পুস্তক পরিচয় ২...
‘সাম্যবাদের নামেই অনেকে শিউরে ওঠেন’
মার‌্ক্সবাদী বাঙালির কথাবার্তার কিছু নমুনা দেখার জন্য এই সংকলন। গোড়াতেই জানিয়েছেন সৌরীন ভট্টাচার্য। তাঁর সম্পাদিত মার্ক্সবাদী বাঙালি/ নির্বাচিত রচনা সংকলন ১-এর (তালপাতা, ১৫০.০০) ভূমিকা-য় সৌরীনবাবু আলোচনাও করেছেন ব্যাপারটা: ‘সব সামাজিক ক্রিয়াকর্মের পিছনেই হয়তো ভাবনা ও তত্ত্বচিন্তার ভূমিকা আছে। সে ভূমিকা সচেতন বা অসচেতন যাই হোক না কেন। মার্ক্সবাদী রাজনীতির ক্ষেত্রে তত্ত্বচিন্তার ভূমিকা বলে কয়েই বেশ প্রত্যক্ষ। বর্তমান সংকলনের উদ্দেশ্য এই ভূমিকার একটা নমুনা পেশ করা।’ নমুনা পেশ করার কারণও সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন সম্পাদক, যেমন: সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্ক্সবাদের সমাপ্তিও যেন ধরেই নেওয়া হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ব্যর্থতার সঙ্গে সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা, এমনকী মার্ক্সবাদের ব্যর্থতাকেও এক করে ফেলা হচ্ছে, বলা হচ্ছে সমাজতন্ত্র আর মার্ক্সবাদ মূলত এক, ইত্যাদি। এ প্রবণতার প্রেক্ষিতেই পড়ে ফেলতে হবে এ-সংকলনের প্রবন্ধাদি, প্রধানত পঞ্চাশের দশকে লেখা এই রচনাগুলির সময় সারা দুনিয়ার মার্ক্সবাদী শিবিরে রাজনৈতিক বিভাজন তত প্রকট হয়নি। স্বাধীনতার পরে পরে দেশকে নতুন ভাবে গড়ে তুলতে অনেকেই যখন ব্যস্ত, তাঁদের মধ্যে যে সব বাঙালি মার্ক্সবাদী হিসেবে পরিচিত, তাঁরা কী ভাবে বুঝে নিতে চাইছেন চারপাশের সময়টা, মার্ক্সবাদের নিরিখে, তার একটা আন্দাজ দেবে এ-বই। যেমন সমর সেন লিখছেন: ‘এখনো তো ইওরোপে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধতা বহু লিবেরল সাহিত্যিক বৈজ্ঞানিক ও ব্যক্তিবিশেষ জীবন বিপন্ন করে করছেন। কালক্রমে পুরনো আদর্শের রূপান্তর হয়েছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন এ সত্যেরই উপলব্ধি যাঁরা করেছেন তাঁদের সাম্যবাদে বিশ্বাস করা ছাড়া অন্য উপায় নেই।... অনেকেই লিবেরল বলেই সাম্যবাদী সঙ্ঘে যোগ দিয়েছেন। সাম্যবাদই লিবেরল আদর্শের উত্তরাধিকারী। নতুন তনুতে লিবেরল অতনুর পুনরুজ্জীবন হয়েছে।’ এ রকম প্রতিটি রচনাই তর্ক তোলার জন্যে যথেষ্ট, একই সঙ্গে নতুন ভাবনা উত্থাপনের জন্যেও সচেষ্ট।
এ দেশে বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ সোমনাথ লাহিড়ী শ্রমিকশ্রেণির প্রথম বাংলা মুখপত্র ‘অভিযান’ বের করতে শুরু করেন বিশ ও তিরিশের দশকের সন্ধিক্ষণে। তিনি-ই ছিলেন সাপ্তাহিক এ-পত্রিকাটির সম্পাদক। সেখানেই প্রথম ধারাবাহিক ভাবে ‘সাম্যবাদ’ লিখতে শুরু করেন তিনি। ব্রিটিশ সরকার জামানত দাবি করায় আর্থিক সঙ্গতির অভাবে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। শ্রীলাহিড়ীর লেখাটি তখন প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘সংবাদ’-এ ধারাবাহিক ভাবে বেরোতে থাকে ‘সমাজ-সাম্যবাদ’ নামে, তারপর সে-কাগজও বন্ধ হয়ে যায় এক সময়ে। ১৯৩১-এর জুলাইতে গোলাপ পাব্লিশিং হাউস-এর মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের হাতযশে লেখাটি শেষ পর্যন্ত বই হয়ে বেরোয়, তখনও শ্রীলাহিড়ী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হননি। সম্প্রতি সোমনাথ লাহিড়ী মেমোরিআল ফোরাম্ থেকে সেই বইটি, সাম্যবাদ, পুনর্মুদ্রিত (৫০.০০) হল। মুখ্যত এ-দেশের শ্রমিকশ্রেণির কাছে পৌঁছে দেওয়ার রাজনৈতিক প্রেরণাতেই লিখেছিলেন শ্রীলাহিড়ী, এ ছাড়াও যে কারণটা ছিল তা তিনি জানিয়েছিলেন এ-বইয়ের গোড়ার কথা-য়: ‘সাম্যবাদের নামেই আমাদের দেশের অনেকে শিউরে ওঠেন। অনেকেরই আবার সাম্যবাদ সম্বন্ধে একদম ভুল এবং আজগুবি ধারণা আছে।... এর দুটো কারণ আছে প্রথম কারণ অজ্ঞতা, আর দ্বিতীয় এবং প্রধান কারণ অপর পক্ষের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা বা প্রচার কার্য্য।’
অনুরাধা রায় তাঁর মার্কসবাদ ও তার্কিক বাঙালি (সূত্রধর, ১৪০.০০) বইয়ে দীর্ঘ যে ‘প্রাক্-কথন’টি লিখেছেন তাতেই মার্ক্সবাদের তত্ত্ব নিয়ে তর্কের বাতাবরণ তৈরি করেছেন যথেষ্ট। সারা পৃথিবীতেই মার্ক্সবাদের চূড়ান্ত পরাভবের পাশাপাশি বাজার-অর্থনীতির অবাধ জয়যাত্রা ও তার সহযোগী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সুস্থ স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হলেও অনুরাধা লিখছেন ‘তবুও কিন্তু বৌদ্ধিক স্তরে মার্কসবাদের পুনরুত্থানের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।... পাশ্চাত্যের বেশ কিছু মানুষ এই উত্তর-মার্কসবাদ, এমনকি উত্তর-আদর্শ যুগে মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাচ্ছেন।... এঁরা বলছেন চারিদিকে পৃথিবীটাকে বুঝতে হলে, কিছু নৈতিক মূল্যবোধ যদি এখনও কেউ লালন করে সেগুলি রূপায়িত করতে হলে আজও মার্কসকে দরকার, যতই তাঁর আদর্শ ও প্রয়োগের মধ্যে এতদিন ধরে বিরাট ফারাক তৈরি হয়ে থাকুক।’ এ হেন সেই মার্ক্সবাদকে নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে প্রাক্-স্তালিন এবং স্তালিন-অনুশাসিত পর্যায়ে কী ভাবে দীর্ঘ কাল ধরে তর্ক চলেছে বা চলছে, তারই এক চমৎকার তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক খতিয়ান উঠে এসেছে অনুরাধার কলমে।
Alochona


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.