|
|
|
|
প্রবন্ধ ১: যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি |
 |
নবান্ন উৎসবের কথা, বহু দিন পরে
‘বহু বছর তো হয়ে গেল, তবু হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায়। যখন মনে পড়ে, তখন স্মৃতি
একেবারে জ্বলজ্বল করে। সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাই!’ দূরভাষে স্মৃতির সফর।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
|
দাদা, আপনার কি মনে আছে, পোলটা পেরিয়ে একটুখানি গেলেই একটা বাজার ছিল। আমরা বলতাম, বাবুর বাজার।
হ্যাঁ, মনে আছে। খালের ওপর (আমরা মনে করতাম নদী) কাঠের ব্রিজ, তার ডান দিক বা বাঁ দিকে বাজার।
আপনি সেখানে কখনও বাজার করেছেন?
না রে, আমি তখন বেশ ছোট, বড়জোর ছ’সাত বছর বয়েস, তবে বাবার সঙ্গে গেছি কয়েক বার।
সেখানকার কোনও স্মৃতি আছে?
খুব সামান্য। এক দিন বাবা একটা লেপ কিনলেন, (ওখানে বলত ল্যাপ) তাঁর মায়ের জন্য। কাঁথা গায়ে তাঁর শীত করত। টুকটুকে লাল রঙের লেপ, সেটার কথা মনে থাকার কারণ, আমার ঠাকুমার পাশে শুয়ে আমিও সেই লেপ গায়ে দিয়েছি কিছু দিন।
আর কিছু?
এক দিন মাছের বাজারে ইলিশ মাছ কেনা। তোমরা শুনলে অবাক হবে, সেই বাজারে কোনও মাছই ওজনদরে বিক্রি হত না। ছোট মাছ, যেমন পুঁটি, খলসে, বেলে, ট্যাংরা এই সব বিক্রি হত ভাগা দিয়ে। দু’পয়সা চার পয়সা ভাগা; কই মাছ এক সঙ্গে চারটেকে বলা হত হালি, অথবা কুড়িটা এক সঙ্গে। মজার ব্যাপার, এটা আমি পরে শুনেছি, কোনও কোনও জেলায় মুখে বলা হত এক কুড়ি কিন্তু দিত বত্রিশটা। আর বড় মাছ, যেমন রুই বা ইলিশের দাম ঠিক করা হত তার আকৃতি দেখে। বাবা এক জোড়া ইলিশ কিনেছিলেন। কত দাম দিয়েছিলেন জানি না, যত দূর মনে হয়, দু’আনা বা তিন আনার বেশি নয়। তখন ষোলো আনায় এক টাকা।
আমরা অত শস্তা মাছ দেখি নাই, তবে এক টাকায় অনেক কিছু কেনা যেত।
ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, সেই বাজারেরই পিছন দিকে একটা পাঠশালা ছিল না? |
 |
স্মৃতি। বঙ্গভূমি। শিল্পী: প্রকাশ কর্মকার |
আমরা পাঠশালা দেখি নাই, তবে একটা প্রাথমিক স্কুল আছিল। পরে সেইটা বড় স্কুলের সঙ্গে মিলে যায়।
এখন বোধহয় কোনও গ্রামেই পাঠশালা নেই, প্রাইমারি স্কুল দিয়ে শুরু। আমি কিন্তু পাঠশালায় পড়েছি। খড়ের চালের ঘর, মেঝেতে চট পেতে বসা, সঙ্গে শুধু স্লেট-পেন্সিল। নামতা পড়া হত চেঁচিয়ে। সেই নামতা এখনও আমার মনে আছে। তাই সাত চোদ্দং আটানব্বই চট করে বলে দিতে পারি। আমি কলকাতার পাঠশালাতেও পড়েছি, দর্জিপাড়ায় ‘যদু পণ্ডিতের পাঠশালা’, সেটা বেশ বড় পাকা বাড়িতে। এখন নাম বদলে ফেলেছে কি না জানি না।
দাদা, ‘কালা রায়ের বাগ’ কিংবা রায় বাগানের কথা আপনার মনে পড়ে?
নাঃ!
ওটা ছিল এক বিশাল জঙ্গল, গভীর, দিনের বেলাতেও পাশ দিয়ে যেতে আমাদের গা ছমছম করত ছোটবেলায়। (আপনার ছোটবেলার অনেক পরে)। মাঝে মাঝে সেখানে নাকি বাঘও (ওখানে বলত বড় শিয়াল) এসে পড়ত। চোর-ডাকাতের ভয়ও ছিল।
না ভাই, সেই জঙ্গলের কথা আমার মনে নেই। তবে, সুন্দরবন থেকে বেশ দূরে হলেও মাঝে মাঝে ওই দিককার গ্রামে দু’একটা বাঘ ছিটকে চলে আসত, গল্প শুনেছি। আর এক রকম প্রাণী ছিল বাঘডাসা, আর গুলবাঘার কথাও শুনেছি, সেটা নাকি পুরোপুরি বাঘ নয়। আর শিয়াল আর সাপ ছিল অজস্র। তোমাদের গ্রামে এখনও কি তেমন গভীর জঙ্গল আছে?
