|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
দেশভাগের শোকেই কি বিদ্বেষ এত তীব্র |
সেমন্তী ঘোষ |
দ্য মোমেন্টস অব বেঙ্গল পার্টিশন/ সিলেকশনস ফ্রম দি অমৃত
বাজার পত্রিকা/ ১৯৪৭-১৯৪৮, সংকলক অরুণ ঘোষ। সেরিবান, ৮৯৫.০০
|
দেশের ইতিহাসে কিছু কিছু সংকট-মুহূর্ত আসে যখন নিরপেক্ষতা কিংবা সুচিন্তিত বিবেচনা জিনিসটা নেহাতই দুর্বলতা বলে গণ্য হয়। হয় এ দিক নয় ও দিক বেছে নেওয়াটাই একমাত্র কর্তব্যকর্ম হয়ে বসে। ভারতের ইতিহাস, তথা বাংলার ইতিহাসে ১৯৪৭-৪৮ সাল তেমনই একটা সময়। যে সময়ে ধৈর্যের কণ্ঠস্বর, অপেক্ষার কণ্ঠস্বর, বিবেচনার কণ্ঠস্বর হেরে গিয়েছিল অধৈর্য, অসংযমের দাপটের কাছে। যে সময়ে অনেক দিনের দ্বিধা দ্বন্দ্ব সরিয়ে রেখে অধিকাংশ মানুষই বেছে নিচ্ছিলেন কোনও-না-কোনও একটা যুযুধান পক্ষ। যে সময়ে পাকিস্তান আন্দোলনের তীব্র হুঙ্কার নীরব করে দিচ্ছিল প্রায় সব ভারতীয় মুসলমানকে, এমনকী যে মুসলমানরা নিজেদের ভারতীয় পরিচয়ে এত কাল আদ্যন্ত বিশ্বাস রাখতেন, তাঁরাও চুপ করে যাচ্ছিলেন উপায়ান্তর না দেখে। যে সময়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবল প্রতিক্রিয়ার শব্দসাগরে ডুবে যাচ্ছিল সংহতি, সম্মিলন ও সহাবস্থানের বিকল্প মতগুলি, এমনকী যাঁরা ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগকে এত দিন নিছক উন্মাদের কার্যক্রম মনে করতেন, তাঁরাও তখন মুখে কুলুপ আঁটছিলেন, অখণ্ডতার পক্ষে যা যেটুকু যুক্তি সব উড়ে যাচ্ছিল ভয় আর রাগের তুফান-বেগে। এর আগে ১৯২০, ১৯৩০-এর দশক, এমনকী ১৯৪০-এর দশকের প্রথমার্ধও দেখেছিল কী ভাবে ধর্মপরিচয়, সংস্কৃতি-পরিচয়ের বিভেদ সত্ত্বেও একটা আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ গুরুত্ব পেতে পারে বাঙালি হিন্দু বা বাঙালি মুসলমান মানসভুবনে। অথচ ১৯৪৭-৪৮ সালে এসে দেখা গেল মুসলমানদের মুখে মুখে ‘পাকিস্তান’-এর ডাক, অধিকাংশের কাছে যে পাকিস্তান-এর অর্থ একটা আলাদা দেশভূমি, আর, যে মুসলমানরা পাকিস্তান চাইছেন না, কিংবা আলাদা দেশ নামক পাকিস্তান চাইছেন না, তাঁরা সহসা নীরব। দেখা গেল, হিন্দুরাও তত দিনে দেশভাগই চাইছেন, আর যে হিন্দুরা অখণ্ডতার পক্ষে, তাঁরা হয় নীরব, নয়তো বড় নিঃসঙ্গ, একক। |
|
হিন্দু মহাসভার অধিবেশনে ভাষণ দিচ্ছেন বীর সাভারকর। দেশবন্ধু পার্ক, কলকাতা, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৪৯ |
মার্কিন সাংবাদিক ফিলিপ ট্যালবট সেই সময়ে ভারতীয় নেতাদের কাছের লোক। তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ফুটে উঠছিল রোজনামচায় ও রিপোর্টে, যা পরে অ্যান অ্যামেরিকান উইটনেস টু ইন্ডিয়া’জ পার্টিশন নামে প্রকাশিত হয়। ১২ ডিসেম্বর ১৯৪৭-এ তিনি লিখেছিলেন: পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় সে দিন হিন্দু সমাজের যে উগ্র প্রকাশ ঘটছিল, তাঁর মনে হয়, প্রাচীন কালের হিন্দু-বৌদ্ধ সংঘর্ষের পর হিন্দু সমাজে এমনটা আর দেখা যায়নি! “A political generation dominated by the Pakistan issue has stimulated what I suppose may be the most vigorous wave of sheer Hinduism since Buddhism was ejected from India.”
