রবিবাসরীয় গল্প
নিভৃত নীল পদ্ম
কী জানি কী ভাবে ঢুকে পড়েছিল রান্নাঘরে। ছাইরঙা শরীর, গলার কাছে ময়ূরকণ্ঠী সবুজাভ ভেলভেট, ছোট্ট তীক্ষ্ন ঠোঁঠ জোড়া। চোখ দুটো লাল পুঁতি, স্বচ্ছ। একটু যেন আর্তও মনে হল। অল্প ডানা মেলে ওড়বার চেষ্টা করছিল, পারছিল না। তাই ঘরময় ত্রস্ত পায়ে চক্রাকারে ঘুরছিল শুধু। তার পর বোধ হয় ক্লান্ত হয়ে বেসিনের নীচে ঘেরা জায়গাটায় এক্কেবারে ভিতরে সেঁধিয়ে গিয়ে একতাল ছাইগাদার মতো বসে রইল। ঠোঁট দুটো বুকে ছোঁয়ানো। শুধু লাল চোখ দুটিতে অপার ভয় আর সংশয়। আমি কৌটো থেকে বিস্কুট বের করে কয়েকটা ভাঙা টুকরো বেসিনের তলায় ছুড়ে দিলাম। পাখিটার উদ্দেশ্যে। ও দ্বিধায় এক বার ঠোঁট ছোঁয়াল মাত্র। তার পর দু’চোখ বুজে স্থির বসে রইল একই রকম ভাবে।
আমার মা-র দু’জন প্রেমিক আছে। চিন্ময়কাকু আর দ্রোণ। চিন্ময়কাকু মানুষটা সাদাসিধে, চুপচাপ ধরনের। আগেও আসতেন মাঝে মাঝে; তার পর বাবাকে যখন মেন্টাল অ্যাসাইলামে নিয়ে যাওয়া হল, তখন থেকে আসা-যাওয়া ক্রমে বেড়ে যায় চিন্ময়কাকুর। তখন অবশ্য মা-র মাথায় অনেক চিন্তা। টাকাপয়সা কোথায় কী রাখা আছে, বাবার অফিসে চাকরির জন্য তদ্বির, আমি তখন অনেক ছোট। মানে, তখন ঠিক খোলা মনে প্রেম করার মতো অবস্থা নয় মা-র। তখন চিন্ময়কাকুই পাশে দাঁড়ানো বন্ধু, তখন সে নির্ভরতা, আশ্বাস। আশ্রয়ও। আবার এই রকম দোলাচলের মধ্যেই কোথা থেকে প্রেম ঢুকে পড়ল মা আর চিন্ময়কাকুর মধ্যে। দেরি করে বাড়ি ফেরা, আলো হারিয়ে অন্ধকারে মুখ চেনার প্রয়াস, সহজ সম্পর্কের প্রাঞ্জলতা ঘুচিয়ে পরকীয়ার ঘেরাটোপে তাকে আবিষ্কার করার বাসনা রকমারি সব খেলায় মেতে উঠেছিল মা আর চিন্ময়কাকু।
পৃথিবীর সকলের কাছে লুকিয়েও মা কিন্তু আমার কাছে ধরা পড়ে যেত ঘন ঘন। সে এক মজার ব্যাপার। মা’র চোখ দুটো বরাবরই শরতের আকাশের মতো নির্মল। মনের ভাবটা তাতে ছায়া ফেলে নির্দ্বিধায়। তাই মা কিছুতেই মনের ভাষা লুকোতে পারে না, অন্তত আমার কাছে। মা তখন মনের টালমাটাল দ্বন্দ্ব নিয়ে, সুখের বৈভব আর তার সঙ্গে সম্পৃক্ত আদিগন্ত দুঃখবোধ নিয়ে কেমন অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকত আমার পানে, যেন নিজের ছেলের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করছে পরকীয়ার নিষিদ্ধ প্রাঙ্গণে পা রাখার জন্য।
আমি মাকে অনায়াসে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। যদিও আমি মানতাম ওটা মা’র জীবন, আর তাতে মা’রই নিরঙ্কুশ অধিকার। আমার সম্মতির সিলমোহর তাতে লাগে না। তবু উদার হওয়ার, আত্মাশ্লাঘা অনুভব করার এমন সুযোগ আমি হেলায় হারাইনি।


