মাওবাদীদের ‘প্ররোচনা’-র বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের হাতিয়ার হয়ে উঠছে ‘জল’। শুনতে অবাক লাগলেও কথাটা সত্যি। জলই জীবন---ছোটবেলায় পড়া এই কথাই এখন দক্ষিণ বিহারের রুখুসুখু এলাকার মানুষের আপ্তবাক্য। জঙ্গল আর পাহাড় ঘেরা এই সব এলাকায় এত দিন পর্যন্ত অনেক কসরত করার পরে বছরে ফসল হত এক বারই। তার কারণ ছিল একটাই, জলের অভাব। দারিদ্র আর অনুন্নয়ন গ্রামবাসীদের মূলস্রোত থেকে সরিয়ে নিয়ে যেত। বেকার যুবকরা রোজগারের খোঁজে হয় রাজ্য ছেড়ে পালাত, নয়তো নিয়মিত ‘মাসোহারা’-র লোভে ভিড়ে যেত মাওবাদীদের সঙ্গে।
এখন নাবার্ডের হাত ধরে বিহারের জঙ্গলমহলে জমা হচ্ছে জল। বছরের পর বছর ধরে ‘জল বিভাজন’ প্রক্রিয়ায় জল জমার ফলে এখন দক্ষিণ বিহারের অনেক জমিই দো বা তিন ফসলি। বছরে যে গ্রামে ফসল হত একশো টন। সেখানে এখন ফসল হয় তার দু’তিন গুণ। আরও আছে। জল বিভাজন প্রক্রিয়ায় চাষআবাদ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে গ্রামে নাবার্ডের প্রতিনিধিরা গড়ে তুলছেন বাসিন্দাদের একজোট হওয়ার প্রক্রিয়াও। একসঙ্গে সবাই মিলে ভাগ করে রোজগারের প্রক্রিয়া। তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। বাড়ছে আর্থিক সঙ্গতি। |
নাবার্ড-এর ম্যানেজার এস রমেশ বলছেন, “আমাদের দেশে বেশির ভাগ এলাকাতে খুব কম সময়ে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়। জল বিভাজন প্রক্রিয়ায় কম সময়ের বৃষ্টিকে প্রাকৃতিক উপায়েই জমিতে ধরে রাখার ব্যবস্থা হয়। তাতে জমির উর্বরতা যেমন বাড়ে, তেমনই বাড়ে ওই অঞ্চলের জলস্তরও।” রমেশ জানালেন, পাহাড়ের ঢাল ধরে সাধারণত এই জল বিভাজন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ছোট ছোট বাঁধ তৈরি করে জল আটকে সেই জলকে ছোটবড় নালার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয় বিস্তীর্ণ এলাকায়। প্রাকৃতিক উপায়ে জল ওই সব জমিতে গিয়ে জমে যায়। তাতেই সারা বছর ভিজে থাকে ওই সব জমি, যা বছরের সব সময়ে ফসল ফলাতে সাহায্য করে।
রমেশের কথায়, “যেখানে জল বিভাজন বা ওয়াটার শেড প্রক্রিয়ায় চাষ করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয় সেখানে প্রথমে একটি ওয়াটার শেড কমিটি তৈরি হয়। এবং এই কমিটির সদস্যদের গ্রামবাসীরাই নির্বাচিত করে। কমিটিতে ৯ থেকে ২০ জন পর্যন্ত সদস্য থাকতে পারেন। কমিটিতে মহিলা এবং ভূমিহীন কৃষক থাকা বাধ্যতামূলক। ওই কমিটিই গ্রামে জল বিভাজনের মাধ্যমে খেতের জলীয় ভাব বাড়ানোর প্রকল্পের বাস্তবায়ন করে। নাবার্ড ৪-৫ বছরের ওই প্রকল্পের জন্য কমিটিকে প্রায় ১ কোটি টাকা দেয়। গ্রামবাসীরা মিলেমিশে ওই অর্থের ব্যবহার করায় একজোট হওয়ার ভাবনা তৈরি হয়।” রমেশ জানালেন, একই সঙ্গে ওই কমিটির মাধ্যমেই স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তোলার কাজও শুরু করে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তাতে জীবিকার সম্ভাবনাও তৈরি হয়।
মাসখানেক আগেই বিহারের মুঙ্গের জেলার কারেলি গ্রামে হামলা চালিয়েছিল মাওবাদীরা। আদিবাসী অধ্যুষিত ওই গ্রামে হামলা চালিয়ে মাওবাদীরা হত্যা করে ছ’জন গ্রামবাসীকে। মাওবাদীদের সাহায্য না করা এবং সরকারি উন্নয়নে অংশগ্রহণ করার অপরাধেই ওই গ্রামে হামলা চালায় জঙ্গিরা। একই ভাবে ক’দিন আগেই হামলা হয় রোহতাস জেলার বান্ডা গ্রামে। হামলায় মৃত্যু হয় আদিবাসী খেরওয়ার সম্প্রদায়ের তিন জনের। পুলিশ এবং সরকারপক্ষকে সমর্থন করার কারণে এখানেও হামলা চালিয়েছিল মাওবাদীরা।
নাবার্ডের বিহার শাখার সহকারী জেনারেল ম্যানেজার বিনোদ কুমার জানিয়েছেন: বিহারে কৈমুর, রোহতাস, ঔরঙ্গাবাদ, গয়া, নওয়াদা, জামুই, বাঁকা এবং মুঙ্গেরে প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমিতে দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জল বিভাজন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। ২০০৫-০৬ আর্থিক
বছর থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্পে বরাদ্দ হয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। বিনোদের দাবি, বিহারে এর সাফল্যের হারও নব্বই শতাংশেরও বেশি। |