|
|
|
|
উদাস, বিরহ, রুপোলি আঁধার মেঘমল্লারে |
জেনানার মিঠি আওয়াজে চাঁদনি খুলে যেতে পারে, ফুল ফুটতে পারে, কোয়েলও কুহক দিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বর্খার ঘটাকারি,
তার রোম-ঝোম্, তার মেঘগর্জন, ফলাও করতে গেলে চাই সুর, মেজাজ, আর পুরুষের তৈয়ারি গলা। শঙ্করলাল ভট্টাচার্য |
মেঘমল্লার।
এই যে কথাটা উচ্চারণ করলাম তাতে কি শুধুই একটা রাগের নাম এল? সঙ্গে করে একটা ঋতুর আভাস? কিছুটা অন্ধকার ঘনিয়ে আসা,
আর বৃষ্টি?
ভৈরবী কি শুধুই উদাস ভোর? দরবারি কানাড়া রাজার অশ্রুপাত?
এই তিনের সঙ্গে যোগ করুন আরও তিন ললিত, বিভাস, বসন্ত যারা শব্দ থেকে রাগের নাম হয়ে ক্রমে এক একটা প্রতীক হয়ে গেছে, মানুষের জীবনরহস্যের ইঙ্গিত। এর মধ্যে মেঘমল্লার আর একটু এগিয়ে, কারণ এটি প্রায় এক স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতার মতো, ধ্বনি ও অক্ষরের গড়নে, যাতে মেঘগর্জন, বারিধারা, বিজলিচমক, রুপোলি আঁধার, বিরহ, হয়তো আনন্দ, এবং প্রেম ছেয়ে আছে। এ সব ব্যাখ্যা করতে হলে অনেক গল্প শোনাতে হবে। আমার পাশে এল পি ডিস্কে ভীমসেন জোশী এখন তিন তালে নিবদ্ধ ছায়ামল্লার গাইছেন, শুনেই যাচ্ছি, কিন্তু
গল্পও বলব।
মেঘমল্লার কেন এক শব্দের কবিতা? কবি ডবলিউ বি ইয়েটসকে ডাক্তার বললেন, ‘আপনার যেটা হয়েছে তাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে আর্টেরিয়ো স্ক্লেরোসিস অব দ্য হার্ট। অর্থাৎ ...’ ‘দাঁড়াও! দাঁড়াও’! বলে ওঁকে কথার মধ্যে আটকে দিলেন কবি, তার পর স্বপ্নিল চোখে কবিতা উচ্চারণের মতো করে বললেন, ‘এ তো কবিতার মতো শোনাচ্ছে... আর্টেরিয়ো স্ক্লেরোসিস অব দ্য হার্ট!... আমার তো এই রোগেই মৃত্যু হওয়া চাই।’জ্যঁ পল সার্ত্র মারা গেছেন প্যারিসে। আদিগন্তহীন শোকমিছিল তাঁর দেহ নিয়ে যাত্রা করেছে এক বর্ষণমুখর দ্বিপ্রহরে সমাধিক্ষেত্রের দিকে। আমি আমাদের সাংবাদিক শিক্ষাকেন্দ্রের এক ঘরে বসে চোখে জল নিয়ে জানলার বাইরে রুপোলি আকাশ, মেঘ আর বৃষ্টি দেখছি। হঠাৎ কখন মেঘমল্লারের মতো মনের মধ্যে ভেসে এল পল ভের্লেন-এর সেই অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তিগুলো
|
|
‘দেয়ার ইজ উইপিং ইন মাই হার্ট
অ্যাজ ইট রেনজ অন দ্য টাউন।
হোয়াট ল্যাংগর ইজ দিস
দ্যাট পিয়ার্সেস মাই হার্ট?’