বিকেলবেলা রান্নাঘরে চায়ের জল চাপাতে গিয়ে দেখি পাখিটা উধাও। মেঝে নোংরা করে গিয়েছে, বিস্কুটের টুকরোগুলো সেই রকম পড়ে আছে। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে পাশের ছাদে গিয়ে দেখি যে, কাঠের সিঁড়িটা তিন তলার ছাদে উঠে গিয়েছে, তার একটা ধাপে চুপ করে বসে আছে পাখিটা। তাকে ঘিরে কাকেদের কৌতূহল, ওড়াউড়ি, কা-কা কলরব। ওরা বুঝতে পেরে গিয়েছে ওড়বার ক্ষমতা কেমন করে হারিয়ে ফেলেছে পাখিটা। তাই পাখিটা ওদের সফ্ট টার্গেট। অতএব তাকে ঘিরে এখন তাদের ধুন্ধুমার ছৌ। আমি একটা লাঠি এনে কাকগুলোকে তাড়ালাম। চলে না গেলেও পাখিটার কাছে ঘেঁষতে সাহস পেল না আর। লাল পুঁতির চোখ তুলে পাখিটা আমাকে দেখল।
এখন বুঝতে কষ্ট হয় না যে, মা কোনও দিনই চিন্ময়কাকুকে ভালবাসেনি। প্রয়োজন মতো ব্যবহার করেছিল মাত্র। অবশ্য চুপচাপ গোবেচারা চিন্ময়কাকুকে দেখলে বোঝা যাবে না যে, সে জন্য তার খুব একটা মনখারাপের ব্যাপার আছে। কৃষ্ণা বলতে তিনি অজ্ঞান, আজও।
বাবার অফিসে চাকরিটা পাওয়ার সুবাদে মা যেন এক্কেবারে অন্য চেহারায় ধরা দিল। মা অবশ্য কোনও কালেই ঠিক ঘোমটা দেওয়া, তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালানো টাইপের ছিল না। তবে আটপৌরে জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত থেকে এক জন মধ্যবিত্ত সংসারী বউয়ের পক্ষে কতখানি প্রগলভা আর দেখানো সম্ভব!
তবে চাকরিটা মাকে বদলে দিল। রাতারাতিই বলতে গেলে। ছিমছাম সাজে মোটা দাগের আদেখলেপনা এল। সাজ যত পরিপাটি হতে লাগল, ঘরের ভেতরখানা ততই অগোছালো হয়ে উঠল। ঘরে থাকার প্রবণতা কমতে কমতে বাইরের হাতছানি এক সময় তাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করল। মা’র ঠোঁটে লালিমা এল; সঙ্গে চোখের কোণে কালিমাও। আর সেই সঙ্গে এল দ্রোণ।
মায়ের অফিস কলিগ। স্মার্ট, ঝকঝকে পালিশ করা চেহারা। গৌরবর্ণ, সাবলীল পুরুষ। খুব লম্বা নয়, তবে বৃষস্কন্ধ। ঠোঁটের কোণে আবছা সারল্য। হয়তো কিছুটা আরোপিত, তবু জেনেশুনে তাকেই সত্য বলে মানতে চায় মন।
দ্রোণকে ঘিরে মা অনাবশ্যক উচ্ছল। শীতের ভোরে হঠাৎ যেন কৃষ্ণচূড়ার শাখায় হলুদ বসন্ত। বিসদৃশ আর ছন্দহীন। মাকে দেখে কষ্ট হয় আমার। বলিষ্ঠ, সপ্রতিভ একটা জ্বলন্ত পৌরুষকে আয়ত্তে রাখার কী নিদারুণ প্রচেষ্টা। তাতে যে দ্বিধাহীন ভাবে আপন অস্তিত্বের দৈন্যতাই শুধু প্রকাশ পাচ্ছে, সেটা যেন খেয়ালই নেই। মাকে সে সত্যিটা কে জানাবে! আমি শুধু মা’র করুণ চেষ্টার অসহায়তা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। মাকে তবু ঘৃণা করতে পারি না। চিন্ময়কাকুর সঙ্গে তঞ্চকতা করতে দেখেও না।
চিন্ময়কাকু আগের মতোই নিয়ম করে সন্ধেবেলা আসেন। মা এই সময় বাড়িতে থাকবে না, জেনেও আসেন। অভ্যাস মতো সিঙ্গল সোফাটায় সঙ্কুচিত ভঙ্গিতে এসে বসেন। সেন্টার টেবিলের নীচে থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে আলগোছে পাতা ওল্টান আপন মনে। এক কাপ চা, দুটো বিস্কুট গলাধঃকরণ করে দ্বিধান্বিত স্বরে বলেন আজ উঠি, কেমন! কৃষ্ণা এলে বলে দিয়ো, আমি এসেছিলাম।
