আমার কলকাতা
গানের ভিতর দিয়ে...
শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক কাজের জন্য এ শহরে মাঝেমাঝে আসতাম। চাকরিসূত্রে পাকাপাকি ভাবে এসে পড়লাম ১৯৬৫ সালে।
এই শহর, আমার সেই আঠাশ বছর বয়সে নতুন এক শহর। প্রথম দিনই কর্মস্থলে গিয়ে বুক পকেটে হাত দিয়ে দেখি আমার ফাউন্টেন পেনটি নেই। পর পর দু’দিন চুরি গেল আমার অত্যন্ত প্রিয় দু’টি পেন।
চাকরি করতাম জোড়াসাঁকোর বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগে। পাকাপাকি বসতির জন্য বাড়ি খোঁজা শুরু হল। থাকতে শুরু করলাম পাম অ্যাভিনিউতে। দু’কামরার ঘর থেকে প্রতি দিন জোড়াসাঁকো যেতে যেতে দেখলাম উত্তর কলকাতা থেকে দক্ষিণ কলকাতার পরিবর্তন। তার বছর তিনেক আগে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন হয়েছিল। কাজে যোগ দিয়েছি ওই বাড়িতেই। তখনও বিচিত্রা ভবনে বইয়ের গুদাম ছিল, পরে সেটাও সরে গেল। একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠতে দেখলাম।
কলকাতার রূপ বদলাতে লাগল। সবুজ ক্রমে ফিকে হল। এখন আকাশমুখী বড় বড় অফিসবাড়ি আর মল। একটু আকাশ দেখতে পেলে মনে পড়ে উত্তর কলকাতার রবীন্দ্রমেলার কথা। টানা দশ দিন সেই উৎসব চলত। শহরে তখন নানা সময় নানা অনুষ্ঠান। তবে গানের অনুষ্ঠানই বেশি। সেকি উন্মাদনা। গ্রীষ্মে রবীন্দ্র-উৎসব, পুজোয় আধুনিক আর শীতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর। ষাটের দশকের পরে কলকাতায় সঙ্গীতানুষ্ঠান বেড়ে চলল। ক্রমে কলকাতা হয়ে উঠল সংস্কৃতির পীঠস্থান। বাইরের বহু শিল্পী এই কলকাতায় অনুষ্ঠান করে নিজেকে ধন্য মনে করতেন।
গানের পিছনে ছুটে বেড়ানো আমার একটা নেশা। এক দিকে দেবব্রত-হেমন্ত, সুচিত্রা-কণিকা, সাগর-অর্ঘ্য’র গান শুনছি। অন্য দিকে পুজোর সময় বিশেষ করে উত্তর কলকাতায় মিলনোৎসবে বাদ পড়ত না হেমন্ত-দ্বিজেন-ধনঞ্জয়-জগন্ময় মিত্রদের মতো জনপ্রিয় শিল্পীদের অনুষ্ঠানও। কলকাতার কত রাতে আমি শুনেছি বড়ে গোলাম আলি খান, গিরিজাদেবীর কণ্ঠসঙ্গীত, আল্লারাখা, রবিশঙ্কর, আলি আকবরের যন্ত্রসঙ্গীত। পরে শরীরের জন্য আর পেরে উঠিনি।
আজ মনে হয় আমার জীবনটা গড়ে দিয়েছে এই কলকাতা। পরকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা বোধ হয় এই কলকাতাই রাখে। তার উদাহরণ আমার কর্মস্থল। আমার কাজ ছিল স্বরলিপির প্রুফ দেখা। সহকর্মী হিসেবে পাশে পেলাম প্রফুল্লকুমার দাসকে। প্রুফ দেখার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ও তাঁকে নিয়ে নানা বইয়ের আলোচনা। এক চর্চার মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকলাম। স্বরলিপির কাজ করতে গিয়ে এক এক সময় গানে সঞ্চারী বুঝতে পারতাম না। আমাকে বোঝানোর জন্য সহকর্মীদের মধ্যে আলোচনা বসত। এমনই এক দিন সেখানে এলেন শঙ্খ ঘোষ। তাঁকে ব্যাপারটা জানালাম। কিছু দিন পরে একটি দৈনিকে সেই বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখে কাগজখানি পাঠিয়ে দিলেন আমার কাছে। সে কথা ভুলি কী করে? সহকর্মী হিসেবে সুবিমল লাহিড়ী ও পরে অমিত সেন, অরুণ দে এবং বাংলা গানের জগতে রাজ্যেশ্বর মিত্রের সান্নিধ্যলাভ বড় ভাগ্যের বলে মনে হয়। আর আছেন সাগরময় ঘোষ। সাগরদাই আমাকে ‘দেশ’ পত্রিকায় সঙ্গীত সমালোচনা করতে বাধ্য করান। অনেক লেখাও লিখিয়েছেন আমাকে দিয়ে। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ‘তহজীব-এ মৌহসিকি’ গ্রন্থটি অনুলিখন করি এই কলকাতায় বসে।
কলকাতা এমন একটা শহর যেখানে আজও শুনি খুব স্বল্প টাকায় দিন-রাতের আহার মেলে। আজ থেকে অনেক বছর আগে তা টের পেয়েছিলাম আমিও। বিশ্বভারতীতে আমার বেতন ছিল খুবই স্বল্প। তবু অসুবিধে তেমন হয়নি।
ছাত্রাবস্থায় অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রনাথ পালিত, ভি ভি ওয়াঝলওয়ার, শৈলজারঞ্জন মজুমদারদের মতো শিক্ষক পেয়েছিলাম। তাঁদের আদর্শ আজও মেনে চলি। পাশাপাশি এই শহরে আরও এক চিত্র দেখেছি টিউশনের ব্যাপারে। আমার মেয়েকে পড়ানোর জন্য এক শিক্ষকের কাছে গিয়েছি। দরজার বাইরে থেকে শুনতে পাচ্ছি ঘণ্টা-পিছু টাকার অঙ্ক। মেয়ের এক ঘণ্টাই দরকার ছিল। কিন্তু ওই শিক্ষককে দেখেছিলাম, কোনও দিন ঊনষাট মিনিট পড়াননি। পেশাদারিত্ব কাকে বলে, এ-ও দেখেছি কলকাতায়। এ-ও এক শিক্ষা।
আমার স্ত্রী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রপ্রৌত্রী সুপূর্ণা ঠাকুর, আমি, ও সঙ্গীতভবনের জয়শ্রী রায় সঙ্গীতশিক্ষার জন্য ‘ইন্দিরা’ প্রতিষ্ঠা করলাম ১৯৬৬-তে। সাহায্য করলেন উমা সেহানবীশ। নামাঙ্কন করলেন সত্যজিৎ রায়। এই মানুষটিকে পাশে পাওয়া আমার জীবনে এক পরম পাওয়া। আমি এক নতুন জগতের সন্ধান পেলাম। সে বড় আনন্দের দিন ছিল। আমাদের আড্ডা বসত ‘ইন্দিরা’তে, শুক্রবার। সে দিন নতুন গান তোলার দিন। পরে তেলেভাজা-মুড়ি খেতে খেতে একে অন্যের সুখ-দুঃখের কথা শোনা।
কলকাতায় এসে যে পরিবেশ, পরিমণ্ডল পেয়েছিলাম তা চোখের সামনে কেমন আস্তে আস্তে বদলে গেল। সেই আনন্দ যে কোথায় উধাও হল! মানুষ দেখতে দেখতে কেমন স্বার্থপর হয়ে গেল। ভালবাসাও কি উধাও হল!
Previous Item

Kolkata

Next Item




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.