তোমাদের গ্রাম কেন বলছেন? আপনারও গ্রাম নয়? আপনার জন্মস্থান।
তা ঠিক, তা ঠিক।
দাদা, মাইজ পাড়ার কথা আপনার মাঝে মাঝে মনে পড়ে না?
ঠিক মাঝে মাঝে মাঝে না হলেও, বহু বছর তো হয়ে গেল, তবু হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায়। যখন মনে পড়ে, তখন স্মৃতি একেবারে জ্বলজ্বল করে। সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাই! সেখানে অত গাছপালা আছে এখনও?
না, না, মানুষ বাড়ছে না? সব সাফ করে দিচ্ছে। যে সব গাছের এখন মালিকানা নাই... আপনাদের বাড়ির সামনের জম্ভুরা গাছটা (বাতাবি লেবু) কঙ্কালসার অবস্থা আমি দেখছি, তাও শেষ পর্যন্ত গেছে। যে-সব জঙ্গলে ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে পলাপলি খেলেছি, সে-সব আজ অদৃশ্য!
জম্ভুরা গাছের আয়ু কত দিন হয়, জানি না, ষাট-সত্তর বছর আগের কথা। তবে বটগাছটা, ইস্কুল যাবার পথে, খুবই বিশাল ছিল, কত কোটর, কত ডালপালা, তার নীচে এক ধারে হিন্দুদের একটা ছোটখাটো শ্মশানও ছিল। তাই একটু ভয়ের ব্যাপারও ছিল।
দুঃখের বিষয়, সে গাছটাও নাই, কেটে ফেলেছে। আমি দেখেছি ছোট বয়সে, সত্যি খুব বড় গাছ ছিল সেটা, তবে বট না, অশ্বত্থ।
ওই গাছে তক্ষক ছিল। ঠিক সাত বার ডাকত, আমরা গুনতাম, ভয়ও পেতাম।
সে ডাক আমরাও শুনেছি। আমরা ওটাকে তক্ষক বলতাম না, বলতাম ঠক্কর। আর জানতাম যে ওরা দূর থেকে মানুষের শরীরের রক্ত শুষে নেয়। তাই আগে থেকে বুকে ছ্যাপ (থুতু) ছিটিয়ে নিতাম।
আসলে তক্ষক সাপই নয়, বড় আকারের গিরগিটি, বিষ-টিষ নেই। মহাভারতে তক্ষক সাপ একটা বড় চরিত্র, তাই নাম শুনলেই ভয় জাগত।
দাদা, আপনি হয়তো ব্যস্ত ছিলেন, আপনাকে ফোনে বিরক্ত করলাম কি না জানি না। আজ সকালে ঘুম ভেঙেই দেখি, আমার জানলার বাইরের গাছটা সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে, ঝলমল করছে রোদ, সেখানে দুটো পাখি এসে বসেছে। অর্থাৎ, এ দেশে বসন্ত এসে গেল। কানাডার প্রচণ্ড ঠান্ডাতেও পাখি দুটো বেঁচে ছিল কী করে তাই ভাবি। একটুক্ষণ ভাবতে ভাবতেই আমার দৃষ্টি ও মন চলে গেল বহু দূরে, পূর্ব গোলার্ধে, আমাদের গ্রামে। এখানে থাকি, প্রায়ই মন চলে যায় সেখানে। সেই মাটির পথ, বৃষ্টিভেজা গাছপালা, কত রকম পাখি, আমার খুব ইচ্ছে হল সেই গ্রামের স্মৃতির ছবি আপনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখি।
রাজ্জাক, আমার জন্ম তো তোমারও আগে। দেশভাগের আগে আর পরে তো ওই সব গ্রামের ছবি অনেক বদলে যাবেই। জনগোষ্ঠীর প্যাটার্ন পাল্টে গেছে। আমি যে-সব বাড়িতে যে-সব মানুষ দেখেছি, সেখানে এখন অন্য মানুষ। এই তো যেটা জতু গাঙ্গুলির বাড়ি বলে পরিচিত ছিল, এখন সেটা হাওয়ালাদার বাড়ি। এটাই স্বাভাবিক।
দাদা, হিন্দু-মুসলমান, ধোপা-নাপিত, বামুন-কায়েত, কামার-কুমোর, মুচি-ডোম-জেলে মিলে এক সময় মাইজপাড়া জমজম করত, আমি খুব ছোট বয়েসে অল্প অল্প দেখেছি সে-সব। তার পর কত মানুষ চলে গেল, আমার খেলার সঙ্গীরা, অনেক শূন্য বাড়ি হাহাকার করে, কেমন যেন নিরানন্দ ভাব।