মানুষটাকে দেখে আমার অদ্ভুত ভাবে মনে হয়, কৃষ্ণা নাম্নী কোনও নারীকে দেখবার বা তার সঙ্গ পাওয়ার জন্য নয়; চিন্ময়কাকু যেন সন্ধেবেলার এই চিহ্নিত সময়টারই প্রেমে পড়েছেন। যেন এই বিশেষ সময়টাতেই যত সুখের হাতছানি। সময়ের অনুষঙ্গে কৃষ্ণা, নাকি
কৃষ্ণার অনুষঙ্গে সময় কাকে খুঁজতে চিন্ময়কাকু এই বাড়িতে হাজির হন প্রতিটি সন্ধ্যায়, তা বোধ হয় তিনিও নির্দিষ্ট করে জানেন না।
পরের দিন সকালবেলা মা’র ঘরে গেছি, দেখি ড্রেসিং টেবিলের কাচের ওপর পাখিটা চুপচাপ বসে আছে। আমাকে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। লাল চোখ দুটোর চাহনি বেশ স্পষ্ট। গলা দিয়ে একটা গম্ভীর মতন স্বরও বের করল যেন। ময়ূরকণ্ঠী গলাটা ফুলে উঠল কয়েক বার। গলার সবুজাভ বর্ণ দিয়ে পাখিটা নিজস্ব বৈভব ছড়াতে চাইল আমার পানে তাকিয়ে। তার পর হঠাৎই নিঃসীম ঔদাসীন্যে আমার দিকে পিছন ফিরে নিজেকে দেখতে লাগল ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। ওর লাল দু’খানি পায়ের বিভঙ্গে আর লেজের ঝাপটে মা’র কয়েকটা সাজের সরঞ্জামের শিশি স্থানচ্যুত হল। ও ভ্রুক্ষেপই করল না। ঘাড় বেঁকিয়ে ও আপন মনে নিজেকে বিভোর চাহনিতে দেখতে লাগল। তার পর আয়নার ভিতর দিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে যেন ছাইরঙা ডানা দুটো একটুখানি মেলে ধরে সামান্য একটু ‘বাও’ করল।
আমার মজা লাগল ওর ভঙ্গিতে। আমি ওর দিকে সামান্য এগিয়ে যেতেই মেঝেতে নেমে পড়ল ও। অতঃপর মেঝেতে কাল্পনিক একটা বৃত্ত এঁকে আপন মনে দু’তিন পাক ঘুরে নেচে নিল। সব শেষে আমার অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে খোলা জানলার গ্রিলে লাল পা দুটো আঁকশির মতো ব্যবহার করে বসে অল্প অল্প দোল খেতে লাগল।
নিজের মধ্যেকার দোলাচলের খবরটা ঠিক কী ভাবে পৌঁছেছিল, এখন আর তা মনে নেই। তবে দ্রোণের সঙ্গে মায়ের এই মেলামেশাটা আমাকে বিপন্নতার এক খাড়াই পাহাড়চূড়ার প্রান্তে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। প্রথমে চিন্ময়কাকুকে দেখলে যে করুণার উদ্রেক হত, তাকেই মা আর দ্রোণের সম্পর্কের অপর পিঠ বলে ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলাম। ওই ভাবনাটা কবে যেন শুকনো গাছের ছালের মতন খসে পড়ল। আমি কেমন হঠাৎ একা হয়ে গেলাম।
আমার একলা আমিকে আবিষ্কারের বোধ হয় সেটাই শুরু। সাজগোজ করতে আমার বরাবরই ভাল লাগে। ক্লজেট জুড়ে আমার জিন্স, টি-শার্টের ইয়ত্তা নেই। তা ছাড়া বাবা যত দিন সুস্থ ছিল, তত দিন তো বটেই, তার পর মাও, মিথ্যে বলব না, যখন-তখন দামি ব্র্যান্ডের শার্ট আর ট্রাউজার কিনে তাদের একমাত্র ছেলের আবদার মিটিয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে কিছু ডিজাইনার কালেকশনও। এ ছাড়া বিদেশি পারফিউম, আফটার শেভ...
