রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
উদ্ভ্রান্ত এই আদিম যুগে আমরা যখন...
বীন্দ্রনাথকে নিয়ে আম-বেঙ্গলির উচ্ছ্বাস থেকে বরাবরই আমাকে একটু দূরে দূরে থাকতে হয়েছে। সব সময় যে পুরো ব্যাপারটা বুঝে পাশ কাটিয়ে গেছি তা নয়, বেশির ভাগ সময়ে উনিই নিরাপদ ডিসট্যান্স বজায় রেখে আমার পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন বললেই বরং খানিকটা সৎ থাকা যাবে। একদম ছেলেবেলায় যে ক’টি কবিতা মুখস্থ করলে বাপ-মায়ের কর্তব্যপরায়ণতা এবং তাঁদের সাংস্কৃতিক-মনস্কতা-মিশ্রিত পূর্ববঙ্গীয় টান সহ পশ্চিমবঙ্গীয়-বামপন্থী অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হত না, এবং ভবিষ্যতে সদর দরজা ঠেলে বাড়িতে ধোপা-নাপিতের আনাগোনার ব্যবস্থাটিও মোটামুটি অক্ষুণ্ণ রাখা যেত, সেই ক’টা কবিতা আমি যতটা সম্ভব মন দিয়ে একপ্রকার মুখস্থ করেছিলাম। ‘একপ্রকার’ বলার কারণ এই যে, সমবয়স্ক কিছু ব্যক্তির লাগাতার কালচারালি রাবীন্দ্রিক চাপ এবং একটি নেহাতই নবীন কিশোরকে একলা পেয়ে উদ্বুদ্ধ করার নাছোড় গোঁ সত্ত্বেও আমি কোনও দিন স্টেজে ওঠার আগে দাঁতে দাঁতে কত্তাল বাজিয়ে সর্বাঙ্গে ঠকাঠক কাঁপুনি ধরাকে আটকাতে পারিনি। উত্তেজিত আত্মীয়েরা প্রথমাবস্থায় শারীরিক বেমারিটিকে ‘আমলকি বন কাঁপে যেন তার বুক করে দুরু দুরু’ গোছের একাধারে কসমিক এবং পোয়েটিক ইন্সপিরেশন, বা সোজা বাংলায় কাব্যিক প্রতিভাসম্পন্ন অপাপবিদ্ধ বালকের ভর হওয়া ধরে নিয়ে ওই যেমন মেঘাচ্ছন্ন আকাশের বুকে বকেদের সারি বেঁধে উড়ে যেতে দেখে গদাধর ভটচাজের যেমনটা হয়েছিল আর কী অত্যুৎসাহী হয়ে ওঠেন। কিন্তু পঁচিশে বৈশাখের পর বাইশে শ্রাবণেও ফের এক বার যখন ‘হে মোর চিত্ত...’ বলেই আটকে গিয়ে সর্বসমক্ষে কোঁকাতে শুরু করলাম, তখন তারা কেস গোলমেলে বুঝে শেষমেশ সরেই দাঁড়ালেন। সবচাইতে দুঃখ পেয়েছিলেন আবৃত্তি শেখাতে আসা ভদ্রলোক। পরবর্তী কালে তাঁকে আমরা দেখলেই ঢিল মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতাম, এমনকী আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়টিকেও দেখতাম জিঘাংসা মাখা মুখে আধলা টিপ করতে। কে বলে বাঙালির কিছু হবে না, কে বলে বাঙালি ‘ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোরা মার’ ইত্যাদি আহ্বানকে চিরকাল পেটি স্বার্থের তাগিদে পাশ কাটিয়ে যাবে? যাক গে সে আলাপ।

মননশীল গারগেল
আবৃত্তিকারের প্রসঙ্গে ফিরি। বৈশাখ মাসে উত্তরবঙ্গের চাঁদি ফাটা শুকনো বালি ওড়া গরমিতে মাফলার গলায় জড়িয়ে এবং নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে ছোট নস্যির ডিবের মতো টিনের কৌটো থেকে আদার কুচি, লবঙ্গ, যষ্টিমধু ইত্যাদি মুখে ফেলে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে আদা-চা খেয়ে, মা-কাকিমাদের দিয়ে গরম জল করিয়ে, তাই দিয়ে গারগেল করে মননশীল সাহিত্যবোদ্ধা হিসেবে এগজাম্পল সেট করার মহান ব্রতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন তিনি। খেঁকুটে মার্কা চেহারা ছিল, তবে ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি যখন ভাব দিয়ে অভিনয় সহকারে চোখ পাকিয়ে আবৃত্তি করতেন, তখন কোলের খোকারা তো বটেই, আমাদের মধ্যে ভিতু প্রকৃতির যারা, তারাও আঁতকে উঠত। ওঁর দাবি ছিল এই যে, আফ্রিকা স্বাপদশঙ্কুল মহাদেশ।
