|
|
|
|
|
কারগিল থেকেই নাকি হাতে চাঁদ পাওয়া যাচ্ছে |
লাদাখের এ দিক ও দিকে ছড়িয়ে ইতিহাসের সত্যি গল্প, আর ভূগোলে পড়া আশ্চর্যরা।
যেমন লামায়ুরু গ্রাম। মানে চাঁদের দেশ। মায়াময় পরিবেশ। শান্তনু নন্দী |
কারগিল, দ্রাস, বাতালিক। ধারে কাছে ১৫ অগস্ট থাকুক, বা নাই থাকুক এ সব নাম শুনলেই শিরায়-উপশিরায় কেমন উত্তেজনা দৌড়ায়। একটা কষ্ট চিনচিন করে। নব্বই দশকের সেই ‘অপারেশন বিজয়’ স্মৃতিতে এখনও দগদগে। লাদাখ মালভূমির কারগিল রাজ্যটায় ঘুরতে-ফিরতে চোখে পড়ে শহিদস্মারকগুলো। এখন সেখানে দেশ-বিদেশি পর্যটকের ভারী রমরমা। তারাও যখন এ সব যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর আশপাশে দাঁড়িয়ে অগুনতি শাটার টেপে, কেমন যেন একটু চুপসে পড়ে। সত্যি, মনটা এত ভারী হয়ে যায় না এখানে...
ব্যথাটা ভুলতে শিগগির জায়গাটা ছেড়ে আসতে হয়। শ্রীনগর-কারগিল রোড সোজা চলে গিয়েছে লেহ্-র দিকে। রাস্তায় পড়বে লামায়ুরু গ্রাম। আর সে নাকি ভারী এক দেখার জিনিস। |
|
কারগিল থেকে লামায়ুরু যেতে সবাই থামে ‘মুলবেক চাম্বা’য়। সামনেই দাঁড়িয়ে এক বিশাল বুদ্ধমূর্তি। প্রায় ৯ মিটার লম্বা। আফগানিস্তানের বামিয়ানের অতিকায় বুদ্ধ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর এই মূর্তিই এখন পৃথিবীর বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তি। আয়তনেই শুধু বিশাল নয়, আকৃতিও একেবারে অন্য রকম। ভগবান বুদ্ধের এই চতুর্ভুজ চেহারা বড় একটা দেখা যায় না। এটি নাকি মৈত্রেয় বুদ্ধমূর্তি, নাম ভবিষ্যবুদ্ধ। বুদ্ধদেবের মাথা থেকে কাঁধ অবধি নেমেছে জটা। ঠাওর করলে বোঝা যায় গলায়, কোমরে, মণিবন্ধে রুদ্রাক্ষের মালা। বাঁ হাতে রয়েছে একটা কমণ্ডলু। মূর্তিটি বুদ্ধ ও শিবের সংমিশ্রণ। শুধু শিল্প-ভাস্কর্যেই নয়, এই অঞ্চলের জনজীবনেও মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যায়। ম্যাপ অনুযায়ী কারগিল থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে এই মুলবেক। ঠিক এখানেই নাকি পশ্চিম লাদাখ আর পূর্ব লাদাখের সীমানা। লাদাখের পশ্চিমাঞ্চল মুসলিম অধ্যুষিত আর পূর্ব লাদাখের জনজাতি মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
বিখ্যাত পরিব্রাজক রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখায় এই রাস্তার কথা পাওয়া যায়। আছে এই বুদ্ধমূর্তির প্রসঙ্গও। রাহুল নাকি দু’বার এই অঞ্চলে এসেছিলেন। ১৯২৬-এ ও ১৯৩৩-এ। তখন অঞ্চলের মিশ্র সংস্কৃতি তাঁরও চোখে পড়েছিল। তিনি লক্ষ করেছিলেন একই পরিবারের ঠাকুমা-দিদিমারা হয়তো বুদ্ধের উপাসক। কিন্তু নতুন প্রজন্ম ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে।
