বেহালার একটি স্কুলে বৃহস্পতিবার যাহা ঘটিয়াছে, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ক্ষেত্রে তাহা আদৌ কোনও অভাবনীয় ঘটনা নয়। রাজনৈতিক দলের কিংবা দলের অনুগামী ছাত্র-সংগঠনের মিছিলে ভিড় বাড়াইবার জন্য পড়ুয়াদের দলবদ্ধ ভাবে লইয়া যাওয়া এ রাজ্যের ছাত্র-রাজনীতির দস্তুরে পরিণত। বেহালার ঘটনাটি সংবাদের শিরোনামে আসিয়াছে কারণ, উদ্যোগটি কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি রকমের হইয়া পড়িয়াছিল এবং ছাত্রদের অভিভাবকরা এই অপকাণ্ডের প্রতিবাদে মুখর হইয়া স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে কৈফিয়ত দাবি করিয়া স্কুল-প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ দেখাইয়াছেন। প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য, স্কুলে প্রবেশের পূর্বেই ছাত্ররা ম্যাটাডরে উঠিয়া মিছিলে যোগ দিতে চলিয়া যায়। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ তথাপি দায় এড়াইতে পারে না। স্কুল-গেটের সামনে দাঁড় করানো ম্যাটাডরে ছাত্রদের তোলা হইতেছে, আর স্কুল কর্তৃপক্ষ তাহা নীরবে দেখিতেছে, ইহা কেমন অধ্যয়নকেন্দ্র? অভিভাবকরা তো আর মিছিলে যাওয়ার জন্য ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠান নাই! কর্তৃপক্ষের নিঃসন্দেহে আরও তৎপর হওয়া উচিত ছিল, ছাত্রদের ম্যাটাডরের বদলে ক্লাস-ঘরে ঢোকানো উচিত ছিল, প্রয়োজনে পুলিশে খবরও দেওয়া উচিত ছিল।
পুলিশে খবর দিলেই অবশ্য তৎক্ষণাৎ পুলিশ যে সক্রিয় হইবে, এমন আশা নাই। এ রাজ্যের পুলিশ দীর্ঘ কাল সক্রিয় হওয়ার আগে অভিযোগকারী ও অভিযুক্তের রাজনৈতিক পরিচয় জানিতে চায়, পাছে অতি-সক্রিয়তা দেখানোর অপরাধে পরে রাজনৈতিক শাসকদের কাছে ধমক খাইতে হয়। আর ছাত্র ইউনিয়নের বেলায় তো আইনরক্ষকরা আরও বেশি স্পর্শকাতর। বিদ্যাস্থানে পুলিশের প্রবেশ অবাঞ্ছিত বলিয়া গণ্য হইয়া থাকে। কিন্তু ছাত্র-রাজনীতির নায়করা কদাচিৎ স্কুল-কলেজকে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার কেন্দ্র বলিয়া গণ্য করেন। তাঁহাদের কাছে, তাঁহাদের ‘দাদাদের’ কাছেও, এগুলি হইল ভবিষ্যতের ক্যাডার তৈরির পাঠশালা। এখান হইতেই ছাত্রনেতারা আবির্ভূত হইবেন, যাঁহারা পরবর্তী কালে দলের ‘সম্পদ’ হইয়া উঠিবেন, প্রাদেশিক, এমনকী জাতীয় স্তরেও দলীয় নেতা হিসাবে নাম করিবেন। বাম-দক্ষিণ সব দলই এ জন্যই ছাত্র-রাজনীতিতে লিপ্ত হয়, দলের ছাত্র সংগঠন গড়িয়া তোলে। বৃহস্পতিবার যে সংগঠনের মিছিলে যোগ দিতে আলোচ্য স্কুলপড়ুয়াদের লইয়া যাওয়া হয়, সেটি রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের সহযোগী দল এস ইউ সি-র। ওই ছাত্র সংগঠনের নেতারা হয়তো মনে করেন, স্কুলপড়ুয়াদের ক্লাসে যাইতে না দিয়া মিছিলে টানিয়া তাঁহারা ঠিক কাজই করিয়াছেন। কিন্তু পড়ুয়ারা স্বেচ্ছায় এই সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দাদাদের ভয়ে যোগ দিতে বাধ্য হয়। তা ছাড়া, নাবালক পড়ুয়াদের ক্লাসের বদলে মিছিলে যাওয়াটা তাহাদের ইচ্ছানিরপেক্ষ, এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের আগাম অনুমতি আবশ্যিক পূর্বশর্ত। এবং অনুমতির প্রশ্নই ওঠে না, যেহেতু অভিভাবকরাই ছেলেমেয়েদের খোঁজে স্কুলে ঢুকিয়া কর্তৃপক্ষকে ঘেরাও করেন, স্কুল-প্রাঙ্গণে ভাঙচুর চালান, পথ অবরোধ করেন।
ইহার পর পুলিশের করণীয় সম্পর্কে কোনও দ্বিধা থাকা উচিত নয়। কিন্তু পুলিশ কর্তারা ‘নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে’ সক্রিয় হওয়ার কথা বলিতেছেন। প্রশ্ন উঠিবে, অভিভাবকদের অভিযোগ তো অনির্দিষ্ট নয়। তবে পুলিশ এখনও ছাত্র-সংগঠনের কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করে নাই কেন? আসলে এ রাজ্যের সমাজেই ছাত্র-রাজনীতিকে দূষণীয় কিছু গণ্য করা হয় না। তাই সেই রাজনীতির অঙ্গ হিসাবে মিছিল-সমাবেশের ভিড় বাড়াইতে নাবালক স্কুলপড়ুয়াদের জোর করিয়া স্কুল হইতে তুলিয়া লওয়াকেও তত গর্হিত অপরাধ মনে করা হইতেছে না। কিন্তু বিদ্যায়তনে রাজনীতির এই অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত এবং ইহা অচিরে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। ছাত্রছাত্রীরা তাঁহাদের অধিকার লইয়া, পঠনপাঠন, পরিকাঠামো, শিক্ষার মান ইত্যাদি লইয়া আন্দোলন করিতেই পারেন। সেটা তাঁহাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের অনুগামী হিসাবে দলীয় কর্মসূচি সফল করার সুযোগ বিদ্যায়তনে থাকা উচিত নয়। গভীরতর প্রশ্ন: রাজনৈতিক দলের ছাত্র-সংগঠনই বা থাকিবে কেন? ছাত্রছাত্রীরা দলীয় রাজনীতির বাহিরে থাকুন। অন্তত বিদ্যায়তনের পরিসরে। |