অবোধ এবং চতুষ্পদ নরখাদক ছাড়াও ভূখণ্ডটিতে দ্বীপদী স্বজাতিভক্ষণকারীরা পিলপিল করে বেড়াচ্ছেন। তাই ওই বীভৎস এবং বর্ণময় প্রাণিজগৎ বিশিষ্ট মহাদেশ সম্পর্কিত পোয়েট্রি সঠিক রূপে আবৃত্তি করার জন্য, এবং সে ভাব দ্বারা শ্রোতাদের বুকে আগুনের লেলিহান পূত-শিখা প্রজ্জ্বলিত করার জন্যও বটে, অ্যাপ্রোপ্রিয়েট মুখভঙ্গিমা, অর্থাৎ বিস্ফারিত নেত্রে দাঁত খিঁচানো ভোকাল কর্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ, যার সাদা বাংলায় মানে গালার শিরা ফুলিয়ে চেঁচানো। এবং শারীরিক কন্ট্রোল ইজ আ মাস্ট।

ম্মিট্টি চিত্রাঙ্গদা
পাড়ায় ‘চিত্রাঙ্গদা’ মঞ্চস্থ হবে এবং পরিবার কল্যাণ নামক কেন্দ্রের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমূলক প্রোপাগান্ডায় একটি বা দু’টি সন্তানের জন্ম দিয়েই খালাস পাওয়া কমিউনিটিতে রাজকন্যা হামেশাই কম পড়িত বলিয়া অধমকে টেনে হিঁচড়ে কাজল, রুজ, লিপস্টিক মাখিয়ে এবং সর্বোপরি, পরনে একখানা শান্তিপুরী শাড়ি জড়িয়ে দিয়ে গাল টিপে কয়েকজন সমাজবিরোধী টাইপের কাকু-কাকিমা ‘ওম্মা ক্কী ম্মিট্টি, ক্কী দ্দারুণ দেখাচ্ছে’ বলে খানিক আদিখ্যেতার পর আমায় আকুল পাথারে নিমজ্জিত অবস্থায় রেখে হাওয়া হয়ে গেলেন। সামনের সারিতে বসে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসবার আর চটপট ক্ল্যাপ দেওয়ার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন কিনা, তাই! আমিও কম যাই না। ওঁদের সামনাসামনি বেয়াদপি করলে গোটা পাড়া চাঁটাবে, তাই সবার অলক্ষ্যে শাড়ি খুলে পিছনের দরজা দিয়ে দিগন্তে বিলীন হয়ে গেলাম। জামা দিয়ে লিপস্টিক মুছেছিলাম ঠিকই, কেবল সারা মুখে কাজল লেপ্টে ভয়ানক চেহারা হয়েছিল। আমার চার পাশের লোকেদের কিন্তু এখনও এতটুকু উৎসাহে ভাটা পড়েনি।

মা বীরপুরুষ
গোটা পৃথিবী জুড়ে যেখানেই চারটে বাঙালি জুটেছে, সেখানেই ট্রাঙ্ক হাটকে, মায়ের শাড়ি, বাবার ধুতি, বউয়ের ওড়না ঝেঁটিয়ে মঞ্চ বেঁধে, বউকে আর মেয়েকে ‘গীতবিতান’-এর সামনে বসিয়ে, গান তুলিয়ে, ছেলেকে দিয়ে ‘বীরপুরুষ’ মুখস্থ করিয়ে ফাটিয়ে রবীন্দ্র-সন্ধ্যার আয়োজন করেছে। বৈশাখের প্রখর রোদ অগ্রাহ্য করে মহিলাদের দেখেছি, সকাল থেকে বিউটি পার্লারে চুল কোঁকড়া বা স্ট্রেট করিয়ে, ম্যাজেন্টা লিপস্টিক, কচি কলাপাতা রঙের জরি বসানো শাড়িতে শোভিত হয়ে কুচো বাচ্চার গালে ফলস দাড়ি লাগিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাজিয়ে ইসকুলে নিয়ে চলেছেন। বাচ্চাটির ফুটপাথে ঠোক্কর খেতে খেতে ‘এই গেল সেই গেল’ অবস্থা, মা-টি বাচ্চার ড্যানা হেঁচকে তার মধ্যেই টানতে টানতে কানে তাঁদের