চেঙ্গিজ খান, সঙ্গে এক রাশ জুঁই ফুল
হামা-দেওয়া এক গুড়গুড়ি গোটা ঘর লন্ডভন্ড করে, যাবতীয় জিনিসপত্র ফেলে-ছড়িয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর তার বেবি কটের মধ্যে বসে শান্তিতে উল বুনছেন তার মা। কোনও এক বিদেশি পত্রিকায় এই কার্টুনটা দেখেছিলাম কখনও। বাস্তবের এত ভাল ছবি খুব কমই দেখা যায়। নার্সিং হোম থেকে শিশু বাড়ি এলেন মানে বাকিদের পার্মানেন্ট পরাধীনতা, বিনা পয়সার খিদমতগারিতে বারো-চোদ্দো বছর নিশ্চিন্ত। আস্ত একটা চেঙ্গিজ খানের সঙ্গে এক রাশ জুঁই ফুল যোগ করলে একটা শিশু হয়।
আজকাল বাচ্চাদের অন্নপ্রাশনে একটা বাঁধা গিফট হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা অ্যালবাম। ‘আজ আমি প্রথম ভাত খেলাম,’ ‘আজ আমি প্রথম হাঁটলাম’ এমন নানা লেখায়-ভরা পাতা। এক দিকে ছবি আটকানোর জায়গা, অন্য দিকে দিনক্ষণ লিখে রাখার জন্য লাইন টানা। কে না জানে, জীবনের আসল মনে রাখার মুহূর্তগুলো সবাই বেমালুম মিস করে যায়। শিশুর বাবা-মা যেমন লিখে রাখেন না, ‘আজ প্রথম তোমায় দেখে আমার বুক ধড়াস করে উঠল,’ কিংবা ‘আজ তোমার জন্য আমি প্রথম কাঁদলাম,’ তেমনই শিশুর ডায়রিতেও কেউ লেখে না, ‘আজ আমি বুঝলাম কান্নার ভল্যুম বাড়ালে বড়দের ছোটার স্পিড বাড়ে,’ কিংবা ‘আজ আমি দেখলাম মুখের ভাত পুচ করে বার করে দিলে মায়ের মুখ থেকে অদ্ভুত সব আওয়াজ বেরোয়।’ অথচ এই সব মুহূর্তগুলোয় যে জ্ঞানটি লাভ করে শিশুরা, তা হাঁটতে-বলতে শেখার লো-লেভেল স্কিল নয়, এগুলো হল রীতিমত হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট টেকনিক। অন্যকে দিয়ে কী করে নিজের কাজটি করিয়ে নেওয়া যায় কেবল একটু কান্না কিংবা একটা ফোকলা হাসির বিনিময়ে, ব্রেনের সব সাইন্যাপ্স তৈরি হওয়ার আগেই খুদেগুলো সেই সব সংযোগ তৈরি করে ফেলে। তার পর চলে তার যথেচ্ছ ব্যবহার।
কোথায় পড়েছিলাম, বাবা-মায়েরা আজব জীব। প্রথমে তারা প্রাণপণ চেষ্টা করে ছেলেমেয়েদের হাঁটতে শেখায়, কথা বলা শেখায়। তার পর তাদের বলে, ‘অ্যাই, চুপ করে বসে থাকো।’ বললে হবে কী, চুপ করে বসে-থাকা শিশু এমন অস্বাভাবিক, যে বাবা-মায়েরাই বেশি ক্ষণ তা সহ্য করতে পারে না। ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের মিনির বাবার জবানিটাই ভাবুন। মিনির মা ধমকিয়ে চুপ করালেও, বাবা পারতেন না কারণ মিনি চুপ করে থাকলে সে ভারী অদ্ভুত মনে হত। টালমাটাল পায়ে এ-ঘর ও-ঘর ছুটে বেড়াবে, কলকলিয়ে হাসবে, ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদবে, সব পাখির নামে ভাত মেখে তবে তাকে খাওয়ানো যাবে, তবে না শিশু। যামিনী রায়ের ছবিতে মায়ের কোলে যে গণেশ, কিংবা কাঁখে শিশু, সে সুন্দর, কিন্তু বড্ড নিশ্চল। বড় শান্ত, ছবি-ছবি। আবার মা-মেরির কোলে যে যিশুকে দেখা যায়, তাকে দেখেও সম্ভ্রম হয় বেশি, দেবশিশু সে, তার সবই শুদ্ধ, পবিত্র। তাকে ঘাড়ের উপর বসিয়ে একটু নেচে নেওয়া চলে না যেন, প্রণাম করতেই মন যায়। আমাদের পছন্দের