব্যাকরণের নিয়ম, সর্বত্র এক সুসংবদ্ধ বৈজ্ঞানিক কাঠামোক্রিয়াশীল। কাজেই, সংস্কৃত চর্চা করিলে যুক্তিবোধের চর্চাও হয়। যে ভাষার এত গুণ তাহাকে আমরা বাদ দিব কেন! পূর্বজদের পঠিত সংস্কৃত ব্যাকরণের বইগুলির ধুলা সরাইবার দরকার নাই, প্রয়োজনে নূতন বই নির্মাণ করিতে হইবে। ভাষা শিখিয়া বঙ্গজগণ সুসংস্কৃত হউন। |