তুমিও তো সে গ্রামে আর থাকো না।
থাকতে পারলাম না। ফিরে গেছি বার বার, আবার চলে আসতেও বাধ্য হয়েছি, তবু কেন বুক জুড়ে রয়েছে সেই গ্রাম। দাদা, একটা প্রশ্ন করি, আমার দেখা মতে, আপনাদের যেখানে বাড়ি ছিল, সেখানে ছিল তিনটি পরিবার। চৌধুরি, চ্যাটার্জি আর ব্যানার্জি, কেউ তো গাঙ্গুলিদের কথা বলেনি, কোনও বাড়িও দেখিনি। আমরা শুধু চৌধুরিদের দেখেছি, অন্য কোনও বাড়িতে কেউ ছিল না। সে বাড়ির এক জন আমাদের মতন বাচ্চাদের পড়াতেন। তাঁকে আমরা বলতাম নীলু চোদ্রি স্যার।
বললাম না, তোমার আর আমার স্মৃতির ছবি অন্য রকম হবেই। তুমি শুধু দেখেছ চৌধুরিদের, ওই পল্লিটি বামুনপাড়া বলে পরিচিত ছিল। একটা বড় চতুষ্কোণ প্রাঙ্গণের চার পাশে চারটি বাড়ি, প্রধান বাড়িটিই চৌধুরিদের, তাঁরা বেশ অবস্থাপন্ন। এর ঠিক উল্টো দিকেই নগেন চাটুজ্যের মস্ত বড় পরিবার, সেই পরিবারের এক জনকে আমরা ডাকতাম চুনীকাকা, পঞ্চাশ সালে তিনি খুন হন, কলকাতায় বসে শুনেছি, তার পরেই পরিবারটি ছত্রভঙ্গ হয়ে দেশত্যাগী হয়। আর দু’দিকে ছিল দু’টি ব্যানার্জি ও চ্যাটার্জি বাড়ি, এঁদের সম্পর্কে আমার স্মৃতি অতি সামান্য। তোমরা গাঙ্গুলিবাড়ির নাম শোনোনি, তার কারণ, বুঝতে পারছ, এই পরিবারগুলির মধ্যে গাঙ্গুলিরাই ছিল সবচেয়ে এলেবেলে, সব চেয়ে গরিব। তাদের সামনের দিকে স্থান হয়নি, পিছনের এক কোণে... আমার জ্যাঠামশাই থাকতেন, তিনি চলেও আসেন আগে।
বুঝেছি, ওইখানে একটা মস্ত পুকুর ছিল, এখন অনেকটাই মজে গেছে, পাট চাষ হয়।
অ্যাঁ? পুকুরটা আমার খুব প্রিয় ছিল। ওখানে আমি সাঁতার শিখেছি। প্রায়ই দুপুরে এসে বসে থাকতাম, জলের দিকে তাকিয়ে। কী যেন একটা দেখার আশায়।
চৌধুরিবাবু মারা যাবার পর তাঁর স্ত্রী দু’টি কন্যা নিয়ে আর থাকতে সাহস পেলেন না। তখন কিন্তু ‘বাংলাদেশ’-এর জন্ম হয়ে গেছে। উনি প্রতি বছর আমাদের নবান্ন খাওয়ার দাওয়াত (নেমন্তন্ন) দিতেন। সকালবেলা দৌড়ে গিয়ে চৌধুরি স্যারের স্ত্রীর গলা শোনা যেত, আয়, আয়, কাক, আয় আয়, কো-কো-কো...।
রাজ্জাক, তুমি আমাকে কত দিন পর নবান্নের কথা মনে করিয়ে দিলে। সেই কা কা ডাকা, সেই নতুন চালের গন্ধময় পায়েস।
টেলিফোনে অনেকক্ষণ ধরে এই সব কথা বলছে যে দু’জন, তাদের বিষয়, পৃথিবীর প্রায় উল্টো দিকে, সাড়ে চোদ্দো হাজার মাইল দূরের এক অতি সাধারণ গ্রাম। রাজ্জাক থাকে মনট্রিয়ল শহরে, আমি কার্য-কারণবশত কয়েক দিনের জন্য বোস্টন শহরে। আমি তো কখনও কোথায়, কোন মাটিতে আমার জন্ম, তা নিয়ে তেমন গুরুত্ব দিইনি। তবু ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কেন এই স্মৃতিচর্চা? আর রাজ্জাক হাওলাদার ছিল এক জন মুক্তিযোদ্ধা, তারা ছ’ভাইয়ের মধ্যে পাঁচ ভাই-ই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। রাজ্জাকের স্বপ্ন পূরণ হয়নি, দূর বিদেশে বসে বাংলার মাটির জন্য বুকে ব্যথা হয় তার। |
|
|
 |
|
|