কলেজ যেতে আমার ভাল লাগে না। কোনও দিনই লাগত না। তবে আগে উপায় ছিল না। এখন সকাল ন’টার মধ্যে মা সেজেগুজে অফিসে চলে যায়। ফেরে সন্ধে পেরিয়ে, কখনও রাত দশ-সাড়ে দশ-এগারো। অর্থাৎ আমার কাছে গোটা একটা নিরঙ্কুশ দিন। তখন মা’র ড্রেসিং টেবিলে আমার একচ্ছত্র অধিকার। নিপুণ হাতে আইলাইনার লাগাই, আমার কর্কশ ঠোঁট দুটো ঢেকে দিই পেলব লিপগ্লসে, গালে ব্লাশার ছোঁয়াই, ওয়াক্সিং করা হাতে-পায়ে মা’র বডি ম্যাসাজ ঘসি আর তার পর ঘরের দরজা জানলা সব বন্ধ করে অতি সন্তর্পণে বের করে আনি লুকিয়ে কিনে আনা স্কার্ট, রঙিন টপ আর কানের দুল।
সম্পর্ণ নিরাবরণ হয়ে দাঁড়াই আয়নার সামনে। ঘৃণা হয় শরীরটার ওপর, লজ্জা হয়;
বিষের মতো মনে হয় এই নগ্ন সমগ্রতাকে। সারা মুখে যত্নে করা প্রসাধন যেন বিদ্রুপ করে আমাকে। আবার ওখান থেকেই সুখ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে। শীতের ভোরে খেজুর গাছের গা বেয়ে রসের মতো। সে রসের ভাণ্ডে সাপের ছোবল আছে। তীব্র বিষের জ্বালা। তবু সেখানেই সুখ... সেখানেই যে দ্রোণ...!
আমার ঘরের খাটের নীচে পুরনো সুটকেস, ট্রাঙ্ক। তাতে যত রাজ্যের বাতিল জামাকাপড়, ফটো অ্যালবাম, পুরনো পূজাবার্ষিকী, ক্যালেন্ডারের দেবতারা! সেখানে, সেই জমাট বাঁধা কালো অন্ধকারের গভীরে মনের মতো আস্তানা খুঁজে নিল পাখিটা। অথচ ওর ওড়বার জন্য একটা পুরো আকাশ পড়ে আছে।
কলেজে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি একেবারে। মা জানে না। জানবার মতো সময়ই নেই মা’র। তাতে সুবিধেই হয়েছে। একলা আমিকে নিয়ে এই মগ্ন চৈতন্যের মধ্যে আবার কোথায় যেন ডুব মেরে পানকৌড়িটা জানান দিয়ে যায় সুখের অপর নাম বেদনা। আমার ঘরের দেওয়াল জুড়ে অ্যাথলিটদের ব্লো-আপ। নানান ভঙ্গিমায়। সবাই পুরুষ তারা। বলিষ্ঠ বাহু, ঋজু দেহবল্লরী, দৃঢ় ঢেউ খেলানো পেশিবহুল দেহ। আমার শরীরের মধ্যে বসন্তবৌরি ডাকে। শিরদাঁড়া বেয়ে নিষিদ্ধ সর্পের বক্রতা। তার হিস হিস শব্দে বুকের ভেতর প্লাবন। দ্রোণ আসে তখন।
কল্পনার উজান ঠেলে দ্রোণকে আসতে দেখে থমকে দাঁড়াই। ওর সাবলীল হেঁটে আসা, ঠোঁটের কোণে অলস হাসি। আমার কাঁধের কাছটিতে দু’টি বলিষ্ঠ হাতের পাঞ্জা দিয়ে চেপে ধরে ও। আমি মোমের মতো গলে পড়তে থাকি। তার পর চমক ভাঙে। অন্ধকার ঘরে শুয়ে আমি বিছানায় এ পাশ ও পাশ করি। মা’র ঘরের দরজা ভেজানো। ঘরের মধ্যে দ্রোণ আছে।
কেন তুমি এ ভাবে নিজেকে নষ্ট করলে, দ্রোণ? আমার সমস্ত আকাশটা তোমার জন্য পড়ে ছিল, একান্ত করে রাখা ছিল, তবু অন্ধকার ঘরটাই তুমি বেছে নিলে!
