ব্যাগ গুছিয়ে...

ডাকছে কাঞ্চনজঙ্ঘা
হাত বাড়ালেই সান্দাকফু!
পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ সান্দাকফু, উচ্চতা ৩৬৩৬ মিটার। বরফে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ বেশ কিছু নামী-অনামী শৃঙ্গকে দেখতে দেখতে মাত্র তিন দিনের হাঁটাপথে প্রায় ৩২ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় পাহাড়চুড়োয়। মানেভঞ্জন থেকে প্রায় ১৫০০ মিটার উপরে উঠতে হবে তিন দিনে। তবে সান্দাকফু যাওয়ার জন্য মানেভঞ্জন থেকে গাড়িও পাওয়া যায়। পায়ে হেঁটে যাওয়া-আসা মিলিয়ে ৫৪ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে হবে, সে ক্ষেত্রে সময় লাগবে চার-পাঁচ দিন। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন বা শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছতে হবে শৈলশহর মানেভঞ্জনে। শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে মানেভঞ্জন যাওয়ার জন্য বাসও পাওয়া যায়, দিনে মাত্র দু’বার যাতায়াত করে এবং যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ।
মানেভঞ্জনে এক রাত কাটিয়ে সান্দাকফু যাওয়ার গাইড জোগাড় করে আগামী দিনের পথের হদিস জেনে নেওয়ার সঙ্গেই পাহাড়ি আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার কাজটাও সেরে ফেলা চাই। এখানে থাকার জন্য অনেক ট্রেকার্স হাট আছে, জনপ্রতি ৮০ থেকে ১০০ টাকায় থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। পর দিন সকালে স্থানীয় গাইডকে সঙ্গে নিয়ে শুরু পথচলা। প্রথম দিনই প্রায় ১১ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হবে টংলু অথবা টুমলিংয়ে। টংলুর উচ্চতা ৩০৭০ মিটার। বেশির ভাগ পযটক টংলুতেই থাকেন, কারণ আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের তুষারাবৃত পর্বতচূড়াগুলি এক জায়গায় দাঁড়িয়েই দেখা যায়।
মানেভঞ্জন থেকে হাঁটা শুরু করে প্রথম ২ কিমি চড়াই রাস্তা অতিক্রম করে ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম চিত্রেতে পৌঁছে খানিক বিশ্রাম। হাতে গোনা কয়েক ঘর মানুষের বাস এই গ্রামে। দেখা মিলবে একটি পুরনো ও সুসজ্জিত বৌদ্ধ মনাস্ট্রির। এই গ্রামে চা খেতে ভুলবেন না। গ্রামের যে-কোনও বাড়িতেই চমরিগাই (ইয়াক)-এর দুধে বানানো চায়ের স্বাদ ভুলতে পারবেন না। আবার পাড়ি দেওয়া মেঘমার দিকে। ৭ কিলোমিটার চড়াই-উতরাই রাস্তা শেষে পৌঁছবেন মেঘেদের রাজ্য মেঘমায়। এখানকার বাসিন্দারা সূর্যকে শেষ কবে দেখেছেন তা হয়তো তাঁদের মনে নেই। সারা দিন মেঘাচ্ছন্ন থাকে বলে এই জায়গার নাম মেঘমা।
মেঘমা থেকে দু’টি রাস্তা চলে গিয়েছে দু’দিকে। সামনের দিকে রাস্তা গিয়েছে টংলুর দিকে। বাঁ দিকের আর একটি রাস্তা গিয়েছে টুমলিংয়ের দিকে, যা অপেক্ষাকৃত সহজ পথ। দু’জায়গাতেই থাকার জন্য দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল-এর ট্রেকার্স হাট আছে। টংলু থেকে পূর্ণিমার রাতে বা দু’-এক দিন আগে-পরে আকাশ পরিষ্কার থাকলে রাতেই বরফে মোড়া পর্বতচূড়ার হাতছানি আগামী দিনের যাত্রার মনোবল কিছুটা বাড়িয়ে দেবেই। ট্রেকার্স হাটের পিছনে পাহাড়ের ঢিবি থেকে সূর্যোদয় দেখতে ভুলবেন না। এখান থেকে ১৩ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হবে কালিপোখরিতে।
এই রাস্তায় সিঙ্গালিলা জঙ্গল অতিক্রম করে পৌঁছতে হবে গৌরীবাসে। দেখা পেতে পারেন কিছু পাখি, বনমুরগির দল, এমনকী, রেড পন্ডারও। গৌরীবাস পৌঁছতে সময় লাগবে আড়াই-তিন ঘণ্টা। গৌরীবাস যাওয়ার আরও একটি রাস্তা জঙ্গলের চেকপোস্ট থেকে বাঁ দিকে চলে গিয়েছে। গৌরীবাস থেকে কালিপোখরি যাওয়ারও দু’টি রাস্তা আছে। গৌরীবাস থেকে সোজা রাস্তা গৌরীবাস টপ অতিক্রম করে কালিপোখরি পৌঁছতে সময় কম লাগলেও পুরো রাস্তাই চড়াই ভাঙার কারণে কষ্ট বেশি। অন্য একটি রাস্তায় পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে একটু ঘুরপথে সময় বেশি লাগলেও পথটি অসমান না হওয়ায় কষ্ট কম আর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতে কালিপোখরি পৌঁছনোর অভিজ্ঞতাই আলাদা। কালিপোখরি একটি ছোট্ট গ্রাম, যা অবস্থিত নেপালে।
স্থানীয় একটি পুকুরের জলের রং কালো হওয়ায় এবং স্থানীয় ভাষায় পুকুরকে ‘পোখরি’ বলার কারণে এই জায়গার এমন নামকরণ। কালিপোখরিতে রাত কাটিয়ে পরের দিন সকালে কালিপোখরিকে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চলা মূল গন্তব্য সান্দাকফুর উদ্দেশে। কালিপোখরি থেকে ২ কিলোমিটার রাস্তা কখনও ঝরনা পার করে, কখনও রডোডেনড্রন গাছের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে পৌঁছতে হবে ভিকেভঞ্জনে। ফেব্রুয়ারির পর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পুরো পথেই দেখা মিলবে লাল সাদা গোলাপি-সহ রংবেরঙের রডোডেনড্রন ফুলের। ভিকেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু পৌঁছনোর শেষ ৬ কিলোমিটার রাস্তার পুরোটাই খাড়াই। তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টা পর এক সময় যখন পা আর চলতে চাইছে না, তখনই পাইনের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের বাঁ দিকে বাঁক শেষ করতেই চোখে পড়বে নীল আকাশের নীচে এক খোলা ময়দান, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু বাড়িঘর। আর ডান দিকে তাকালেই বরফে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা, কুম্ভকর্ণ, পান্ডিম-সহ বেশ কিছু পর্বতশৃঙ্গ। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে এভারেস্ট চূড়াও এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়।
নেই পর্যটকদের ভিড়, নেই শহরের কোলাহল, অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই সান্দাকফু। শীতে পুরো সান্দাকফু অঞ্চলটাই বরফে মোড়া থাকে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তিন দিনের পদযাত্রার ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে এক মুহূর্তে। সান্দাকফুতে থাকার জন্য ডিজিএইচসি-র ট্রেকার্স হাট ছাড়াও দু’-তিনটি বেসরকারি হোটেলও আছে। সকালে আপনার ঘুম ভাঙবে পাখির কোলাহলে। সান্দাকফুর ওয়াচ টাওয়ার থেকে সূর্যোদয় দেখবেন অবশ্যই। অনেকে ২১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ফালুট যান। সান্দাকফু থেকে ফালুট গোটা রাস্তাটাই এক দিনে পাড়ি দিতে হয়। ফালুটে কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ বিভিন্ন পর্বতচূড়া খুব কাছ থেকে দেখা যায়।
বেশির ভাগ পর্যটক সান্দাকফু থেকেই ফিরে যান। সান্দাকফু থেকে ফেরার দু’টি পথ আছে। একটি পথে রিম্বিকের জঙ্গল দিয়ে শ্রীখোলা, রিম্বিক হয়ে ফিরতে হয়। অন্যটি গত তিন দিনের ফেলে আসা পথ দিয়ে ফেরা। একই রাস্তায় না ফিরে অন্য দিক দিয়ে ফেরাই ভাল। ফেরার পথের সৌন্দর্য অতুলনীয়। এই পথে প্রথম তিন-চার কিলোমিটার প্রায় সারা বছরই বরফ থাকে। সান্দাকফু থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হবে শ্রীখোলায়। চার দিকে পাহাড়-ঘেরা ছোট্ট এলাকায় রাম্মাম নদীর উপর শ্রীখোলা ট্রেকার্স হাটে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা ভোলার নয়।