‘শহর জুড়ে বৃষ্টি পড়ে,
বুকের মধ্যে কান্না ঝরে।
এ কোন ব্যথা, চিনি না তো
হৃদয়টাকে ছিন্ন করে?’ |
|
এই যে দুপুরটার কথা বললাম, এ-ও এক মেঘমল্লার। কারণ সে দিন থেকে একটা ভাবনায় পড়েছিলাম। পশ্চিমী দেশে শুধু চার ঋতুর কথাই বলে কেন? বসন্ত, গ্রীষ্ম, শীত, হেমন্ত আছে, সেই ঋতু নিয়ে কী অপূর্ব নির্মাণ আন্তোনিয়ো ভিভালদি’র ‘ফোর সিজনজ’, কিন্তু বর্ষা নেই কেন? সারা বছর কখনও না কখনও বৃষ্টি হয়েই চলেছে বলেই কি বৃষ্টির আবাহন নেই? আর আমাদের এই নিত্য বানভাসির দেশে মেঘ ও বর্ষার কী প্রমত্ত উপাসনা! পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে তাঁর বেদতুল্য ‘হিন্দুস্থানী সংগীত পদ্ধতি’র দ্বাদশ ও শেষ খণ্ডে নয় প্রকার মল্লারের স্বরলিপি ও গান রেখেছেন। সেখানে মেঘমল্লারের গানের সংখ্যা সর্বাধিক এগারো। আর গ্রন্থের নবম খণ্ডে উল্লেখিত ও বিন্যস্ত গৌড় মল্লার ও মিঞা মল্লারের গানের সংখ্যা যথাক্রমে পঁচিশ ও ছাব্বিশ। রবীন্দ্রসংগীতে বর্ষার গানের প্রাচুর্যের মতো ভাতখণ্ডেজি সঙ্কলিত রাগরাগিণীর বিপুল পরিবারে মল্লারে বাঁধা গানের এই প্রাধান্য কি একটা কোনও বার্তা পাঠায় না শ্রোতাকে? রবীন্দ্রনাথ জীবনের প্রথম চল্লিশ বছরে ঋতুসংগীত রচনা করেছেন সংখ্যায় কম, কিন্তু তার মধ্যেও বেশিটাই (৭) বর্ষা নিয়ে আর তার সবই মল্লারের ঘরের। পরের চল্লিশ বছরে ঋতুসংগীত লিখলেন অনেক এবং সেখানেও বর্ষার গানের প্রাধান্য, প্রয়োজনে নিজের মতো করে নিলেন মল্লারকে, যেমন রবিমল্লার, এবং এক সময় ইমন, ইমনকল্যাণ, সিন্ধু, সিন্ধুকাফি, ভূপালি, বেহাগ, ভৈরবীও জুড়ে গেল বর্ষায়। কিন্তু এই সব মিলেই সুরদাসী মল্লার, রামদাসী মল্লার, মীরাবাই কি মল্লার থেকে মিঞাঁ কি মল্লার হয়ে রবিমল্লার তথা সমুদয় রবীন্দ্রবর্ষাগীতি যে এক অপরূপ, প্রায়-অলৌকিক প্রতীক তৈরি হয় তা আমার কাছে (শুধু আমার কাছে কেন? বলি না সব বাঙালির কাছে?) ওই একটি শব্দের কবিতাতে ধরা মেঘমল্লার! |
|
এই মুহূর্তে আমি ভীমসেনের ছায়ামল্লারের এল পি তুলে রাশিদ খানের সিডি চালালাম। তাতে বাজছে একতাল বিলম্বিত বন্দিশে মেঘমল্লার। আর মগজে ভিড় করে আসছে বহু দিন আগের এক গল্প মল্লার নিয়ে, যেখানে গায়ক হলেন রাগটির অলোকসামান্য রূপকার উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, তার বিবরণ দিচ্ছেন সে কালের এক দুর্ধর্ষ সমঝদার তন্নুলালজি, আর সেই সুধারস আমরা পাচ্ছি অমিয়নাথ স্যানালের অমর লেখনীতে। ‘স্মৃতির অতলে’ বইয়ের সেই মল্লারকথা এ বার শুনুন...
‘‘যাই বলুন, পাঁচুবাবু! জেনানার মিঠি আওয়াজে চাঁদনি খুলে যেতে পারে, ফুল ফুটতে পারে, কোয়েলও কুহক দিয়ে যেতে পারে, সব স্বীকার। কিন্তু বর্খার ঘটাকারি, তার রোম-ঝোম্, তার মেঘগর্জন, এ সব ফলাও করতে গেলে চাই সুর আর মেজাজ, আর পুরুষের তৈয়ারি গলা। আর পুরুষের গলা ত চাই ঐ ফৈয়াজের মত’, বলে থামলেন তন্নুলালাজি।...