এই হিন্দু প্রতিক্রিয়ার প্রমাণ থেকেই অবশ্য ঐতিহাসিক জয়া চট্টোপাধ্যায় সিদ্ধান্ত করেন যে, মুসলমান নয়, হিন্দুরাই আসলে দেশভাগের জন্য দায়ী। তবে তাঁর এই বক্তব্য নিতান্তই অতিশয়তার দোষে দুষ্ট। এক, পাকিস্তান দাবির ‘প্রতিক্রিয়া’য় কী ভাবে এই চরম পরিস্থিতির উদ্ভব হল, সেটা এই তত্ত্বে ঠিক ভাবে ধরা পড়ে না। দুই, সাম্রাজ্যের অন্তিম লগ্নে দর-কষাকষির সময়ে সর্বভারতীয় নেতৃত্বের চাপের মুখে বাংলা প্রদেশে কংগ্রেস নেতৃত্ব সে দিন কতটা অসহায় ভাবে লড়াই করছিলেন, সেটাও তাঁর বিশ্লেষণে ফুটে ওঠে না। জয়া চট্টোপাধ্যায়ের অতিশয়তার মধ্যে না গিয়ে বরং আমরা ফিরে আসি ট্যালবটের বক্তব্যে। হিন্দুদের ‘জন্যই’ দেশভাগ হয়নি, কিন্তু হিন্দুরাও সে দিন দেশভাগ চেয়েছিল। ট্যালবটের আঁকা তীব্র হিন্দু প্রতিক্রিয়ার ছবিটা তাই একটুও ভুল নয়। শেষের সেই দিনগুলি সত্যিই ভয়ংকর। সরব বক্তব্যের চরমতায়। নীরব প্রতিবাদের ব্যর্থতায়।
অমৃতবাজার পত্রিকা নামক যে জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রটি বিশ শতকের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটা বিশেষ স্থানের অধিকারী, সাম্রাজ্যের শেষ দিনগুলিতে সেটিও তাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তৎকালীন পাবলিক ডিসকোর্সে-র এই প্রবল বাঁক, হঠাৎই চরম হয়ে-যাওয়া বাঙালি হিন্দু কণ্ঠস্বরের তীক্ষ্নতা। আলোচ্য বইটি সেই কারণেই অত্যন্ত দরকারি, ১৯৪৭-৪৮ সালের অমৃতবাজার পত্রিকার নানা নির্বাচিত অংশ এক জায়গায় এনে তা বুঝিয়ে দেয় কতটা পাল্টে গিয়েছিল সে দিনের বাঙালি হিন্দুর আলোচনা-পরিসর: ১৯৪৭-এর অগস্টের আগে ‘দেশভাগ চাই’ স্লোগানে, আর অগস্টের পর দুই দেশের হিন্দুদের ‘নিরাপত্তা চাই’ স্লোগানে।
বইটির শুরুতেই রয়েছে দেশভাগের ঠিক আগে, ১৯৪৭-এর এপ্রিলে অমৃতবাজার পত্রিকার বিখ্যাত সমীক্ষাটির বিবরণ, যাতে ৯৮ শতাংশেরও বেশি পাঠক দেশভাগ দাবি করেন। এবং পত্রিকার উত্তর-সম্পাদকীয় স্তম্ভ বলে: If the Government of Pakistan is to rule over predominantly Muslim area, then the Government of Hindustan.. must rule over the predominantly non-Muslim areas.. There can be no equitable escape from this logical and reasonable conclusion. .. Let logic take its course and let reason and equity have their way. দাঙ্গা ও দেশভাগের কারণে কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্র হিন্দু বসতি বিপর্যস্ত হওয়ায় দুশ্চিন্তা, পশ্চিমবাংলায় উদ্বাস্তু বিপন্নতা ও ত্রাণের অব্যবস্থা নিয়ে ক্রোধ, পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু সম্পত্তি বেদখল হয়ে যাওয়ায় উৎকণ্ঠা, বাংলা ভাষার দুর্গতিতে ক্ষোভ, সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি নতুন পাকিস্তান সরকারের অবজ্ঞা ও অসংবেদনশীলতার প্রতিবাদ: পত্রিকার পাতা ‘হিন্দু সংকটে’র উচ্চারণে ভরে ওঠে দু’টি বছর জুড়ে। স্পষ্ট শোনা যায় ‘জাতীয়তাবাদের’ তকমার আড়ালে হিন্দুত্ববাদের ঘোষণা। প্রায় এক হয়ে যায় পত্রিকার নিজস্ব অবস্থান এবং পত্রিকার লেখক-গোত্রের অবস্থান। ১৯৪৮-এর জানুয়ারিতে হুগলি কনফারেন্স-এ এন সি চট্টোপাধ্যায়ের বক্তৃতার রিপোর্ট-এ আমরা পড়ি নতুন প্রাদেশিক সরকারের প্রতি তীব্র ভৎসর্র্না: We as the sponsors of the Partition movement regret to say that our ideals have not yet been realised. Although there is a Government composed of Hindus in this new Province of West Bengal, the members of the Government feel diffident to call themselves Hindus and some of them take delight in preaching the old policy of continued appeasement. পত্রিকার সম্পাদকীয় বক্তব্যও খুব আলাদা ছিল না। ৩ ফেব্রুয়ারি-র সম্পাদকীয় বলে: We have published in these columns from time to time many other instances of oppression and terrorisation of the Hindus. দেশভাগের শোকই কি তীব্রতর করে দেয় বিদ্বেষের উচ্চারণকে?
সংকলক অরুণ ঘোষ দুই মলাটের মধ্যে সংকটদীর্ণ ইতিহাসের এই যে বিপুল তথ্য ধরে দিয়েছেন, সেটা ঠিক ইতিহাস নয়, ইতিহাসের সূত্রাবলি। আর সেই জন্যই গবেষকের কাছে তা খুব জরুরি। কিন্তু না, কেবল গবেষক নয়, সাধারণ পাঠকের কাছেও বইটির মূল্য অনেক। ইতিহাস নয় বলেই, ঐতিহাসিকের ব্যাখ্যান-মাধ্যমের বাইরে গিয়ে একটা সময়কে ঠিক তার নিজস্ব সুরে যদি বুঝে নিতে চান কোনও পাঠক, তাঁর কাজে লাগবে এই বই। সংকলক বইটিকে সাজিয়েছেন কালানুক্রমিক ভাবে, ১৯৪৭-এর এপ্রিল থেকে ১৯৪৮-এর নভেম্বর অবধি মাস-ভিত্তিক বিন্যাসে। কেমন হত যদি তার বদলে বইটি বিষয়ভিত্তিক ভাবে সাজানো হত? তাতে একটি বিশেষ মাসের সংবাদপত্র-সুলভ বিষয়-বৈচিত্র্য হয়তো একটু পিছনে সরে যেত। কিন্তু এক-একটি সমস্যার আকার-প্রকার ও বিতর্কের ধারাটা আরও বিন্যস্ত আকারে ফুটে উঠতে পারত। মুদ্রণপ্রমাদ রয়ে গিয়েছে কিছু, ছোটখাট, যেমন, সূচিপত্রের একেবারে প্রথমাংশে। সব মিলিয়ে দুর্ভাগ্যময় সময়ের দুর্ভাগ্যজনক মানসিকতার যে খণ্ডচিত্র এই বই নিয়ে আসে, তা একটিই প্রত্যাশা জাগিয়ে তোলে। এমনই পরিশ্রমপ্রসূত আরও কিছু খণ্ডচিত্র সংকলন পাওয়ার প্রত্যাশা, যে কোনও পাঠকের কাছে যা সেই সংকটময় সময়ের প্রত্যক্ষ অনুভব জাগিয়ে তুলতে পারে। |
|
|
|
|
|