তখন মা’র ওপর আমার খুব ঘৃণা হল। মনে হল একটা বিষাক্ত মাকড়সা আটটা দাঁড়া দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে গিলে যাচ্ছে দ্রোণকে। অথচ আমার কিছুই করার নেই। মনে হল, মা তার এই মাকড়সা-জীবনটা নিয়ে এক দিন আমাকেও শেষ করে দেবে। তার আগেই পালাতে হবে আমাকে এ বাড়ি ছেড়ে। তুমি আমার সঙ্গী হও, দ্রোণ! তোমার মতো সুন্দর পুরুষ আমি জীবনে দেখিনি। মা’র যূপকাষ্ঠে তুমি নিজেকে বলি দিয়ো না। তুমি আমার সহায় হও।
কিন্তু দ্রোণ যদি আমার ভালবাসা চিনতে না পারে, তখন? ও কি শুধু আমার বাইরের পুরুষ রূপটাই দেখতে পায়? একলা আমিটাকে কি ও কোনও দিন বুঝবে না? ওই নারীতেই বিভোর থেকে যাবে ও?
ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। একটা আবছা মতো স্বপ্ন চেতনায় ঘাই মারল যেন। একটা লম্বা পথ এঁকেবেঁকে দিগন্ত খুঁজতে চলে গেছে। সেই উধাও পথের দু’পাশে ঘন শালবন। আঁধারে আলোতে ঝিলমিল সে পথে কেউ কোত্থাও নেই। হঠাৎ সেই শালের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল দ্রোণ। ওর চোখমুখ ভয়ার্ত, ও পালাচ্ছে। উদ্ভ্রান্তের মতো, দ্রুত, আরও দ্রুত। শুকনো পাতায় শব্দ তুলে ও যেন দিগন্তে মিলিয়ে যেতে চাইছে। হঠাৎ দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে মা’র হাসি শুনতে পেলাম।
কী নিষ্ঠুর, ক্রুর আর অভ্রভেদী সে হাসি। সে দৃশ্যপটে আমি কোথাও নেই। অথচ অশরীরী সেই আমিটার তখন বুক জোড়া প্রচণ্ড দহন। লক্ষ করলাম লিভিং রুমের আলোটা নেভানো। মানে, দ্রোণ চলে গিয়েছে।
আমি ভাঙনের গান কানে নিয়ে বিছানায় ভূতের মতো বসে রইলাম।
পাখিটা এখন আমার খুব নেওটা হয়ে গিয়েছে। হাতের তালুতে খাবার রেখে ওর সামনে ধরলে ঠুকরে ঠুকরে খায়। উড়ান দিয়ে আমার বাজুতে এসে বসে। লাল পায়ে ওর লম্বা নখ। কিন্তু কী আশ্চর্য, এতটুকু আঘাত দেয় না আমাকে। ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখে শুধু। ওর লাল পুঁতি চোখে কখনও মায়া, কখনও কৌতুক, কখনও বা গভীর তন্ময়তা। আমি ওর ছাই-রঙা পিঠে মমতায় হাত বুলাই, তুলতুলে নরম ময়ূরকণ্ঠী গলায় বিলি কেটে দিই। ও অবলীলায় আমার আঙুলটা খুঁজে নিয়ে তাতে ছোট্ট ঠোঁট দুটো ঘষে। ওটাই ওর ভালবাসা ফেরত দেওয়ার রীতি।
ওর ঠোঁটের স্পর্শে আমার শরীরটা শিরশির করে। তার পর হঠাৎই একটা সম্পূর্ণ অচেনা ভয় আমার হাঁটু দুটো চেপে ধরে। আমি কি তবে পাখি হয়ে যাচ্ছি? পুরুষ থেকে নারী... অতঃপর পাখি!
