প্রথমে হুজি-র দাবি। এক দিনের মধ্যে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের (আইএম) পাল্টা দাবি। পর দিন আবার আইএম। আর এক দফা হুমকি।
দিল্লি হাইকোর্টে বিস্ফোরণের পর থেকে একের পর এক (মোট চারটি) ই-মেলের গোলকধাঁধায় এখন নাস্তানাবুদ গোয়েন্দারা। একই সঙ্গে বাড়ছে রহস্য এবং আতঙ্কও। কোনটাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে, কোনটাকে নয়, এই প্রশ্নে না গিয়ে এখন তাই সব দিকই খোলা রাখতে চাইছেন তাঁরা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমও সে কথাই বলেছেন। জানিয়েছেন, কাউকে বাদ দেওয়া হচ্ছে না। সব জঙ্গি সংগঠনই সন্দেহের তালিকায় রয়েছে।
এ দিন দু’টি ই-মেল এসেছে দিল্লি পুলিশের কাছে। যেগুলিতে সাংকেতিক ভাষায় হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে, এর পরের নিশানা আমদাবাদ। সেখানে খুব শীঘ্রই হামলা চালাবে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন। সংকেতটি সহজেই উদ্ধার করেছেন গোয়েন্দারা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে খতিয়ে দেখা হয়েছে, এ দিনের মেলগুলি বহু জায়গায় ‘বাউন্স’ করিয়ে পাঠানো হলেও তার উৎস মস্কো। কোনও কোনও সূত্রে বলা হচ্ছে, চতুর্থ মেলে আইএম দাবি করেছে যে, তৃতীয় মেলটিও তারাই পাঠিয়েছে। কিন্তু সরকারি সূত্রে এই ব্যাপারে খোলসা করে কিছু বলা হয়নি।
এখন গোয়েন্দাদের সামনে সব থেকে বড় সমস্যা, কোন মেলটিকে প্রামাণ্য ধরবেন, কোনটিকে নয়? মেলগুলির কোনওটাই যে অকাট্য, তা মনে করছেন না তাঁরা। কিন্তু ঘটনা হল, এমন একটি বিস্ফোরণ হয়ে যাওয়ার পরে সামান্যতম ঝুঁকি নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। তাই মেলগুলিকে উড়িয়ে দিতে পারছে না কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও। সেই মতো সতর্ক হওয়ার ও অন্যকে সতর্ক করার চেষ্টাও চলছে।
শুধু হুজি বা আইএম-ই নয়, আরও কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন রয়েছে সন্দেহের তালিকায়। বব্বর খালসা ইন্টারন্যাশনাল এবং এলটিটিই-কেও বাদ দেওয়া হচ্ছে না। বস্তুত, এই দুই সংগঠনের দিক থেকে হামলার ব্যাপারে রাজ্যগুলিকে সতর্কও করে দেওয়া হয়েছে। জুলাইয়ে যখন দিল্লি পুলিশকে সতর্ক করা হয়, তখন এই শিখ জঙ্গি সংগঠনের কথাই বলা হয়েছিল। কারণ সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল খলিস্তানি জঙ্গি দেবেন্দ্র পাল সিংহ ভুল্লারের প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন।
ই-মেল প্রসঙ্গে চিদম্বরম আজ বলেছেন, এ দিনের হুমকিটা নিতান্তই ‘অপেশাদার’। আলি সৈয়দ আল হুরি নামক এক ব্যক্তি ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনেরপক্ষ থেকে মেলটি করেছে। তাতে ইংরেজি বর্ণমালার ন’টি অক্ষরের ক্রমাঙ্ক সাজিয়ে বলা হয়েছে, এই জায়গাটিই এ বার নিশানা। সংখ্যাগুলি হল ১, ৮, ৫, ১৩, ৪, ১, ২, ১, ৪। ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমাঙ্ক অনুসারে অক্ষরগুলি হল এ, এইচ, ই, এম, ডি, এ, বি, এ, ডি। অর্থাৎ, আমদাবাদ। চিদম্বরমের কথায়, “যে সংকেতটি দেওয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত সরল এবং অপেশাদার ভঙ্গিতে তৈরি। কিন্তু আমরা বিষয়টি হাল্কা ভাবে নিচ্ছি না। যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই দেখছি। গুজরাত সরকারকে সতর্কও করা হয়েছে।” ‘কিলইন্ডিয়া অ্যাট ইয়াহু ডট কম’ থেকে পাঠানো এই মেলটিতে বলা হয়েছে, ‘দিল্লি হাইকোর্টে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন। ভারত সরকারকে আমরা এই বার্তা দিতে চাই যে, এর পরের হামলাটি এমন ভয়াবহ হবে যে, মানুষ অন্তত এক দশক তার স্মৃতি বহন করতে বাধ্য থাকবে।’
গত কাল ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সদস্য বলে নিজেকে দাবি করে জনৈক ছোটু মিঞা যে মেলটি পাঠিয়েছিল, তার উৎসস্থল নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়। প্রথমে তদন্তকারী অফিসাররা মনে করেছিলেন, কলকাতার শহরতলির কোনও এলাকা থেকে সেটি পাঠানো হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের একাংশে সেই খবর দেখে রাজ্য গোয়েন্দারা তৎপর হয়ে ওঠেন। তাঁরা নিজেরাই দিল্লির কাছে জানতে চান, বিষয়টি ঠিক কী?
পরে অবশ্য নর্থ ব্লক থেকে জানানো হয়, বিষয়টি নিয়ে তারা নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে পারছে না। তবে সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গ থেকে মেলটি আসেনি। প্রথম হুজির নামে যে মেলটি এসেছিল, তা জম্মুর একটি সাইবার কাফে থেকে পাঠানো হয়। সেই মেলটি যে পাঠিয়েছিল, তার সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জাতীয় তদন্ত সংস্থার একটি প্রতিনিধি দল জম্মুতে গিয়েছে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আজ একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছেন, নিরাপত্তা সুদৃঢ় করার প্রশ্নে কোনও রকম ফাঁক রাখছে না তাঁর মন্ত্রক। জাতীয় তদন্ত সংস্থা এবং দিল্লি পুলিশের মধ্যে প্রতি ঘণ্টায় যোগাযোগ থাকছে বলে তিনি জানান। চিদম্বরমের কথায়, “এমন একটি দিনও যায় না যে দিন আমরা নিরাপত্তা কাঠামোয় নতুন কিছু যোগ করি না।” একই সঙ্গে তিনি জানান, হাইকোর্ট বিস্ফোরণ নিয়ে আশাব্যাঞ্জক কিছু সূত্র মিলেছে (এ দিনই ফরেন্সিক তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট হাতে এসেছে। সেখানে নাইট্রেট যুক্ত বিস্ফোরক ছাড়াও বেশি কিছু অন্য বিস্ফোরক মিলেছে)। কিন্তু কোনও তথ্য-প্রমাণ হাতে না পাওয়া পর্যন্ত এই নিয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, বিশ্বের অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলির কাছ থেকেও সাহায্য চাওয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ক সচিব ইউ কে বনশল আজ সব রাজ্যের ডিজিকে চিঠি লিখেছেন। দিল্লি হাইকোর্টের সাম্প্রতিক নাশকতার বিষয়টি বিশদে জানানো হয়েছে সেই চিঠিতে। প্রধানমন্ত্রী নিজে আজ চিদম্বরম এবং কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীকে ডেকে বৈঠক করেন। তাঁর নির্দেশ, ভারতের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার ব্যাপারে আলোচনা করা হোক। আগামী ১৫ তারিখ থেকে রাজধানীতে শুরু হচ্ছে রাজ্য ডিজিদের সম্মেলন। সেখানেও এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। |