“পরে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন আমাকে ‘কতো রকমের মল্লারের খবর রাখেন?’... ‘আরে না, না। আপনার রামদাসী, হরদাসী, সুরট-রূপমঞ্জরী ওগায়রা নামটাম রেখে দিন। শুনুন তবে। |
|
“মল্লারের কতকগুলিতে পাবেন হাওয়া আর ঝড়-তুফানের সুম্ সনন। বারিস (বর্ষণ) পাবেন খুব কম। কতকগুলিতে পাবেন বর্খার রুম ঝুম্ আর মৌরের বোল্ আর দাদরের শোর্, খাস করে। আর কতকগুলিতে পাবেন ভিজা, ঠাণ্ডা হাওয়ার মধুরাই, আর শুনবেন ছোটো বড়ো বুন্দের (ফোঁটার) টপক্। আর কতকগুলিতে পাবেন আপনি মেঘের ঘটাকারি, বিজলির চমক্, আর করক্ আর গড়গড়াহট্ (গড়গড়ধ্বনি)। বরখা পাবেন ত অল্প, অত্তচক্ থেকে থেকে হঠাৎ। এসব হল অনুভবের সাক্ষাৎ চমৎকারী, কাব্য নয়, কল্পনা নয়। আর একমাত্র পয়লা দরজার (শ্রেণির) গুণীরাই এসব প্রত্যক্ষ করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। ......আপনার মিঞাঁকি মল্লার হল ঐ শেষ রকমের মল্লার। এর ইলম্ (বিদ্যাসিদ্ধি) বড় কঠিন। আর খাস এক রকমের গলাতেই এর শোভা, এর হুনর্মন্দি (কারুমূর্তি) জাহির হতে পারে, সব গলায় নয়।”
মল্লার প্রসঙ্গ থেকে ফেরা যাক মেঘমল্লারে। খুবই প্রাচীন রাগ, বর্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত গভীর, গম্ভীর রাগ, মধ্যরাত্রির লগ্নে গেয় ও |
|
বাদ্য। এর গাম্ভীর্যই একে পরিণত বর্ষার, গহনঘন বর্ষার, শেষ আষাঢ় ও শ্রাবণের রাগ করে তুলে ধরেছে। তুলনায় মিঞাঁকি মল্লার ও আরও নানান মল্লার বর্ষার আগমনে রাগ, দাবদাহ থেকে স্বস্তির রাগ, প্রথম আষাঢ় ও কিছুটা প্রথম কদম ফুলের রাগ। রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানে এত আনন্দ, এত মুখর বাদল দিন এই কারণেই।
আর রাশিদের মেঘমল্লার শুনে যে এত ভার জমছে মনে, তার কারণ এর তীব্র বিরহ রস, নায়িকার একাকিত্ব, প্রকৃতির তাণ্ডবে তার গেয়ে ওঠা
‘পিয়া নহি ঘর, সজনি
রায়ানা অন্ধেরি, ডর মোহে লগে
বাদল গরজে, বিজরি চমকে
মেঘা বরসে, অতি ডরাবে।’ |
|
বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ভাতখণ্ডেজি মন্তব্য করেছিলেন যে মেঘমল্লার সাংঘাতিক কঠিন কিছু রাগ না হলেও ওই সময় খুব শিল্পী এই রাগ জানতেন বা গাইতেন। তবে সেই থেকে এ রাগের প্রচলন দারুণ বেড়েছে। দক্ষিণী পণ্ডিত সুব্বা রাও মনে করেছেন মেঘ এবং মেঘমল্লার আদতে একই রাগ, দুই নামে। ভাতখণ্ডে মেঘমল্লারকে মল্লারেরই এক প্রকার বলেছেন।
তবে যে নামেই ডাকুন, গোলাপ তো গোলাপই। আন্দোলিত কোমল গান্ধারে আপনি মল্লার অর্পণ করলেন কি না ঔড়ব মেঘে ( স র ম প ন), তার বিচার করুন পণ্ডিতে, কিন্তু মেঘমল্লারের বিপুল তরঙ্গ থেকে বঞ্চিত হবে কেন প্রেমিক শ্রোতা। আজ হাওয়া দম ধরেছে, জল নামেনি, কিন্তু আমি মেঘমল্লার শুনছি। বৃষ্টি নামুক, না-নামুক, আজ বর্ষা। কারণ আমার ঘরে এখন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মেঘমল্লার।
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
|
|
|
|
|