শিশু আমাদের ঘরের ক্যালেন্ডারের পাতায়, দই-ঘোলের বড় বড় হাঁড়ির পিছন থেকে উঁকি দেয়। তার হাতে-মুখে লেগে রয়েছে চুরি-করে খাওয়া মাখন। তার হাতের ছুঁড়ে-দেওয়া লাঠি শিকেয়-ঝোলানো হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে। কোমরে-বাঁধা উদুখল আরও গোটা কতক হাঁড়ি ফাটিয়ে দিয়েছে। সারা ঘরে ননী-ঘোল-দুধ থই থই, মা যশোদা দরজা থেকে উঁকি দিচ্ছেন, নির্ঘাত রেগে কাঁই। কত দুপুরের হাত-টনটন-করা দুধ-মন্থনের কাজ কয়েক মিনিটের দৌরাত্ম্যে শেষ। অথচ এ শিশু যে জগদীশ্বর, সে কেবল অবতার হওয়ার কারণে নয়, তার কারণ সে আমাদের মনের সবটুকু একেবারে দখল করে নিয়েছে। যদি সে নিজের কচি হাঁ-মুখটিতে বিশ্বদর্শন না-ও করাত, তবু তার বশ্যতায় থাকত গোটা বিশ্ব। তার অবাধ্য হওয়ার সাধ্য কার? আমরা মনের মধ্যে আমাদের দুষ্টুমিগুলো নিয়ে ঘুরে বেড়াই বলেই দুষ্টু ছেলেমেয়েদের গল্প আমাদের এত ভাল লাগে। ‘রামের সুমতি’ কিংবা ‘ভোম্বল সর্দার’ বাংলার গ্রামের জীবনের ক্লাসিক দুষ্টুমিগুলোর অমনিবাস।
দস্যিপণা নইলে শৈশব কীসের, কৈশোরই বা কী? মেয়েরাও কম যায় না, ‘মাকু’ গল্পের সোনা-টিয়া কেমন বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গিয়েছিল জঙ্গলে! ভীষণ দুষ্টু না হলে কখনও দুই বোন সার্কাস পার্টিতে নাচ-গান দেখানোয় ভিড়ে যায়? ভাল ছেলেরা সব এক রকম, কিন্তু দুষ্টু ছেলেরা এক এক জন এক একটা ‘ক্যারেকটার।’ ভাবুন না, পাগলা দাশু, আর শ্রীকান্তের ইন্দ্রনাথ। আজকাল ডিটেকটিভ গল্পের এত রমরমা যে দুষ্টুদের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে স্মার্ট ছেলেমেয়েরা। এ দুটোর ক্যাটাগরি আলাদা। দুষ্টু প্রবলেম তৈরি করে, স্মার্ট প্রবলেম সল্ভ করে। প্রথমটা শিশুদের স্বাভাবিক কাজ, দ্বিতীয়টা মিনি অ্যাডাল্টদের। শৈশবেই টেনশন বাড়ছে, মজা কমছে।
হ্যারি পটারের বইগুলো যে এত হিট, তার কারণটা সবাই তার ম্যাজিক দুনিয়ার আশ্চর্য সব কারসাজি, এমনটাই ধরে নেয়। কিন্তু যা আসলে বইগুলোয় আমাদের ডুবিয়ে রাখে, তা হল হ্যারি আর তার বন্ধুদের হাজার রকম দুষ্টুমি। অদৃশ্য হওয়ার ক্লোক পরে নিজের অপছন্দের সহপাঠীর মাথায় চাঁটি মেরে আসা, চোরাই উড়ন্ত গাড়ি চড়ে স্কুলে পৌঁছনো কিংবা রাতের অন্ধকারে নিষিদ্ধ বনে ঘুরতে যাওয়া, এ সবের মধ্যে সাবেক দুষ্টুমির পুরো আনন্দটা রয়েছে। কৃষ্ণের বাঁশি হোক, বা হ্যারির জাদুদণ্ড, সে সব কেবল ‘থার্টি পার্সেন্ট এক্সট্রা ফ্রি’-এর মতো বাড়তি আকর্ষণ। ‘এই রে, এক্ষুণি কী করে বসবে’ - এমন আশঙ্কা-মেশানো আহ্লাদ মনের তারে ঝনঝন করে সবক’টা স্বর বাজিয়ে দেয় যাকে দেখলে, সে-ই আমাদের সোনার ছেলে, সোনার মেয়ে। তারা লুকিয়ে বলে ‘টুউকি’, আর আমরা খানিকটা খুঁজে বার করার খেলা খেলে যেই তাকে হুপুস করে কোলে তুলে নিয়ে হই হই করে হেসে উঠি, অমনি সার্থকতা আমাদের দু-হাতের মধ্যে ধরা দেয়।
এই জগত তৈরি করাটা ঈশ্বরের দুষ্টুমি ছাড়া কী?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.