কী ভাবে যাবেন
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন বা শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে বা
গাড়িতে মানেভঞ্জন পৌঁছে পরের দিন সকালে হাঁটা শুরু করুন।
কোথায় থাকবেন
সব জায়গাতেই ডিজিএইচসি-র ট্রেকার্স হাট পাবেন, শুধু কালিপোখরি
নেপালে অবস্থিত হওয়ায় বেসরকারি হোটেলে থাকতে হবে।
কখন যাবেন
অগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সিজন হলেও শীতকালে এই পথের
প্রাকৃতিক শোভা অতুলনীয় এবং আকাশও পরিষ্কার থাকে।
কী নেবেন
‘রুকস্যাক’ তথা পাহাড়ে চড়ার জন্য তৈরি বিশেষ ধরনের ব্যাগ, স্লিপিং ব্যাগ, মোটা জ্যাকেট।
এ সব জিনিস ভাড়াতেও পাওয়া যায়, কিনতেও পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র, হালকা
পোশাক, টর্চ, ওষুধ ও ড্রাই ফুড। পরিচয়পত্র সঙ্গে নেবেন। সঙ্গে ক্রেপ ব্যান্ডেজ,
নি-ক্যাপ এবং প্লাস্টার টেপ নিতে ভুলবেন না।
Previous Item

Kolkata

Next Item




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.