দ্রোণ আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমার বাসনার প্রত্যুত্তরে ও হেসেছিল। আমার অন্তঃপুরের নির্মাণে তখন অতলান্ত ধস, তখন হাসছিল দ্রোণ। ওর শরীর জুড়ে হাসির গমক। ওর চোখের মণিতে শুধু বিস্ময় আর কৌতুক। আমি চোখ বুজে, কানে ঠুলি এঁটে যেন পালিয়ে বেঁচেছিলাম।
তার পর থেকে আমার একলা আমিটা সর্বস্ব দিয়ে গ্রাস করে নিল আমাকে। এই পুরুষ দেহটার প্রতি অকুণ্ঠ ঘৃণায় আমার অস্তিত্বের চরাচর আষাঢ় মেঘে ছেয়ে গেল। আমি যেন ক্রমশ নিজেকে বদলে যেতে দেখলাম। যেন এতে আমার কণা মাত্র কিছু করবার নেই। আমার ইচ্ছা ব্যতিরেকেই যেন ঘটে যাচ্ছে সব কিছু। বদলে যাচ্ছে প্রেক্ষাপট। আমি শুধু মাল্টিপ্লেক্সে বসা এক তৃষাতুর দর্শক মাত্র। কোন জাদুবলে আমার অনুভবের শক্তিটুকুও যেন লোপ পেয়ে গিয়েছে। অথচ আমার বাসনার তুলিতে আঁকা প্রিয় ছবিগুলিই অভিনীত হয়ে যাচ্ছে আমার চোখের সামনে। আর কী নির্মম ভাবে আহরণের ক্ষমতাটুকুই হারিয়ে বসে আছি আমি।
আমি পাখিটাকে হাত নেড়ে ডাকলাম। জানলার কাছে বসে ছিল ও। বাইরের আকাশে ওর চোখ। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আপন মনে বললাম, চল, আকাশটাকে আরও বড় করে, নিবিড় করে চিনে নিই আমরা। বশংবদের মতো ও আমার বাজুতে এসে বসল। প্রতিবারের মতো। আমি ওর চোখ দুটো লক্ষ করলাম। সেখানে বিস্ময় নেই, কৌতুক নেই, শুধু আশ্চর্য এক ঋজু সাবলীলতা আছে। যেন আস্ত একখানা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ও। যেন প্রাচীন এক গ্ল্যাডিয়েটর কিংবা একেবারে পৌরাণিক যুগের অক্ষৌহিণী সেনানী এক জন।
আমি পাখিটাকে বাজুতে বসিয়ে দৌড় লাগালাম ছাদের পানে। আমার চলার ক্ষিপ্রতায় টাল সামলাতে না পেরে পাখিটা ডানা ঝাপ্টাল, কিন্তু উড়ে গেল না।
খোলা আকাশে বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম আমি। বাতাসে অন্য রকম গন্ধ। বর্ষা শেষে শরৎ কি এসে গেল? আমি নীল আকাশ জুড়ে ভেসে বেড়ানো পেঁজা তুলোর বিভিন্ন আকারের মধ্যে কৈশোরের প্রগলভতায় হাতি, বাঘের মুখ আর ময়ূরপঙ্খী নৌকো খুঁজতে চাইলাম।
অতঃপর পাখিটাকে আমি চরম অভিলাষে নরম হাতের তালুতে ভরে নিলাম। দশটা আঙুল অন্তহীন মমতার নির্যাসে স্নাত করে আমি পাখিটাকে উড়িয়ে দিলাম আকাশে। ও কেমন অবিশ্বাসী চোখে আমাকে এক বার দেখে নিল। তার পর ছাদের আলসেতে গিয়ে বসল।
আমি দু’হাতে তালি দিলাম। ওকে তাড়াবার জন্য। লাল পুঁতি চোখ মেলে বিষণ্ণতা ছড়িয়ে ও গোটা আকাশটাকে আপন করে নিতে অবশেষে উড়ে গেল।
আমি ছাদের পাঁচিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। অনেক নীচে কালো ফিতের মতো রাস্তাটা ডান দিকে বেঁকে রওনা হয়েছে নিরুদ্দেশে। তাতে কয়েকটি মানুষ জন, ইতস্তত ক’টা গাড়ি, দাঁড়ানো বা চলমান। বিরাট ঝাঁকড়া বকুলগাছটা ফুলে ফুলে ভারাক্রান্ত। ওর সৌরভটুকু আমার সম্পূর্ণ করে চাই। ওই কালো রাস্তাটা দিয়ে আমার কি কোথাও যাওয়ার কথা ছিল?
আমি ছাদের পাঁচিলে উঠে দাঁড়ালাম। দু’হাতের প্রসারে আকাশটাকে স্পর্শ করবার চেষ্টা করলাম দশটি আঙুল দিয়ে পাখিটাকে ধরে ছিলাম যে পেলবতায়, অবিকল সেই আবেশে। আমার ভেতরের নির্মাণকে পূর্ণতার শেষ আঁচড়খানি দিতে এ ছাড়া অন্যতর প্রয়াস আমার জানা ছিল না।

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
Probondho Rabibasariyo Magazine



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.