এ ছাড়া মুলবেকে আছে বিখ্যাত দু’টি গুম্ফা। পুরনো তো বটেই। বেশ ইতিহাস ইতিহাস দেখতে। মঠ দু’টিকে এক সঙ্গে মুলবেক গোম্পা বলা হয়। এ জায়গার খুব কাছ দিয়ে বইছে ওয়াখা নদী। |
|
লামায়ুরু মনাস্ট্রি |
মুলবেক থেকে লামায়ুরু যাওয়ার পথে দু’টো গিরিপথ পেরোতে হয়। প্রথমটি নামিকালা পাস। উচ্চতা প্রায় ১২, ২০০ ফুট। অন্যটি ফাতুলা পাস। এটি প্রায় ১৩, ৫০০ ফুট উঁচু। এই পথে উঠে এলেই এক সময় দেখা যায় দূরে একটা ছোট্ট গ্রাম। তার জমিটায় অদ্ভুত হলদেটে আভা। ওইটাই লামায়ুরু।
দুটো পাস থেকেই নামতে হয় পাহাড়িয়া ঘূর্ণি পথে। দুই ধারে কাশ্মীরের কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া দৃশ্যাবলি। আশেপাশে সবুজ নেই বললেই চলে। শীতের দেশ হলেও লাদাখ তো আসলে ঊষর মালভূমি। তাই এমন রুখাশুখা দেখতে। কিন্তু অসুন্দর নয় মোটে। চোখের সামনে থাকা পাহাড়গুলো তো প্রতি মুহূর্তে রং বদলাচ্ছে। নীলচে, গোলাপি, মরচে ধরা খয়েরি, হলুদ আর কখনও সখনও সবুজ। তবে দূরের পাহাড়গুলো সব ক’টা বরফঢাকা।
আস্তে আস্তে কাছে এসে যায় লামায়ুরু। ইংরেজি মানে মুন ল্যান্ড। হলই বা কাশ্মীর, হঠাৎ এ পৃথিবীর এক টুকরো জমিকে চাঁদের দেশ নাম দেওয়া হল কেন, জানতে কৌতূহল হচ্ছে নিশ্চয়ই? লামায়ুরু এলেই ধাঁধাটা পরিষ্কার হয়ে যায়। এর জমিটা একটু ঢেউ খেলানো, আর হালকা হলুদ রঙের। ভারী মায়াবি দেখতে। ছবিতে দেখা চাঁদের মাটির সঙ্গে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে বইকী।
|
|
লামায়ুরু গ্রাম |
কী করে হল এমনটা? এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন। সিন্ধু নদের বুকে শুকিয়ে আসা এক হ্রদ, ক্ষয় হতে হতে এই রকম চেহারা নিয়েছে। লামায়ুরু উপত্যকা সৃষ্টির ভৌগোলিক কারণও পাওয়া যায়। আজ থেকে প্রায় ৩৫,০০০ বছর আগে সিন্ধু নদ এই অঞ্চল দিয়েই বইত। তার পর কোনও এক কারণে নদের জল ওখানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কুড়ি বছর পরে আবার প্রকৃতির কী খেয়াল হয়, বাধাটা যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনই হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। জল আবার সিন্ধু নদে গিয়ে মেশে। ওখানে পড়ে থাকে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ কাদা। তারই রং ওরকম চাঁদ মাটির মতো হলদেটে।
