প্রবন্ধ ২...
‘ফেল’ নয়, ‘পাশ’ চাই
ভূগোলের বইটা বোধহয় নতুন করে লেখা দরকার। সম্প্রতি দুটো নতুন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যাচ্ছে। বৈশ্বিক যুক্তিশীল গতি ও পশ্চিমবঙ্গীয় নাছোড় প্রাচীনপন্থার অনুসরণ। শিক্ষাবিশ্বের গতিপথ যেখানে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তির দ্বারা নির্দেশিত, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের প্রার্থনা এক অচলায়তন। বস্তুত পদার্থবিদ্যাতেও একটা নতুন সংযোজন হতে পারে: গতি = স্থিতি।
একটা উদাহরণই যথেষ্ট। প্রাথমিক শিক্ষায় যখন পাশ-ফেল প্রথা তুলে দেওয়া হল, তখন যে সন্ত্রস্ত চিৎকার শোনা গিয়েছিল, সেটাই আবার শুরু হয়েছে বুনিয়াদি স্তরে (অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত) পাশ-ফেল তুলে দেওয়ার আইনি ঘোষণায় (শিক্ষার অধিকার আইন মোতাবেক)। শিক্ষিত বিশ্বে বহুকাল আগে বর্জিত একটি ধারণাকে এ দেশে বন্ধ করার জন্য যে আইন করতে হল, এর ভিতর দিয়েই আমাদের শিক্ষাচিন্তা সংক্রান্ত পশ্চাৎপরতাটা যথেষ্ট প্রমাণিত হল না বলেই বোধহয় শিক্ষিত মহলেও অনেকে এই বন্দোবস্ত নিয়ে শক্তিক্ষয় করছেন। শিক্ষা শুধু তর্ক করতেই শেখায় না, তর্কের বিষয় বাছার ব্যাপারেও শিক্ষার ভূমিকা প্রধান।
আলোর দিকে। শিশু-পড়ুয়া। ছবি: দেবাশিস রায়।
শিক্ষা প্রসারে এগিয়ে থাকা সব দেশই এই যুক্তিশীলতায় পাশ-ফেলকে বহু যুগ আগেই বর্জন করেছে। যুক্তিটা হল, সাধারণ ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করা হয় শিক্ষা অর্জন করার জন্য, ফেল করার জন্য নয়। ফেল করার জন্য স্কুলের কোনও দরকার নেই। এর মানে এই নয় যে, তাদের যা শেখার কথা, প্রভূত গবেষণা ও ব্যাপক আলোচনার মধ্য দিয়ে তাদের যে শিক্ষণীয় সূচি তৈরি করা হয়েছে, সেটা তারা শিখছে কি না, দেখার দরকার নেই। বরং উল্টোটা, তাদের শেখাটা নিশ্চিত করার জন্য তাদের অর্জনের মূল্যায়নটাকে দৈনন্দিন কাজকর্মের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত করা হয়েছে। এটা পঠনপাঠনেরই একটা অংশ যেখানে শিক্ষার্থী কী শিখল, তার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক তাঁর কাজটাতে কত সফল হলেন এ দুটো ব্যাপারই মূল্যায়িত হয়, যাতে যদি কোনও ফাঁক থেকে যায়, তা হলে তখনই তা পূরণ করে নেওয়া যায়।
এই ব্যাপারটাই কন্টিনিউয়াস অ্যান্ড কম্প্রিহেন্সিভ ইভ্যালুয়েশন (প্রবহমাণ সর্বাঙ্গীণ মূল্যায়ন সি সি ই) নামে আমাদের এখানে চালু করা হচ্ছে (দেশের অনেক জায়গায় সফল ভাবে চালু হয়েও গেছে)। প্রাথমিকে এটা আগেই চালু হয়েছে এবং তাতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি, বরং শ্লথগতিতে হলেও চিরাচরিত অক্ষর-বঞ্চিতদের শিক্ষাক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বাড়ছে বলে দেখা যাচ্ছে।
প্রশ্ন হল, প্রাগ্রসর দুনিয়ায় স্কুল ব্যবস্থা যতটা সজ্জিত (দরকার মতো স্কুল, শিক্ষক, অন্যান্য ব্যবস্থা) এখানে তার অংশমাত্রও নেই। এক জন শিক্ষকের কাঁধে কখনও বা ১০০-২০০ শিশুর দায়িত্ব সমস্যার একটা নমুনা মাত্র। সঙ্গে আছে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ্যসূচি, মানসিকতা ইত্যাদি নানান ব্যাপার। এখানে কি ‘ওই সব বড় বড় আদর্শের কথা চলে?’