গোঁজা জবা ফুলের পর কী হল বলে, ‘পাপ্পা কাল তোমায় যেমন ভাবে বলতে বলেছে, সে ভাবে বলো’ বলতে বলতে মেক-আপ লেবড়ে মিসেস দাশগুপ্তর ছেলেকে টপকে কী ভাবে তার কচিটি বাংলার সাংস্কৃতিক আকাশে ধূমকেতুর ন্যায় উদিত হয়ে বাকিদের ভাত মেরে দেবে, সেই চিন্তায় আকুল হয়ে ছুটে চলেছেন। মা-টির কানে জবা ফুল গুঁজে তেপান্তরে ছেড়ে দিলে বাংলার উন্নতি ত্বরান্বিত হবে সন্দেহ নেই যেমন ঠিক, তেমনই আবার এই উত্তেজনাটা আমার ভালই লাগে। তবে বাঙালি বলেই বোধ হয় এমনকী ইসকুলে এক সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের জন্য ঘোষিত উনিশটা কমিটি তৈরি হলে অঘোষিত পঁচিশটা কমিটি রেডি হয়ে থাকে টিটকিরি দেওয়ার জন্য। ‘পরের বছর আমরা দেখিয়ে দেব’ হচ্ছে এদের পাঞ্চ লাইন। তার একটা কারণ বোধ হয়, এই যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাসের অনেকটাই সবটাই প্রায় ওর লেখা না পড়ে বছরে এক বার পুজো-প্যান্ডেলে কেবলমাত্র হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর কিশোরকুমারের গলায় তাঁর গান শোনা, এবং একটা বয়সের পরে অফিসের ব্যাগ বগলদাবা করে শেয়ালদা স্টেশনে দাঁড়িয়ে উনি ‘মহেশ’ নামক ছোট গল্পটি লিখেছিলেন না ‘ছুটি’, এই তর্কের একজিস্টেনশিয়াল মীমাংসায় সীমাবদ্ধ। আমাদের পাড়ার ইসকুলের হেডমাস্টারমশাই বিনয়বাবু নিজে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটা চটি বই ছাপিয়ে বের করেছিলেন। আবার বলি, সামান্য মাইনের চাকরিতে সংসার চালিয়ে, বড় ছেলের নাম রথীন্দ্রনাথ, ছোট ছেলের নাম সমীকেন্দ্রনাথ রেখে বাড়িতে কাকিমাকে সারা জীবন ঘটিহাতা ব্লাউজ পরিয়ে অকল্পনীয় কৃচ্ছ্রসাধনের পরেও এমন উৎসাহ দেখে ‘কেয়াবাত’ না বলে উপায় নেই। তবুও উনি আবেগমথিত কণ্ঠে যখনই ‘তোমরা ভেবে দেখো, উনি কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন, যে সময় ইলেকট্রিসিটি ছিল না, বাস-ট্রাম ছিল না, আনন্দবাজার ছিল না, সে যুগেও উনি কিন্তু নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন’ বলে হাল্কা ঠোঁট কাঁপিয়ে মাটির দিকে চেয়ে চশমার কাচ মুছতেন, আমাদের কেমন একটা খটকা লাগত।
আমাদের ক্লাসের সুমন্ত্র বরাবরের চুপচাপ ভাল মানুষ কারও সাতে-পাঁচে না থাকা বেচারা মার্কা ছেলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররা তো জমিদারির পয়সায় বড়লোক ছিলেনই, কিন্তু ওঁদের এত কাঁচা পয়সার আসল সোর্স যে মিষ্টি বিক্রি করে, সেটা কি জানতেন? রবীন্দ্রনাথের বাবার নাম ছিল দ্বারিকানাথ ঠাকুর, ওই নামেই মিষ্টির দোকান বড় রাস্তার ওপর এবং সারা দিন বিক্রি দেখলে মাথা ঘুরে যাবে ইত্যাদি ঐতিহাসিক কারণ ছাড়াও সামাজিক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা সুমন্ত্রর লেখা থেকেই প্রথম জানতে পারি। আপনারা ভাবছেন ফের সস্তা রসিকতায় বাজার মাত করার চেষ্টা করছি তা করছি সন্দেহ নেই, তবে এতেও সন্দেহ নেই যে, গত বেশ কিছু দশক আমাদের নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে উনি এই যে এত পপুলার কবি হয়ে উঠেছেন, তার ভিত্তি এই ধরনের কয়েকটি পাথ-ব্রেকিং ইনফরমেশন।
