ছেলেবেলায় আমরা সবাই কোনও না কোনও সময়ে তাল নিয়ে বিভূতিভূষণের গল্পটা পড়েছি। সবার মনেও আছে নিশ্চয়ই দুটো বাচ্চার নিমন্ত্রণের অপেক্ষায় বসে থাকার করুণ বিবরণ। জানি না কেন, সব সময় বাড়িতে তালের বড়া হলে ওই গল্পটা আমার মনে পড়ে যায়। শ্রাবণের শেষ ভাদ্রের গোড়ায় বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গে আর এক ধরনের করুণ-রসাত্মক কাহিনি সকলের মুখে মুখে ফেরে। সেটা ভোর রাতের ঝিরঝিরে বৃষ্টিভেজা অন্ধকারে তাল কুড়াতে গিয়ে সাপের কামড়ে এবং গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অ্যান্টিভেনম না থাকার কারণে পঞ্চত্ব-প্রাপ্তি বিষয়ক। মা মনসার বাহনটিকে লোকে অবশ্যি খুব একটা পাত্তা দেয় না দেখেছি।
তাল কুড়াতে গিয়ে অপঘাতে মৃত-ব্যক্তিদের অশরীরী ছায়াদেহের সঙ্গে মোলাকাত, দাঁতে দাঁত লেগে গ্যাঁজলা তুলে ভিরমি খাওয়া, কারা কোন সময়ে পরিচিত বিদেহীদের কেমন জামাকাপড় পরা অবস্থায় খোনা গলার কোন অক্টেভে ডাকতে শুনে কেমন ভাবে তিনটে ডিগবাজি খেয়ে এসে উঠোনে আছড়ে পড়েছিল, সে সব রংদার বৃত্তান্তই বরং আমজনতার মনে অনেক বেশি টাটকা অবস্থায় থেকে যায়। তারা সে সব ঘটনা নিয়ে আলাপ করে যে! মা-বাপের ছেলেবেলায় ঘটে যাওয়া কাহিনি-কিস্সা ছেলেমেয়েরা পরবর্তী প্রজন্মের কানে তুলে দেয়। ভূতগুলি পোশাক পাল্টালেও, তাদের নাম, পারিবারিক যোগাযোগের স্থায়ী ঠিকানা আর বিচরণক্ষেত্রগুলি কিন্তু অপরিবর্তিত অবস্থায় টিকে যায়। এক একটা তালগাছকে কেন্দ্র করে, বা তৎসংলগ্ন পুকুর, খেয়াঘাট, আলপথ, ধানখেত বা ছোট ছোট জনবসতি এবং সেখানে বসবাসকারী মানুষদের রোজকার বাঁচামরার লিখিত-অলিখিত ইতিহাসের বাইরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে সে ইতিহাসেরই অন্য এক ধরনের রেফারেন্স-এর অবাস্তব মুহূর্তগুলো।
হেঁসেলে তাল-ক্ষীর হচ্ছে, দাওয়ায় ঠাকুরদাদার কোলের কাছে জড়ো হওয়া দশ-বারোটি কুচোকাঁচা চোখ গোলগোল করে শুনছে বাপুলির মা এখনও জন্মাষ্টমীর আগের রাতে বড় পুকুরের ধারে হাতে কঞ্চি নিয়ে তাল গাছের ডগায় এক-পা আর মাটিতে এক-পা রেখে কেমন খলখল করে হেসে নিরীহ পথিকদের নাকি তাল কুড়োতে ডাকে। গ্রামবাসীদের নির্দেশ উপেক্ষা করে গেছ কি তোমার ঘাড় মটকে সুস্বাদু রক্ত চুষে খেয়ে সারা জীবনের মতো তালের বড়া গেলার নোলা ঘুচিয়ে দেবে। কোঁকাতে থাকে একদম গেঁড়ি বাচ্চাগুলো। মায়েরা এসে কোলে তুলে নিয়ে যায়। রাম নাম করে থুতু দেয় বুকে যাতে পোলাটা রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ককিয়ে না ওঠে, যাতে এই বাদলার দিনে ঘুমের ঘোরে বাপুলির মায়ের আহ্বান শুনে কাঁথা-কম্বল ভিজিয়ে না ফেলে। পায়ের তলায় বোতলের নীচে জমা সর্ষের তেল মাখায়। |
তার ফলে অনেক বাড়িতে তালের বড়ার বদলে তালের রস আটায় গুলে থকথকে জমাট বস্তুটাকে কলপাতায় মুড়িয়ে রান্নার পর নিভু নিভু ছাই মেশা আগুনে ফেলে ভাপিয়ে নেওয়ার চল আছে। এক রকমের পাতুরি আর কী। চিনিও দেন না গরিব লোকেরা বেশির ভাগ সময়। কেবল বাচ্চারা নয়, বড়রাও খুশি হয়ে যায়। খুশি না হওয়ার সামর্থ্য নেই যে!