প্রথম কথা, আদর্শের বড়-ছোটর প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন হল, আদর্শের পিছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে কি নেই? যখন সেই যুক্তি আছে, তখন আমাদের করণীয় কী হবে? আমরা কি যত দিন না ব্যবস্থাটি সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে উঠছে তত দিন অপেক্ষা করব? যার প্রকৃত অর্থ, কোনওটাই না হওয়া? না, উল্টোটা যুক্তির পথে নির্দিষ্ট একটা নীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে যে বাধাগুলি আছে সেগুলিকে দূর করার জন্য লড়াই করব? দ্বিতীয়টা না করে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রতিষ্ঠিত নীতিটিরই বিরোধিতা করা মানে তো আদর্শটিকে চির দিনই নাগালের বাইরে রেখে দেওয়া তাকে জীবনচর্যার অংশ না করা।
শিশুদের যে বিদ্যালয়ে শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়, তার কারণটা তো এই যে, সে নিজে নিজে শিখতে পারে না তার সাহায্যের দরকার হয়। এখন স্কুলে এসে তাকে যদি বলা হয়, ‘তুমি ফেল, পরের বছর আবার চেষ্টা করো’ সেই ফেলটা কে হল? সেই শিশু, না কি আমাদের ব্যবস্থা ও নৈতিকতা? বিশ্বজোড়া গবেষণার বিপুল সম্ভার থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, শিশুদের ফেল করার চেয়ে পাশ করার ক্ষমতা অনেক বেশি। এমনকী যাদের ‘প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া’, এই গালভরা নাম দিয়ে বাইরে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় এবং পাশ-ফেলটা অন্তর্নিহিত ভাবে তাদের কথা ভেবেই রাখা হয়, তাদেরও পাশ করার ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। ফেলটা আসলে জোর করে করানো, অর্থাৎ স্কুলে তাকে যতটুকু দেওয়ার কথা, ততটা না দিয়ে। সুতরাং যেটা দেখার সেটা হল, স্কুলে যেন শিশুর শিক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলি থাকে।
একটা সভ্য দেশে এই ব্যবস্থাগুলি সাধারণ প্রক্রিয়াতেই হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এটার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হল শিক্ষার অধিকার আইন প্রণয়ন হওয়া পর্যন্ত (ইম্পিরিয়াল কাউন্সিল-এ গোপালকৃষ্ণ গোখলের সর্বজনীন শিক্ষার দাবি তোলার পুরো এক শতাব্দী বাদে)। আইন শুধু যে পাশ-ফেল তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে তা কিন্তু নয়। একই সঙ্গে একটা সুস্থ বিদ্যালয় ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলিকেও সুনিশ্চিত করার কথা চলছে। এমন নয় যে, আইন সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত, এতে সংশোধনের দরকার নেই। কিন্তু বড় কথা যেটা সেটা হল, এখানে একটা ভাল সুযোগ আছে যা কাজে লাগিয়ে বিদ্যালয় ব্যবস্থার অনেকটা সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। যুক্তিশীলতার দাবি তো এই সুযোগকে কাজে লাগানোর। সে বলবে, রাজ্যে শিক্ষার অধিকার আইনের নিয়মাবলি অবিলম্বে চালু করা হোক, (দেশের ১৮টি রাজ্য যা ইতিমধ্যে করে ফেলেছে,) বলবে আইন মোতাবেক স্কুল, শিক্ষক, পাঠ্যক্রম সংস্কার ইত্যাদি ব্যবস্থাগুলি এখনই করা হোক এবং প্রবহমাণ, সর্বাঙ্গীণ মূল্যায়ন যথাযথ ভাবে চালু করা হোক। নৈতিকতা ব্যাপারটিকে সেকেলে মনে করা একটা ফ্যাশন হয়েছে এটা জেনেও অন্তত শিশুদের কথা মাথায় রেখে এই গণ নৈতিকতার দাবি তো তুলতেই হবে। শিশুদের উপর বড়দের অন্যায় বন্ধ হোক। পাশ করাটাই তাদের কাছে স্বাভাবিক। হ্যাঁ, প্রতিটি শিশুকে প্রকৃত অর্থেই পাশ করতে দেওয়া হোক। অভিজ্ঞতা বলে, ‘প্রকৃত অর্থে পাশ’ অর্থাৎ গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার সমস্যাগুলিকে গণদাবি আকারে তুলে আনতে পারলে তাদের অনেক সমাধান পাওয়া যায় (বিশ্বে তো বটেই, ভারতে কেরল-সহ বেশ কিছু রাজ্যে এর নজির আছে)।
মুশকিলটা হচ্ছে গণদাবির প্রকৃতি নিয়ে। আমাদের সামনে সব সময়ই চমকদার, সহজে দৃষ্টি আকর্ষণী কিছু প্রলোভন থাকে, পাশ-ফেল তার মধ্যে একটা। কেননা, প্রজন্মের পর প্রজন্ম শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত অভিভাবকদের একটা অংশের সমর্থন সহজেই চিরাচরিত পরীক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে জোটানো যায়। অভিভাবকদের শিক্ষার যে পশ্চাৎপট তার মধ্যে যে বিরাট বিভাজন আছে। সেখানে মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীও সহজেই বঞ্চিতদের প্রভাবিত করতে পারেন কেননা, শিক্ষাকে তার সামগ্রিক রূপে দেখে তার বিচার করার সক্ষমতা গড়ে তোলার কোনও সুযোগই তো তাঁরা পাননি!
এমন ক্ষেত্রে যুক্তি কোন পথে হাঁটবে? অভিভাবকের ভোট, যে ভোট অনুপলব্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? না কি যুক্তি, বিজ্ঞান ও নৈতিকতা, যার উপর আধারিত রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধীর শিক্ষাচিন্তা? যে চিন্তায় মুষ্টিমেয় এলিট নয়, সকল মানুষই শিক্ষার সমান অধিকার পায়। আর যদি অভিভাবকদের ভোটকেই নির্ণায়ক মানতে হয়, তা হলে সেই ভোটে সারা পৃথিবীর মতটাকেও শামিল করতে হয়। শিক্ষানীতি কোনও স্বশাসিত অঞ্চল পরিচালনার ব্যাপার নয় এর যোগটা বিশ্বজোড়া আধুনিকতা ও বিজ্ঞানের প্রাধান্যের সঙ্গেই। পশ্চিমবঙ্গ এক যুক্তিশীল বিশ্বযোগাযোগের দিকে যাবে, না নতুন ভূগোল বা পদার্থবিদ্যা রচনা করবে সে সিদ্ধান্তটা আর মুলতুবি রাখা চলে না।
Previous Item Editorial Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.