রবীন্দ্রনাথ প্রায় একা হাতে আমাদের জীবন, সাহিত্য, ছবি দেখার চোখ, রাজনীতি, স্বদেশ ও জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি বিষয়গুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ফান্ডামেন্টাল প্রেমাইসগুলোকে যেমন উল্টে পাল্টে দিয়েছিলেন, তেমনই আবার আমরা ‘সে যুগেও নোবেল’ পাওয়ার মতো অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা বা দ্বারিকের সন্দেশ ব্যবসার সঙ্গে ওঁদের পৈতৃক যোগাযোগ স্থাপিত করে ওঁকে সমকালের প্রয়োজন অনুযায়ী ছাঁচে ফেলে গড়েপিটে নিয়েছি।

গাঁধীরবিন্দিরানেতাজি
পোটো পাড়ায় যাদের নিত্য যাতায়াত, একটু খেয়াল করে দেখবেন এক সাইজের অনেকগুলো মাথার ছাঁচ সার দিয়ে রাখা থাকে পথের ধারে। বাবরি চুলে সাজিয়ে সেগুলো কখনও ইন্দিরা গাঁধী, মাথা ন্যাড়া করিয়ে গোঁফ আর চশমা পরালে গাঁধীজি, গোঁফ বাদ দিয়ে সবুজ টুপি পরিয়ে নেতাজি সুভাষ এবং ইয়া লম্বা দাড়ি আর বাবরি লাগিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে সেগুলোকে বছরের বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ বানানো হয়। আমাদের কাছে আসলে এই সব ক’টা আইকনই এক। যে কোনও কাজে এদের যাকে খুশি এমপ্লয় করে আমরা মহানন্দে থাকি। বিধানসভার মেম্বারদের দিয়ে সে সব অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন হয় বলে মূর্তির দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। জয়দেব এক বার রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যায় সাঙ্ঘাতিক একটা কারবার করেছিল। ‘দিকে দিকে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে’ দিয়ে কবিতা আবৃত্তি শুরু করে মাঝে মাঝে ‘প্রাসঙ্গিক ফাঁকে’ ও ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ ইত্যাদি ঢুকিয়ে এলাকায় হইচই ফেলে দেয়ে আমাদের আর ওই কবিতাগুলোর বাইরে বেরোনো হল না। যা-ই হোক, আমাদের লোকাল কাউন্সিলারের বাড়ি রংপুরে। ওঁর আত্মীয় এক বাংলাদেশি কবি সে সময় উপস্থিত থাকায় তাঁকেই সভাপতি করা হয়। জয়দেবের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কোনও তুলনা হয় না। ‘কাণ্ডারী বলো’-কে ও নিমেষে ‘‘ভাইজান বলো’ ডুবিছে মানুষ’’ বলায় হল ফেটে পড়ল হাততালিতে। জয়দেবের ভাইপোকে চুলদাড়ি লাগিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাজিয়ে আনা হয়েছিল ডুবে যাওয়ার আগে ‘মাসি মাসি’ বলে চিৎকার করার জন্য। সেটাও অনেক বার নানা ফাঁকে রিপিটেড হয়। স্টেজের ওপর সাড়ে তিন ফুট রবীন্দ্রনাথ কচি গলায় ‘মাসি’ আর্তনাদে পাড়া প্রকম্পিত করে তুলছে এমন শিহরন জাগানো দৃশ্য যারা দেখেননি, তাঁদের উদ্দেশে ‘আপনারা রবীন্দ্রনাথকে চিনলেন না’ ছাড়া আমার আর কিছুই বলার নেই। এত সব কিছুর পর যে আমি নিজে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে অনেক জানি, তা নয়। পাড়ায় বা কফি হাউসে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মোলাকাত সেই ছেলেবেলা থেকে। এঁরা প্রত্যেকে জীবনের নানা সময়ে নানা প্রক্রিয়ায়, সুকুমার রায়ের ভাষায় ‘স্টুপেন্ডাস অ্যামাউন্ট অব অ্যাস্টাউন্ডিং ইনফরমেশানস’ জোগাড় করে লোকজনের মধ্যে বিলিয়েছেন মনে রাখতে হবে সে সময় রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট ইত্যাদি কিছুই ছিল না। অতএব মাল চেপে রাখলেও পারতেন। বিমলবাবু এঁদের মধ্যে প্রথম সারির লোক। উনি না থাকলে আমরা জানতেই পারতাম না, প্রশান্ত নামে কে এক জন রবি ঠাকুরের হিসেবের খাতা দেখে দিত। ‘আরে প্রশান্ত না থাকলে উত্তরায়ণের জমির পিছন দিকের আমবাগান কেনার কথা রবিদা ভাবতেই পারতেন না। একটা একটা করে পয়সা বাঁচিয়ে প্রশান্ত ওই জমি কিনে দিয়েছিল।’ আমরা হাঁ করে শুনতাম।
বহু বছর বাদে সাহসে ভর করে এক দিন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘আচ্ছা, ওই প্রশান্ত লোকটা কে?’ উনি তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে বলেছিলেন, ‘আরে তোমরা যাকে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ বলো, আমি রবিদা, নন্দদা, রাম, আর দু’চার জন ওকে প্রশান্ত বলেই ডাকতাম। পটনার কাছে বাড়ি। বড়লোকের ছেলে। তা ওর বাপ এক দিন রবিদার পায়ে কেঁদে পড়ল গুরুদেব, আমার ছেলেটার কী হবে? আমি রবিদার কানে ফিসফিস করে বললেম, নিয়ে নিন, হিসেব রাখার জন্যও তো একটা লোকের দরকার। রবিদা কলমের এক খোঁচায় চাকরিতে বহাল করে নিলে। তার পর কী হল, সে তো তোমরা সবাই জানো।’ আমরা হতবাক। বিমলবাবু জীবনে না হোক শ’চারেক রবীন্দ্র-বিষয়ক বই লিখেছেন এবং সম্পূর্ণ বিনি পয়সায় জোর করে সেগুলো পরিচিতদের মধ্যে বিলিয়েছেন। সবচাইতে মারাত্মক ব্যাপার এই যে কয়েক জন সেগুলো মন দিয়ে পড়েওছে এবং ভাগ্নে-ভাইঝিদেরও পড়িয়ে ইসকুল কলেজের পরীক্ষায় সে থেকে রেফারেন্স টেনে উত্তর লিখিয়েছেন। এ নিয়ে অবিশ্যি কোনও প্রকার তর্ক উঠলে বাজারে চলতি রবীন্দ্রজীবনী এবং সাহিত্য বিষয়ক কয়েকটা বই ঘাঁটলেই সব সন্দেহের নিরসন সম্ভব। কমলদা যেমন নিয়ম করে দিয়েছেন, ওঁর বাড়িতে কেবল বাচ্চাদেরকেই নয়, অতিথি অভ্যাগতরা আসলেও ঠাকুর চাকরেরা পরিবেশন করার সময় পাতের ওপর লুচি দুলিয়ে জিজ্ঞেস করবে ‘আর একটা দেব কি?’ প্রাথমিক অস্বস্তি কাটলে পর আমাদের মতো নির্লজ্জ বেহায়া কেউ যদি এ হেন অতিথি সৎকারের ব্যবস্থা সম্বন্ধে প্রশ্ন করেন, কমলদার চটজলদি উত্তর, এটাই ঠাকুরবাড়ির ট্র্যাডিশন। এর মধ্যে যে বাঙালিত্ব লুকিয়ে আছে, যে সংযম-শিক্ষা, যে মানসিক স্থৈর্যের পরীক্ষা, যে আর্য সভ্যতার দিগ্বিদিকে আকুলিবিকুলি... ইত্যাদি ইত্যাদি। এর পর তো আর কিছুই বলার থাকতে পারে না। বলিয়ো না কিছু। এই নিয়েই আছি। রবীন্দ্রনাথও আছেন।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
First Page Rabibasariyo Golpo


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.