তাল-ক্ষীর ইত্যাদি অনেক বেশি আধুনিক খাবার। আধুনিক না হলেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে শহুরে মধ্যবিত্তের, উচ্চবিত্তের হাতে পড়ে। দেশ-গাঁয়ে তালের মালপোয়া পয়সাওয়ালা লোকদের বাড়িতেই বেশি হতবাকিদের চিনির সিরা করার পয়সা কোথায় বাপ? অন্ততপক্ষে বাংলাদেশের যে জেলায় আমাদের বাস ছিলো, অর্থাৎ ঢাকা জেলায়, সেখানে গরিবগুর্বো তো বেশি। ওখানে তালের কোনও পদে নারকেল কোরা ইত্যাদি দেওয়ার চলও দেখিনি। ঢাকা শহরে নারকেল কোরা নিয়ে ফাটালে তো প্রতিবেশীদের হাতে মার খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। হালায় নারিকেল দ্যাখাও বলে চাড্ডি লোক বাড়িতে ঢুকে বাঁশ-পেটা করে গেল হয়তো।
হিন্দু বাড়ি, মুসলমান বাড়ির খাওয়াও কিন্তু আলাদা। চাঁদপুরে মাছ কিনতে গিয়ে ওই তালের পাতুরি দিয়ে পান্তা খেয়েছি মুসলমান মাঝিদের নৌকায় বসে। আদর করে খাইয়েছিলেন। ভাতে মেখে খেলে তালের রসের নিজস্ব মিষ্টত্ব বেশ টের পাওয়া যায়। তবে আমি ঠিক তার সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা কামড়ে খাওয়াটাকে সামলাতে পারিনি। মাঝিরা নিজেদের মধ্যে খুব হেসেছিল এই ভেবে যে, শহুরে বাবুটির ঝাল খাওয়ার অভ্যেস নেই। সেটা ঠিকই ভেবেছিল। আর তা ছাড়াও, আমরা তো যথেচ্ছ চিনি ঢালতে পারি রান্নায়। ওরা ঝাল স্বাদটাকেই অ্যাফর্ড করতে পারে দিন এনে দিন খেয়ে, তার সঙ্গে তালের রসটা মরসুমে একটু অন্য রকম স্বাদের সুযোগ করে দেয়।
তাল নিয়ে আমাদের মতো পরিবারের লোকেদের আহ্লাদ একটু বেশি। ক্ষীর করে নারকেল কোরা আর তালের রসে মিশিয়ে মেই দিয়ে লুচি খাওয়া ছাড়াও, তালের রসের পরোটা, তাল-ক্ষীরের পুর দেওয়া পিঠে, তালের পরোটার ভিতর ক্ষীর বা নারকেলের ছই ভরে পাটিসাপটা ইত্যাদি খাওয়ার চল দেশ ভাগের পর থেকে এ-বঙ্গে ধনী রিফিউজিদের মধ্যে ট্র্যাডিশন বজায় রাখার কর্তব্যপরায়ণ মনস্কতার কারণে বেড়েছে।
আমরা আসলে কী খেতাম সেটা দেখাতে গিয়ে আজগুবি রেসিপি তৈয়ার করে আমার ঠাকুমা যা রাঁধতেন না বলাটা আজকাল ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অতএব শুধু ইলিশে আটকে না থেকে তালের প্রিপারেশনেও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার চাপ দিনকে দিন বাড়ছে। ভয়ানক অবস্থা হয়েছে। |