লামায়ুরুতে গিয়ে শুধু মাটি পরীক্ষা করে বেড়াতে হবে, এমনটা ভাববেন না যেন। এখানেই আছে লাদাখের সব থেকে পুরনো গুম্ফা। বয়স? তা ধরুন প্রায় হাজার খানেক বছর তো হবেই। এই গুম্ফার দেওয়ালগুলোর নাম উংদ্রুম। এই শব্দের মানে মণিপ্রাচীর। এই দেওয়ালগুলো শুধুই আশ্চর্যসুন্দর স্থাপত্য নিদর্শন নয়, এদের অন্য একটি বিশেষত্বও রয়েছে। পার্বত্য এলাকা থেকে আসা বরফঠান্ডা হাওয়া এদের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফেরত চলে যায়। গুম্ফা আর ছোট্ট জনপদ লামায়ুরুকে কনকনে শীতের হাত থেকে রেহাই দিচ্ছে এরা।
গুম্ফার ভেতর কোথাও গা ছমছমে আলো আঁধারি, কোথাও পতাকা-ঘণ্টায় রংচঙে ঝলমলে উপাসনাঘর। ঢুকতেই দেখা যায় বিশাল একটা প্রার্থনাচক্র। পুরো গুম্ফাটায় প্রচুর কক্ষ। প্রধান মন্দির কক্ষটি দুখাং নামে পরিচিত। কক্ষগুলিতে অগণিত মূর্তি। ভগবান বুদ্ধ, অতীশ দীপঙ্কর, পদ্মসম্ভব, ধর্মপাল, মহাকাল, অবলোকিতাশ্বর কে নেই? আর অজস্র পুঁথি। লাল কাপড়ে মোড়া, খুব যত্ন করে রাখা। ভিক্ষুদের শ্রদ্ধা-ভক্তি-আন্তরিকতা মুগ্ধ করে দেয়, আর অবাক হতে হয় তাঁদের পাণ্ডিত্যে। খুদে ভিক্ষুরা ন্যাড়ামাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছে, কচি গলার মন্ত্রোচ্চারণে চমৎকার এক আবহের সৃষ্টি হয়েছে।
|
|
মুলবেক চাম্বার ভবিষ্যবুদ্ধ |
এখান থেকে পথ চলে গেছে খালসে-র দিকে। সেখান থেকে লেহ্ যাওয়া যায়। যাত্রাপথে আবার সেই রূপসী লাদাখ। নির্জন, নিরালা, শান্ত। সবুজ চোখে পড়ে না প্রায়। সবুজ দেখলে বুঝতে হবে ওখানে মানুষ থাকে। তারাই কৃত্রিম উপায়ে চাষ-বাসের জমি সাজিয়েছে। হেলিকপ্টার থেকে বীজ ফেলে তবে চাষের ব্যবস্থা করা যায় ওখানে। হুহু হাওয়া, উড়ে আসে বরফের কুঁচিও। ওই জন্যই পাহাড়ের গায়ে এত এত ক্ষয়চিহ্ন। সেই যে ভূগোলের বইতে ছিল না? বায়ু ও তুষার দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত ভূপ্রকৃতি? সেই সব বর্ণনার হাজারো উদাহরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এ রাস্তায়। লোকে সেই সব আকারে খুঁজে পেয়েছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিখ্যাত সব স্থাপত্যকীর্তির সাদৃশ্য। ‘দেখ, দেখ, ঠিক যেন জয়পুরের হাওয়ামহল।’ এ রকম মন্তব্য প্রায়ই ভেসে আসে কানে।
ছোট্ট গ্রাম লামায়ুরু। পড়ে থাকে অনেক পেছনে। শহুরে সভ্যতা এখন পৌঁছায়নি সেখানে, মোবাইল কাজ করে না, ঘিঞ্জি দোকান চোখে পড়ে না। মানুষজনও অল্প, সরল-সিধে জীবন তাদের। তবে দু’একটা থাকার হোটেল হয়েছে ইদানীং। সেখানে এক রাত থাকলে তেমন কষ্ট বোধ হয় আপনার হবে না। তাই তো বলছিলাম, একটু সময় করে চাঁদের দেশটা এক বার দেখেই আসুন না। |
লামায়ুরুর ছবি তুলেছেন লেখক। |
|
|
|
|
|